দারসুল হাদীস-১
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের রিজিক প্রশস্ত হওয়া এবং নিজের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাওয়া পছন্দ করে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে। (বুখারি ও মুসলিম)
রাবি পরিচিতি :
আনাস ইবনে মালিক (রা) ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী, খাদিমে রাসূল, ইমাম, মুফতি, মুয়াল্লিমে কুরআন, মুহাদ্দিস, খ্যাতিমান রাবি, আনসারি, খাযরাজি ও মাদানি। কুনিয়াত আবু সুমামা ও আবু হামযা। উনার উপাধি ‘খাদিমু রাসূলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’। বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের বনু নাজ্জার শাখায় হিজরতের দশ বছর আগে ৬১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মালিক ইবন নাদর এবং মাতা উম্মু সুলাইম সাহলা বিনতু মিলহান আল-আন সারিয়্যা। উম্মু সুলাইম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) খালা হতেন।
হযরত রাসূলে কারীম (সা) যখন মদীনায় আসেন তখন প্রসিদ্ধ মতে আনাসের বয়স দশ বছর। রাসূল (সা) একটু স্থির হওয়ার পর আনাসের মা একদিন তাঁর হাত ধরে রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে নিয়ে যান এবং তাঁর খাদিম হিসেবে পেশ করেন। হযরত আনাস (রা) সর্বদা রাসূলুল্লাহ (সা) এর সান্নিধ্যে থাকতেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় দশ বছর অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে তাঁর খিদমতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) সাথে প্রায় সকল অভিযান যেমন বদর, উহুদ, খন্দক, কুরায়জা, মুসতালিক, খাইবার, হুনাইন ও তায়িফ ইত্যাদি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
হযরত আনাসের মৃত্যু সন ও মৃত্যুর সময় বয়স সম্পর্কে প্রচুর মতভেদ আছে। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে হিজরি ৯৩ সনে মৃত্যুবরণ করেন এবং তখন তাঁর বয়স হয়েছিল একশো বছরের ঊর্ধ্বে। কুতন ইবন মুদরিক আল-কিলাবী জানাযার নামায পড়ান। বসরার উপকণ্ঠে ‘তিফ্ নামক স্থানে তাঁর বাসস্থানের পাশেই কবর দেয়া হয়। হযরত আনাস ছিলেন দুনিয়া থেকে বিদায়গ্রহণকারী বসরার শেষ সাহাবী। সম্ভবত একমাত্র আবুত তুফাইল (রা) ছাড়া তখন পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো সাহাবী জীবিত ছিলেন না। মৃত্যুকালে হযরত আনাস মোট ৮২ জন ছেলেমেয়ে রেখে যান। তাদের মধ্যে ৮০ জন ছেলে এবং হাফসা ও উম্মু আমর নামে দুই মেয়ে। তা ছাড়া নাতি-নাতনীর সংখ্যা ছিল আরও অনেক।
তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা মোট ২২৮৬। মুত্তাফাক আলাইহি ১৮০, বুখারি এককভাবে ৮০ এবং মুসলিম এককভাবে ৭০টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর ছেলে এবং নাতীদের থেকেও বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
হাদীসের ব্যাখ্যা :
রাসূলুল্লাহ (সা) আলোচ্য হাদীসে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। কেননা মানুষের মাঝে ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, দয়া ও সহযোগিতার মূলভিত্তি হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক। এ সম্পর্ক নষ্ট হলে সমাজ উচ্ছন্নে যাবে। বর্তমান সময়ের পত্রিকার পাতায়, অনলাইন ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়াসহ সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় সমাজের অনেক মুসলমানই পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য ও আত্মীয়স্বজনের অধিকার সম্পর্কে একেবারেই অসচেতন। আত্মীয়স্বজনের সাথে মিলনের সেতুবন্ধকে ছিন্ন করে চলেছেন। আপন পিতা-মাতাকে পাঠাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে। আবার অনেক পিতা-মাতা ছেলেমেয়ে বেঁচে থাকার পরও জীবিকা নির্বাহের জন্য ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছেন।
আত্মীয় কারা :
ইসলামে আত্মীয়তার সম্পর্ক বলতে বুঝায় মা ও বাবার দিক থেকে রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়দেরকে। সুতরাং পিতা-মাতা, ভাই-বোন, চাচা, ফুফু, মামা, খালা এবং তাদের ঊর্ধ্বতন ও নিম্নতম ব্যক্তিবর্গ ও সন্তানগণ। এরা সবাই আরহাম রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়ের অন্তর্ভুক্ত। এদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করা জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম কারণ বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
