ফিরে আসুক আরমান
স্বজন হারানোর বেদনা কল্পনাতীত। কিন্তু যখন রাতের আঁধারে চোখের সামনে থেকে গুম হওয়া সেই স্বজনটি বেচে আছি নাকি নেই? ভালো আছে নাকি কষ্টে আছে? কাছে কোথাও আটকে রাখা হয়েছে, নাকি ভিনদেশের অন্ধকার কোন এক প্রিজন সেলে বন্দী করে রাখা আছে? এগুলোর উত্তরে আপনি যখন কিছুই জানেন না, তখন বেদনা আরও কতো বেশি প্রকট, সেটা ভাষায় বুঝানো কঠিন।
যেভাবে আরমানকে গুম করা হয়
অন্যান্য দিনের মত কাজ শেষ করে বাসায় ফিরেন ভাইয়া। আমার ভাইয়া ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম আরমান। ৯ আগস্ট ২০১৬ রাতের আঁধারে সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাসা থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে গুম করে। ভাইয়াকে তার নিজ ঘর থেকে তার স্ত্রী, দুই শিশু মেয়ে এবং আমার সামনে থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিনের দরজার নকটি স্বাভাবিক ছিলোনা। আজ ও আমার কানে দরজার কড়া নাড়ানোর সে অস্বাভাবিক আওয়াজ ভাসে। এর কিছুদিন আগেই অগাস্টের ৪ তারিখে র্যাব তার বাসায় এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং ঠিকানা নিশ্চিত হয়ে নিষেধ করে এই বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য। আব্বুর কেসটি ক্রিটিকাল পর্যায়ে থাকাতে এবং তার ফোন ট্র্যাকিং হচ্ছে এটা নিশ্চিত হয়ে ভাইয়াও আর কোথাও না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ভেবেছিলো এটা আমাদের বাসায় অন্য তল্লাশি গুলোর ন্যায় ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। হয়তো এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু সেটা কেবলই যে ছিল এক ভয়ানক গুমের ঘটনার প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ তা তার ভুলেও জানা ছিলোনা এবং অবশেষে সেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনির হাতেই তাকে গুম হতে হল।
ভাইয়া দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে গিয়ে খেয়াল করলো ৭-৮ জন সাদা পোশাকধারি লোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। লোকগুলা একই সাথে আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত এবং দেখতে বীভৎস। তারা যে আইন শৃংখলা বাহিনীর লোক সেটা আর বুঝার কিছু বাকি রইলনা। কোন ওয়ারেন্ট ছাড়াই তারা ভাইয়াকে তাদের সাথে যেতে বলল। ভাইয়া বার বার তাদের পরিচয় জানতে চাচ্ছিল। কিন্তু তারা কোন নির্দিষ্ট পরিচয় দিল না। এক পর্যায় তারা ভাইয়াকে ঘিরে ফেললো এবং খালি পায়েই টেনে হিঁচ্ড়ে বাসা থেকে বের করে। ভাবি তখন তাদের থামাতে চিৎকার দিয়ে উঠে। ভাইয়ার দুই মেয়ে বাবার সাথে এই আচরণ দেখে জোরে জোরে “বাবা, বাবা” বলে কাঁদতে শুরু করে। ভাইয়ার স্যান্ডেল আর ওষুধের ব্যাগটি নিয়ে ভাবি তাদের পিছনে পিছনে ছুটে। ভাইয়াকে লিফট দিয়ে না নামিয়ে ৭-৮ জন মিলে টেনে হিঁচ্ড়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নামানো হয় এবং একটি কালো কাঁচের সাদা মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যায়। সেই রাত্রির পরে আজ চারটি বছর পার হয়ে গেল। ভাইয়া কে আমরা আর দেখতে পাইনি এমন কি আজ পর্যন্ত তার কোন খোঁজও পাইনি।
ছেলেকে নিয়ে বাবার শেষ অসিয়ত
কেবল ছেলে বা ঘরের কর্তা হিসেবে নয়। ভাইয়া গুম হওয়াতে আমাদের বড় আরেকটি সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়। ভাইয়া ছিল আমার বাবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচাররত মামলার প্রধান আইনজীবী। শুরু থেকেই অত্যন্ত দক্ষতা এবং আন্তরিকতা সহকারে মামলার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ভাইয়া গুম হওয়ার মাত্র কয়েকদিন পরেই সেই মামলার চূড়ান্ত রায় প্রদানের দিন ধার্য ছিল। প্রধান আইনজীবী হওয়াতে ভাইয়ার অনুপস্থিতিতে মামলার অনেক মূল্যবান তথ্য ও প্রস্তুতি অসম্পন্ন রয়ে যায়। এবং আব্বুর ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় ও কোনরকম কালক্ষেপণ না করে তড়িঘড়ি করে তা ভাইয়ার গুম হওয়ার তিন সপ্তাহের মাথায় ৩রা সেপ্টেম্বর ২০১৬ কার্যকর করা হয়।