“এবং তারা (রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়) আল্লাহর বিধান মতে তারা পরস্পর বেশি হকদার।” (সূরা আহজাব, আয়াত : ৬)
কারো মতে আত্মার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে আত্মীয় বলা হয়। সাধারণত রক্ত, বংশ কিংবা বৈবাহিক সূত্র থেকে আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। শরয়ী বিধান অনুযায়ী আত্মীয়স্বজনের আলাদা আলাদা হক বা অধিকার আছে। তাদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করা ওয়াজিব। শরয়ী কারণ ছাড়া সম্পর্ক ছিন্ন করা সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহর বাণী, “আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে একে অন্যের নিকট হতে অধিকার চেয়ে থাক এবং আত্মীয়তা ও নিকট সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাক। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ আল্লাহ তোমাদের ওপর কড়া নজর রেখেছেন।” (সূরা নিসা-১)
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব:
কুরআন ও হাদীসে আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। আল্লাহর ’তায়ালা বলেন, তোমরা এক আল্লাহ তায়ালার এবাদাত করো, কোনো কিছুকেই তাঁর সাথে অংশীদার বানিয়ো না এবং পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো, যারা ( তোমাদের) ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, এতীম, মিসকীন, আত্মীয় প্রতিবেশী, কাছের প্রতিবেশী, পাশের লোক, পথচারী ও তোমার অধিকারভুক্ত (দাস দাসী, তাদের সাথেও ভালো ব্যবহার করো), অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা এমন মানুষকে কখনো পছন্দ করেন না, যে অহংকারী ও দাম্ভিক। ( সূরা আন নেসা-৩৬)
হাদীসের আলোকে জানা যায়, কেউ আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করলে আল্লাহ তার সাথে নিজ সম্পর্ক ছিন্ন করেন। আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেন, আল্লাহ বলেন, “আমি রহমান, আমি রাহেমকে (আত্মীয়তার বন্ধন) সৃষ্টি করেছি। রাহেম নামটিকে আমি নিজের নাম থেকে নির্গত করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব। (বুখারি, আহমাদ ও তিরমিজি)
নবী করিম (সা:) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না বলে ঘোষণা করেছেন। যেমন জুবাইর ইবনে মুতঈম (রা) থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন, “আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (বুখারি ও মুসলিম)
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর আমল আল্লাহ কবুল করেন না। রাসূল (সা:) বলেন, “আদম সন্তানের আমলসমূহ প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত জুমার রাতে (আল্লাহর নিকট) উপস্থাপন করা হয়। তখন আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর আমল গ্রহণ করা হয় না। (আহমাদ) এ কারণেই রাসূল (সা:) বলেছেন “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে চলে।” (বুখারি)
হজরত আয়িশা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন, রাহেম (আত্মীয়তার সম্পর্ক) আরশের সাথে ঝুলানো রয়েছে। সে বলে, যে আমাকে জুড়ে দেবে, আল্লাহ তাকে জুড়ে দেবেন। যে আমাকে ছিন্ন করবে আল্লাহ তাকে ছিন্ন করবেন। (বুখারি ও মুসলিম)
আমাদের প্রিয়নবী (সা:) ছিলেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার মূর্তপ্রতীক। আবু সুফিয়ান (রা:) ইসলাম গ্রহণের আগে বাণিজ্য সফরে শাম দেশে গেলে বাদশা হিরাক্লিয়াস তার কাছে রাসূল (সা:) সম্পর্কে বিবরণ জানতে চান। তিনি বিবরণ তুলে ধরেন এভাবে যে, “তিনি আমাদের আল্লাহর ইবাদত, সালাত, সত্যবাদিতা, চারিত্রিক শুভ্রতা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার আদেশ করেন।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আনাস (রা:) বলেন, “যখন রাসূল (সা:) মদিনায় আগমন করেন, তখন আমি তার নিকটবর্তী হলাম। যখন আমি তার চেহারা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম, বুঝতে পারলাম যে, নিঃসন্দেহে এটি কোনো মিথ্যাবাদীর চেহারা হতে পারে না। তিনি প্রথমে যে কথা বলেছিলেন তাহলো, “হে লোকসকল, ইসলামের প্রচার কর, গরিবদের অন্ন দান কর, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা কর, রাতের বেলায় নামায আদায় কর, তাহলে তোমরা সহজে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।” (তিরমিজি)
আমর ইবনে আস (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রাসূল (সা:) কে প্রকাশ্যে বলতে শুনেছি, অমুকের বংশধররা আমার বন্ধু বা পৃষ্ঠপোষক নয়। আমার বন্ধু বা পৃষ্ঠপোষক হলো আল্লাহ এবং নেককার মুমিনগণ। তবে তাদের সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। আমি তা সজীব রাখার চেষ্টা করব। (বুখারি ও মুসলিম)
হজরত আবু বকর (রা:) খালাতো ভাইকে অর্থনৈতিক সাহায্য করতেন। ইফকের ঘটনায় এ ভাই সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছিলেন। এতে তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি ঠিক করলেন এ ভাইকে সাহায্য করবেন না। কিন্তু— মহান আল্লাহ এটা পছন্দ করলেন না। (সূরা নূর : ২২) ফলে আবু বকর (রা) তার সিদ্ধান্ত বদলালেন।
আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হকদার হলেন পিতা-মাতা। কুরআন ও হাদীসের আলোকে পিতা-মাতার আনুগত্য ও সেবা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফরজ আইন ইবাদত। কুরআনে আল্লাহ বারবার তার নিজের ইবাদতের করার পরই পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, “তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। পিতা-মাতা উভয়ে বা তাদের একজন যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তাহলে তাদেরকে ‘উফ’ বলবে না। তাদেরকে ধমক দেবে না এবং তাদের সাথে সম্মানজনক বিনম্র কথা বলবে। মমতাবশে তাদের জন্য নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত করে রাখবে এবং বলবে, হে আমার প্রতিপালক, আপনি তাদেরকে দয়া করুন যেমনভাবে তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছেন।” (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৪)
শিরকের পরে ভয়ঙ্করতম কবিরা গুনাহ হলো পিতা-মাতার অবাধ্যতা। রাসূল (সা:) বলেন, কঠিনতম কবিরা গুনাহ আল্লাহর সাথে শিরক করা, এরপর পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। (বুখারি)
পিতা-মাতার খিদমতকে নামাযের পরেই সর্বোত্তম আমল বলে ঘোষণা করে প্রিয়নবী (সা:) বলেন, “সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল হলো সঠিক সময়ে সালাত আদায় করা এবং পিতা-মাতার খিদমত করা। (বুখারি ও মুসলিম) রাসূল (সা:) আরো বলেন, “পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতা-মাতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (তিরমিজি)
রাসূল(সা:) বলেছেন,
“তার ধ্বংস হোক, তার ধ্বংস হোক, তার ধ্বংস হোক!! বলা হলো, কার কথা বলছেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতার কোনো একজনকে বা উভয়কে বার্ধক্যে পেয়েছে, অথচ জান্নাতে যেতে পারল না।” (মুসলিম)
অন্য হাদিসে এসেছে, তিন ধরনের ব্যক্তি বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না; তারা হলো- পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি; দাইয়ুস অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি যার স্ত্রী ব্যভিচারিণী অথচ সে তাতে বাধাদান করেনি বা তার প্রতিকার করেনি এবং পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী। (নাসাঈ)
হাদিসের সূত্র মতে মাতা-পিতার মৃত্যুর পরেও সন্তানের জন্য ৪টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে যায়।
সেগুলো হলো,
১) মাতা-পিতার জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করা,
২) তাঁদের কৃত ওয়াদা এবং বৈধ অসিয়তসমূহ পালন করা,
৩) তাঁদের বন্ধুদের সাথে সুন্দর আচরণ করা এবং
৪) তাঁদের আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় এবং সুন্দর আচরণ করা। (আল আদাবুল মুফরাদ)
এভাবে পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনদের হকের ব্যাপারে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস রয়েছে যা স্বল্প পরিসরে উলেখ করা সম্ভব নয়।
শেষ কথা :
আধুনিক সভ্যতায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনে পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনদের প্রতি অবহেলা সীমাহীন। ফলে আমাদের মাঝ থেকে শ্রদ্ধা, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা ইত্যাদি লোপ পাচ্ছে এবং পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। অথচ পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজন হক আদায় করা একজন মুমিনের জান্নাত লাভের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে এ ব্যাপারটি অনুধাবন করা সকলের জন্য একান্ত জরুরি।
লেখক : ড.আতিকুর ইসলাম, অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
দারসুল হাদীস-২
عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يَبْقَى مِنَ الْإِسْلَامِ إِلَّا اسْمُهُ، وَلَا يَبْقَى مِنَ الْقُرْآنِ إِلَّا رَسْمُهُ، مَسَاجِدُهُمْ عَامِرَةٌ وَهِيَ خَرَابٌ مِنَ الْهُدَى، عُلَمَاؤُهُمْ شَرُّ مَنْ تَحْتَ أَدِيمِ السَّمَاءِ مِنْ عِنْدِهِمْ تَخْرُجُ الْفِتْنَةُ وَفِيهِمْ تَعُودُ-
“হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ভবিষ্যতে মানুষের সামনে এমন একটা যুগ আসবে যখন নাম ব্যতিরেকে ইসলামের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, আল-কুরআনের আক্ষরিক তিলাওয়াত ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। তাদের মসজিদ গুলো হবে বাহ্যিক দিক দিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হবে হেদায়াত শূণ্য। আর তাদের আলেমগণ হবে আকাশের নিচে জমিনের উপরে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। কারণ তাদের মধ্য থেকে ইসলাম/দ্বীন সম্পর্কে ফিতনা প্রকাশ পাবে। অতপর সেই ফিতনা তাদের দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে।” (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান অধ্যায়)
রাবী পরিচিতি :
আলী ইবনে আবি তালিব রাসূল (সা.) এর চাচাত ভাই এবং জামাতা। নবী (সা.) এর পরিবারে লালিত-পালিত।
ইসলাম গ্রহণ : সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম।
মর্যাদা : আশআরে মুবাশ্শারাদের (জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০জন সাহাবীর) অন্তর্ভূক্ত। রাসূল (সা.) বলেছেন,
عن عبد الرحمن بن عوف قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم أبو بكر في الجنة و عمر في الجنة و عثمان في الجنة و علي في الجنة و طلحة في الجنة و الزبير في الجنة و عبد الرحمن بن عوف في الجنة و سعد في الجنة و سعيد في الجنة و أبو عبيدة بن الجراح في الجنة –
“হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, আবু বকর জান্নাতী, উমর জান্নাতী, উসমান জান্নাতী, আলী জান্নাতী, তালহা জান্নাতী, যুবায়ের জান্নাতী, আব্দুর রহমান বিন আওফ জান্নাতী, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস জান্নাতী, সাঈদ ইবনে যায়িদ জান্নাতী, আবু আব্দুল্লাহ ইবনে র্জারাহ জান্নাতী।” (সূনানে আত-তিরমিযি)
তিনি তাবুক অভিযান ছাড়া সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাবুক অভিযানের সময় রাসূল (সা.) তাকে মদীনার দায়িত্বে নিয়োজিত রেখেছিলেন।
তিনি ছিলেন জ্ঞানের মহা সাগর। রাসূল (সা.) বলেছেন,
أَنَا مَدِينَةُ الْعِلْمِ وَعَلِيٌّ بَابُهَا
“আমি জ্ঞানের নগরী আর সে নগরীতে প্রবেশের দরজা হচ্ছে আলী।” (মুসতাদরিক)
আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যা :
এ হাদীসের মধ্যে রাসূল (সা.) মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে চারটি ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। আর তা হলো:
১. لَا يَبْقَى مِنَ الْإِسْلَامِ إِلَّا اسْمُهُ : ইসলামের নামটা ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকবে না।
রাসূল (সা.) এই পৃথিবীতে এসেছিলেন সকল মতবাদের উপরে ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
“তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্যদ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সকল দ্বীনের উপর তা বিজয়ী করে দেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” (সূরা আস-সফ, আয়াত ৯)
ইসলামকে বিজয়ী আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ অবর্ণনীয় কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করেছেন। এক পর্যায়ে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (সা.) এর মাধ্যমে দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিআমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে।” (সূরা মায়েদা,আয়াত-৩)
মানবতার কল্যাণে যে ইসলাম বা জীবন ব্যবস্থা পৃথিবীতে এসেছে সেই ইসলামের বাস্তব প্রতিফলন সমাজে থাকবে না। শুধু নামে থাকবে ইসলাম।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে দলে দলে বিভক্ত হওয়ার বিষয়ে সতর্কবাণী উল্লেখ পূর্বক খুবই সুক্ষভাবে ঘোষণা করেছেন-
فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ زُبُرًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
“তারপর লোকেরা তাদের মাঝে তাদের দ্বীনকে বহুভাগে বিভক্ত করেছে। প্রত্যেক দলই তাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে উৎফুল্ল।” (সূরা মুমিনুন, আয়াত ৫৩)
مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُون
“যারা নিজদের দ্বীনকে বিভক্ত করেছে এবং যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে (তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না)। প্রত্যেক দলই নিজদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত।” (সূরা আর-রূম, আয়াত ৩২)
২. وَلَا يَبْقَى مِنَ الْقُرْآنِ إِلَّا رَسْمُهُ : আল-কুরআনের আক্ষরিক তিলাওয়াত ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
আল-কুরআন বিশ্ব মানবতার হেদায়েতের একমাত্র গ্রন্থ। পৃথিবীর যে কেউ হেদায়াত পেতে চাইলে তাকে আল-কুরআনের ছায়াতলে আসতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
إِنَّ هَذَا الْقُرْآَنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ وَيُبَشِّرُ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا كَبِيرًا
“নিশ্চয় এ কুরআন এমন একটি পথ দেখায় যা সবচেয়ে সরল এবং যে মু’মিনগণ নেক আমল করে তাদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।” (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৯)
আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনে আরো বলেন,
قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلَامِ وَيُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
“অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে শান্তির পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে এবং তাঁর অনুমতিতে তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন। আর তাদেরকে সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।” (সূরা মায়েদা ১৫-১৬)
এই কুরাআনকে সম্পূর্ণভাবে মেনে চললে সকল সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ
“আর আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা, হিদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ।” (সূরা আন-নাহল ৮৯)
বর্তমান সময়ের মুসলামানগণ এই আল-কুরআরকে তিলাওয়াত সর্বস্ব কিতাবে পরিণত করেছে। এ কথার দ্বারা এটা মনে করার সুযোগ নেই যে, কুরআন তিলাওয়াত করা যাবে না। বরং আল-কুরআন তিলাওয়াত করলে আপনি অবশ্যই প্রতি হরফে ১০টি করে নেকি পাবেন। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন,
مَنْ قَرَأَ الْقُرْآَنَ فَلَهُ بِكُلِّ حَرْفٍ عَشْرَ حَسَنَاتٍ
“যে ব্যক্তি আল-কুরআন তিলাওয়াত করবে প্রতিটি হরফের তার জন্য রয়েছে ১০টি করে সওয়াব।” (আল-বুরহান ফি উলুমিল কুরআন)
আল-কুরআনের হক হচ্ছে তাকে তিলাওয়াত করতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে, বাস্তব জীবনে কুরআনের বিধান মেনে চলতে হবে। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,-
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلَاوَتِهِ أُولَئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ وَمَنْ يَكْفُرْ بِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ
“যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা তা পাঠ করে যথার্থভাবে। তারাই তার প্রতি ঈমান আনে। আর যে তা অস্বীকার করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।” সূরা আল-বাকারা ২
কারণ এই আল-কুরআন কিয়ামতের দিন আপনার আমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন-
الْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ
“আল-কুরআন তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে।” (আহকামুশ-শরীয়াহ)
৩. مَسَاجِدُهُمْ عَامِرَةٌ وَهِيَ خَرَابٌ مِنَ الْهُدَى : মসজিদগুলো হবে বাহ্যিক দিক দিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ সুরম্য ইমারত কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হবে হেদায়াতশূণ্য।
রাসূল (সা.) এর জামানায় মসজিদ ছিলো সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দু। সাড়ে নয় লক্ষ বর্গমাইলের প্রেসিডেন্ট রাসূল (সা.) তাঁর কোন রাজ সিংহাসন ছিলো না। মসজিদের মিম্বরে দাড়িয়ে অথবা বসে ইসলামী রাষ্ট্রের সকল কার্যাবলী সম্পাদন করতেন। তখন রাষ্ট্রীয় সচিবালয় ছিলো মসজিদ।