আমার মরহুম পিতার শেষ অসিয়ত ছিল ভাইয়া যেন তাঁর জানাযা পরায়। এই শেষ দাবিটি তিনি একবার না বহুবার কারা কর্তৃপক্ষকে জানান। এমনকি তার আইনজীবীদের মাধ্যমেও সরকারের কাছে আবেদন পর্যন্ত জানান। তাতো বাস্তবায়িত হলই না বরং কারাগারে নিজ পরিবারের শেষ সাক্ষাতের সময়ও আব্বু ভাইয়াকে দেখতে পেলেন না। আমার আজও মনে আছে আব্বুর সাথে যখন আমরা শেষবারের মত দেখা করতে যাচ্ছি কত আশা নিয়ে ছিলাম, যেয়ে দেখবো ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন কারাগারের গেটের সামনে। সবচাইতে হৃদয়বিদারক মুহূর্ত ছিল যখন ভাইয়া কে ছাড়াই আমাদের প্রাণপ্রিয় বাবাকে মাটি দিতে হল। এই নির্দয় নিষ্ঠুর আচরণ ও অমানবিকতার কারন আমরা কি কখনো জানতে পারবো?
শিক্ষা পেশা ও পরিবার
ভাইয়া মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে ইংলিশ মিডিয়ামে ও-লেভেল এবং এ-লেভেল পাশ করে। পরবর্তীতে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন থেকে ব্রিটিশ আইনের উপর এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করে। এবং ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত লিনকন ইন (খরহপড়ষহ ওহহ) থেকে বার-এট-ল অর্জন করে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে আসে। উল্লেখ্য যে, তিনি যুক্তরাজ্য যাওয়ার আগেই বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এর অ্যাড্ভোকেট হন। দেশে ফিরে এসে ভূঁইয়া ল একাডেমীতে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং তার পাশাপাশি হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে অ্যাড্ভোকেট হওয়ার পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। আমার এখনো মনে আছে ভাইয়া তার ব্যাগে সবসময় এক কপি সংবিধান রাখতেন এবং সুযোগ পেলেই তা অধ্যয়ন করতেন। তাঁর প্রয়োজনীয় জায়গা গুলো পেন্সিল দিয়ে দাগিয়ে রাখতেন। এর কারন জানতে চাইলে ভাইয়া উত্তর দেন, ভবিষ্যতে সংবিধান এর বিশেষজ্ঞ হতে চান তিনি। আমি প্রায়ই ভাবি যে, ভাইয়ার সেই স্বপ্ন কি আদৌ পূরণ হবে কখনো?
ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরার পর ভাইয়া বিয়ে করেন। কয়েক বছর পর ভাইয়ার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। ভাইয়া অনেক আদর করে নিজের মায়ের নামেই তার মেয়ের নাম রাখে “আয়েশা”। বাবা মেয়ের খাতির দেখার মতন ছিল। সে বাবার হাতেই ঘুমাতো প্রতি রাত। ভাইয়া চেম্বার থেকে না ফেরা পর্যন্ত মেয়ে কখনো ঘুমাতো না। ভাইয়াও চেম্বার থেকে ফিরে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে মেয়েকে নিয়ে খেলাধুলাতে ব্যস্ত হয়ে যেত। সেই আয়েশা তাকোওয়ার বয়স আজ ৮ বছর। সে এখন ক্লাস ২ তে পড়ে। ছোট মেয়েটির নাম মারিয়াম বুশরা। তার বয়স ৭ বছর এবং সে এখন কেজি ২ তে পড়ছে। তারা প্রায়ই বাবার কথা জিজ্ঞেস করে মাকে। বাবা কেন আসে না ? তাদের ছেরে কিভাবে এত দিন দূরে আছে? অভিমানের সাথে এগুলো জানতে চায়। চার বছর আগে তাদের সামনে তাদের বাবাকে নির্মমভাবে তুলে নেওয়ার ভয়ানক স্মৃতি আজও তারা ভুলতে পারেনি। আজও বুকভরা আসা নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন বাবা তাদের কাছে ফিরে আসবে। প্রায় বাবার ফোন নাম্বারে ফোন দিয়ে কোন সারা না পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরে তারা। ভাবে বাবা কিভাবে তাদের ফোন না ধরে থাকে। তারা তো আর জানে না তাদের বাবা যে গুমের রাজ্যে হারিয়ে আজ তাদের না দেখতে পেয়ে একইভাবে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