এখানে মানুষ নামাজ আদায় করত, খুৎবা/ভাষণ শুনত, তালিম-তারবিয়াত হত, লেখা-পড়া হত, বিচার-ফয়সালা করা হত। কিন্তু আমাদের সমাজে নামাজ আদায় করা ছাড়া আর কোন কাজ করা হয় না। বর্তমান সময়ের এক শ্রেণীর আলেমগণ বলেন, মসজিদের মধ্যে দুনিয়াবী কথা বলা বা কাজ-কর্ম করা হারাম। এই ফতোয়া দেওয়ার মাধ্যমে মসজিদ থেকে সমাজের মানুষদেরকে আলাদা করে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে তাদেরকে বিমুখ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মসজীদে করণীয় ও বর্জনীয় কাজের বিবরণ আল-কুরআন, আল-হাদীস ও ফিক্হ শাস্ত্রে বিস্তারিত উল্লেখিত আছে। যেমন-
১. নামায আদায় করা, ইসলামী শরীয়াতের বিধি-বিধানের শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ দেওয়া।
২. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা,
৩. বিচার-ফয়সালা করা, কিন্তু শাস্তি কার্যকর হবে মসজিদের বাইরে।
৪. ইমামের নেতৃত্বে মহল্লাবাসীর দ্বীনের দা‘ওয়াত দেওয়া ও সার্বিক বিষয়ে খোজ-খবর নেওয়া।
৫. ইসলাম বিরোধী আচার-আচরণ সমাজ থেকে উৎখাত করার জন্য প্রয়োজনীয় কলা-কৌশল নির্ধারণ।
৬. যাকাত, দান-সদকা সংগ্রহ-বন্টন ইত্যাদি।
৭. ইতেকাফ, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া-যিকির ইত্যাদি।
৮. মানুষের জন্য কল্যাণ মূলক শিক্ষা দান।
৯. ইসলামী অনুশাসন যে রষ্ট্র বা সমাজে কায়েম আছে সেখানে মজলিসে শূরার বৈঠক করা।
১০. ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ষঢ়যন্ত্রের মোকাবেলায় আদেশ-নির্দেশ ও ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা।
৪. عُلَمَاؤُهُمْ شَرُّ مَنْ تَحْتَ أَدِيمِ السَّمَاءِ مَنْ عِنْدَهُمْ تَخْرُجُ الْفِتْنَةُ وَفِيهِمْ تَعُودُ : আর তাদের আলেমরা হবে আকাশের নিচে জমিনের উপরে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। কারণ তাদের মধ্য থেকে ইসলাম/দ্বীন সম্পর্কে ফিতনা প্রকাশ পাবে। অতপর সেই ফিতনা তাদের দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে।
এক শ্রেণীর আলেম শুধু দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে দ্বীন শিক্ষা করবে, তারা সমাজে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন বক্তব্য প্রদান করবে। এ বক্তব্যে সাধারণ মানুষ সঠিক ইসলাম থেকে সরে যাবে এবং বিভ্রান্তিতে পতিত হবে।
মুসলিম জাতির আদর্শিক পিতা হযরত ইবরাহীমের (আ.) আদর্শ অনুসরণ করত: রাসূল (সা.) একটি সুসংগঠিত জাতি তৈরী করেছিলেন। আমরা আজ সে আদর্শে উদাসীন হয়ে নানা দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। এ যেন আল-হাদীসের বাস্তব উদাহরণ: রাসূল (সা.) বলেছেন-
إِنَّ بَنِى إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِى عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِى النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِىَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِى
“বনি ইসরাঈলরা ৭২ টা দলে বিভক্ত হয়েছিলো আর আমার উম্মরা ৭৩ টা দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। এর মধ্যে ১টি দল ছাড়া সব দল জাহান্নামে যাবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন সে দল কোনটি? রাসূল (সা.) বললেন, আমি আমার সাহাবীদের নিয়ে যে কাজ করেছি এ কাজগুলো যারা করবে তারাই হবে জান্নাতি। (সূনানে আত-তিরমিযি)
এ সকল দলগুলো তৈরী হয়েছে খোলাফায়ে রাশেদীনের পর থেকে অদ্যবধি সমাজের এক শ্রেণীর আলেমগণের মাধ্যেমে।
রাসূল (সা.) প্রায় সাড়ে নয় লক্ষ বর্গমাইল এলাকার রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে একটা অবিভাজ্য দলের (আল-জামায়াত) নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। রাসূল (সা.) এর পর তাঁর উত্তরসূরী হযরত উমর (রা.) বার লক্ষ বর্গমাইলের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অনুরূপ একটি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অথচ বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবীর মুসলমানরা নানা দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এটাই মুসলিম বিশ্বের পতনের বহুবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ।একজন মুসলমান আর একজন মুসলমানকে বরদাস্ত করতে পারে না। বাংলাদেশেও বর্তমানে সবচেয়ে বেশী অনৈক্য, দলাদলি ও বিভেদ রয়েছে মুসলমানদের মধ্যে।
এমতাবস্থায় আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আল-কুরআন, আল-হাদীস, রাসূল (সা.) এর সীরাত, ও সাহাবায়েকেরামগণের জীবনালেখ্য অধ্যয়ন করে সরাসরি আমল করতে হবে। এছাড়া আমাদের দেশের আলেমগণের পারস্পারিক বিরোধিতাপূর্ণ ফতোয়া দান বন্ধ করে, তাদের মধ্যকার ছোট-খাটো বিভেদ নিরসন করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতে হবে।