ভাইয়ার মুক্তির জন্য নেওয়া পদক্ষেপসমূহ
ভাইয়া গুম হওয়ার রাতেই আমরা মিরপুর থানায় জিডি দায়ের করি। তার প্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে পুলিশ এর পক্ষ থেকে আমাদের কে মামলা করতে বলা হয়। তবে মামলা দায়ের করতে গেলে তারা মামলা গ্রহণ করতে গড়িমসি করে এবং এক পর্যায়ে ওসি নিজেই তাদের মামলা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে। তাই বলে আমাদের চেষ্টা থেমে থাকেনি। গত চার বছরে ভাইয়া কে নিয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়েছে, ফেইসবুক টুইটারে সহ সোশ্যাল মিডিয়াতে অসংখ্য বার্তা এসেছে। দেশ বিদেশে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে ও মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবাধিকার সংস্থা এবং সংগঠনের পক্ষ থেকে বিবৃতি ও মুক্তির দাবি এসেছে। তাছাড়া পুলিশ প্রধান, র্যাব প্রধান, ডিবি প্রধান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, প্রধান মন্ত্রী (তিনবার) এবং এমনকি মাননীয় রাষ্ট্রপতির নিকটেও আমার মা তার ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আবেদন জানিয়ে নিজ হাতে একাধিকবার চিঠি জমা দিয়ে আসেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি ভাইয়ার।
উলটো যখনই গুম বিষয়ে দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের কোন রিপোর্টে আমার ভাইয়ার নাম এসেছে তখনই আমাদের বাসায় পুলিশী রেইড এবং প্রশাসন ও সরকারি দলের লোকজনের পক্ষ থেকে খবরদারি চলেছে। আজ রীতিমত আমার মা, ভাবি এবং বিশেষ করে বাচ্চারা মানসিক ভাবে প্রচণ্ড ভীতসন্ত্রস্ত। এই না বুঝি পুলিশ আসবে আর পুরো বাসা তছনছ করে তল্লাশি করবে। এক অজানা আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতায় দিন পার করছে আরমানের পরিবার। মনে বার বার প্রশ্ন জাগে – ভাইয়া আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নাই বা থাকলে আমাদের পরিবারের উপরে কেন এই খবরদারি এবং কেনই বা এরকম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন?
পরিবারের পক্ষ থেকে দাবী
ব্যারিস্টার আরমানের দুটো ছোট ছোট অবুঝ সন্তান আছে। বয়স্ক মা এবং স্ত্রী আছে। তাকে ছাড়া এই পরিবারটি পুরো নিঃস্ব এবং তাদের দেখার ও দায়িত্ব নেওয়ার মত কেউ নাই। সংসার খরচ ও সন্তানদের ঠিক মত লালন-পালন করতে গিয়ে অসহায় ভাবি ও মা রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। শুধু তাই নয়, আমার বড় ভাইয়ার বিরুদ্ধেও একাধিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও হয়রানি মূলক মামলা থাকার কারণে সেও আজ নিরাপত্তাজনিত কারণে দেশে ফিরতে পারছে না। আমাদের পুরো পরিবার আজকে এক অনিশ্চিত ও মানবেতর জীবনের মধ্যে বসবাস করছে।
তাই দেশবাসী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারের প্রতি আমাদের আকুল আবেদন। আরমানকে তার পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হোক। সব রকম হয়রানি – সরকারী, বেসরকারী, থানা থেকে পুলিশি, পরিবারের সদস্যদের মামলা দিয়ে এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা, সব বন্ধ করা হোক। ব্যারিস্টার আরমানকে জনসম্মুখে আনা হোক। তাকে কোন অপরারাধে আটক করা হয়েছে তা প্রকাশ করা হোক। প্রয়োজনে আইনে সোপর্দ করা হোক। অপরাধ পাওয়া গেলে আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করা হোক। অন্যথায় তাকে মুক্ত করে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হোক।
আমরা আরমানের নিঃস্বার্থ মুক্তি চাই।
লেখিকা-তাহেরা তাসনিম,শহীদ মীর কাশেম আলীর কন্যা ও গুম হওয়া ব্যারিষ্টার আহমদ বিন কাশেমের ছোট বোন