লেখক : মাওলানা হাবীবুর রহমান, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ
দারসুল হাদীস -৩
عَنْ خَبَّابِ بْنِ الْأَرَتِّ قَالَ شَكَوْنَا إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ مُتَوَسِّدٌ بُرْدَةً لَهُ فِي ظِلِّ الْكَعْبَةِ قُلْنَا لَهُ أَلَا تَسْتَنْصِرُ لَنَا أَلَا تَدْعُو اللَّهَ لَنَا قَالَ كَانَ الرَّجُلُ فِيمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِي الْأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيهِ فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيدِ مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ وَاللَّهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الْأَمْرَ حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ لَا يَخَافُ إِلَّا اللَّهَ أَوْ الذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُونَ
অনুবাদ: হযরত খাব্বাব ইবন আরাত (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল (সা.) এর নিকটে গেলাম তখন তিনি ক্বাবা শরীফের ছায়ায় বসে আরাম করছিলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবেন না এবং দোয়া করবেন না? (আমরাতো মার খেতে খেতে শেষ হয়ে গেলাম)। আমাদের কথা শুনে রাসূল (সা.) বললেন, তোমাদের আগে যারা এই পৃথিবীতে দ্বীনের দা‘ওয়াত দিতে এসেছিল তাদেরকে (সমাজ শক্তি-রাষ্ট্র শক্তি) ধরত, তাদের জন্য জমিনে গর্ত খনন করা হত, এরপর সে গর্তে তাদেরকে গেড়ে দিত, এরপর করাত আনা হত, সে করাত তার মাথার উপরে রাখা হত, এরপর করাত চালিয়ে জিবিত মানুষটাকে চিরে দ্বিখন্ডিত করে ফেলা হত। এর পরেও তাদেরকে একচুলও আল্লাহর দ্বীন থেকে সরানো সম্ভব হয়নি। কোন কোন ক্ষেত্রে লোহার চিরুনী দিয়ে তাদের শরীরের হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলা হত, এর পরেও তাদেরকে দ্বীন থেকে সারানো সম্ভব হয়নি। (ও খাব্বাব শোন!) আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, এমন এক সময় আসবে যখন সানা থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত মানুষ চলবে, এ মানুষ গুলোর মনের মধ্যে আল্লাহর ভয় ছাড়া আর কোন ভয় থাকবে না। আর মেষ পালের জন্য বাঘের ভয় ছাড়া কোন ভয় থাকবে না। বরং তোমরা বড্ড তাড়াহুড়ো করছ। (সহীহ আল-বুখারী)
রাবী পরিচিতি
নাম খাব্বাব, পিতা আরাত। তিনি ছিলেন বনু তামিমের সন্তান। অন্য এক গোত্রের আক্রমণে তাঁর গোত্রটি পরাজিত হয়। আক্রমণকারীরা সকল পুরুষদেরকে হত্যা করে এবং নারী ও ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে দাসে পরিণত করে। খাব্বাব (রা.) ছিলেন ছোটদের একজন।
হাত বদল হয়ে তিনি পৌঁছেন মক্কার বাজারে। বনু খুজায়া’র উম্মু আন্মার নামের এক মহিলা তাঁকে ক্রয় করে। উম্মু আন্মার তাঁকে কর্মকারের কাজে নিয়োজিত করে। তিনি কয়লার মধ্যে লোহা গলিয়ে ঢাল, তলোয়ার ও বর্শা তৈরির কাজ করতেন। তিনি ছিলেন একজন সৎ ও কর্মঠ তরুণ।
মুহাম্মাদ (সা.) নামক এক ব্যক্তি নতুন দ্বীন প্রচার করছেন জানতে পেরে যুবক খাব্বাব (রা.) মুহাম্মাদুর রাসূল (সা.) এর কাছে গেলেন, তাঁর মুখে আল কুরআনের বাণী শুনে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত খাব্বাব (রা.) প্রথম পাঁচ ছয়জনের পরেই ইসলাম গ্রহন করেন ।
হযরত খাব্বাব (রা.) তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখলেন না। নিঃসংকোচে অন্যদের কাছে দ্বীনের কথা বলা শুরু করেন। কয়েকদিনের মধ্যে এই খবর পৌঁছলো উম্মু আন্মারের কাছে। উম্মু আন্মার তার ভাই সিবা’ ইবনু আবদিল উয্যা ও আরো কয়েকজনকে নিয়ে খাব্বাব (রা.) এর কাছে এসে বলে, ‘তুমি নাকি ধর্মত্যাগী হয়ে বনু হাশিমের এক যুবকের অনুসারী হয়েছ?’ তিনি বললেন, ‘আমি ধর্মত্যাগী হইনি। তবে লা-শারিক আল্লাহ্র ওপর ঈমান এনেছি, মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়েছি এবং সাক্ষ্য দিয়েছি মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ্র বান্দা ও রাসূল।’ তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই সিবা’ ও তার সঙ্গীরা নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ওপর। অনবরত কিল-ঘুষি মারতে থাকে, পা দিয়ে পিষতে থাকে।
একদিন খাব্বাব (রা.) আল্লাহ্র রাসূল (সা.) এর সান্নিধ্য থেকে তাঁর কর্মস্থলে ফিরে আসেন। সেখানে ছিল একদল লোক। তারা যখন জানতে পেল খাব্বাব রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট থেকে এসেছেন, তারা তাঁকে মারতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে এলে দেখেন তাঁর দেহ ক্ষত-বিক্ষত এবং পোষাক রক্তে-রঞ্জিত।
মক্কার মুশরিক নেতাদের নির্দেশে সিবা’ ইবনু আবদিল উয্যা ও তার সাথীরা খাব্বাব (রা.) কে লোহার পোষাক পরিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি দিতে থাকে। প্রচন্ড গরমে তিনি কাতর হয়ে পড়তেন, পিপাসায় ছটফট করতেন। এই অবস্থায় তাঁকে বলা হতো, ‘মুহাম্মাদ সম্পর্কে এখন তোমার বক্তব্য কী?’ দৃঢ় কণ্ঠে তিনি বলতেন, ‘তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নেওয়ার জন্য তিনি আমাদের নিকট এসেছেন।’ আবারো শুরু হতো মারপিট।
ইসলাম গহণ করার অপরাধে তার মনিব উম্মে আনমারের ভাইয়েরা তাকে অকথ্য নির্যাতন করত। তারা হাপরে কতকগুলো পাথর টুকরো গরম করে সেইগুলো বিছিয়ে এবং উত্তপ্ত আগুন তৈরি করে তার ওপর তাঁকে শুইয়ে দিত এবং একজন বলবান ব্যক্তি তাঁর বুকের ওপর পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকত। এই উত্তপ্ত পাথর ও জলন্ত কয়লার আগুনে তাঁর পিঠের গোশত খসে পড়ত, শরীরের রক্ত মাংসগুলো গলে গলে কয়লা ঠান্ডা হয়ে যেত। কয়লার আগুনে ঝলসে গিয়ে তার শরীরে এমন গর্ত হয়েছিল যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই গর্তগুলো পূরণ হয়নি। সেজন্য তিনি সব সময় গায়ের ওপর চাদর জড়িয়ে রাখতেন। মাঝে-মধ্যে উম্মু আন্মার দোকানে এসে হাপরে লোহার পাত গরম করে তাঁর মাথায় ঠেসে ধরত, যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করতেন, জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। এত নির্যাতনের পরেও তিনি ইসলাম ত্যাগ করে কুফরে ফিরে যেতে রাজি হননি।
হযরত ওমর (রা.) এর খিলাফতের সময় তিনি খাব্বাব (রা.) এর উপর নির্যাতনের বিস্তারিত জানতে চাইলে হযরত খাব্বাব (রা.) বলেন, ‘আমার কোমরের প্রতি লক্ষ্য করুন।’ হযরত ওমর (রা.) তাঁর কোমর দেখে বলেন, ‘হায় একি অবস্থা!’ তখন খাব্বাব (রা.) বলেন, ‘আমাকে জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর শুইয়ে ধরে রাখা হত, ফলে আমার চর্বি এবং রক্ত প্রবাহিত হয়ে আগুন নিভে যেত ।
মাত্র ৩৬ বছর বয়সে হযরত খাব্বাব (রা.) এর মৃত্যু হয় এবং সাহাবাদের মধ্যে সর্বপ্রথম তিনিই কুফায় কবরস্থ হন। তাঁর মৃত্যুর পর হযরত আলী (রা.) তাঁর কবরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলেন, ‘আল্লাহ খাব্বাবের উপর রহমত করুন। তিনি নিজের ইচ্ছায় মুসলমান হয়েছিলেন, হিযরত করেছিলেন, সমন্ত জিহাদে অংশগহণ করেছিলেন।
প্রেক্ষাপট
রাসূল (সা.) এর উপর সূরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে পৃথিবীতে আল-কুরআনের যাত্রা শুরু হয়। এরপর পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসেবে সূরা ফাতিহা নাযিল হয়। এর কিছুদিন পরে সূরা মুদ্দাুিছর এর প্রথম ৭ আয়াত নাযিল হয়। যেখানে বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنْذِرْ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ وَلَا تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ
“হে বস্ত্রাবৃত! উঠ, অতঃপর সতর্ক কর। আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। আর তোমার পোশাকÑপরিুছদ পবিত্র কর। আর অপবিত্রতা বর্জন কর। আর অধিক পাওয়ার আশায় দান করো না। আর তোমার রবের জন্যই ধৈর্যধারণ কর।” (সূরা মুদ্দাুিছর ১-৭)
এ আয়াত নাযিলের পর রাসূল (সা.) সর্বপ্রথম মা খাদিজার কছে কালিমার দা‘ওয়াত পেশ করলে তিনি কোন প্রশ্ন ছাড়াই বললেন, আপনি সত্য বলেছেন, “আমি সাক্ষ্য দিুিছ আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, আরো সাক্ষ্য দিুিছ মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।” এরপর আবু বকর (রা.) কে দ্বীনের দা‘ওয়াত দিলে তিনিও দা‘ওয়াত কবুল করে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। এভাবে গোপনে তিন বছর ইসলামের দা‘ওয়াত চলতে থাকে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা সূরা হিজর এর ৯৫ নং আয়াতে রাসূল (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন-
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
“সুতরাং তোমাকে যে আদেশ দেয়া হয়েছে, তা ব্যাপকভাবে প্রচার কর এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।” (সূরা হিজর, ৯৫)
এ আয়াত নাযিলের পর রাসূল (সা.) আরবের নিয়ম অনুযায়ী সাফা পাহাড়ের উপরে উঠে কুরাইশদেরকে তাওহীদের দিকে আহবান করলেন।
আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
صَعِدَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم الصَّفَا ذَاتَ يَوْمٍ فَقَالَ يَا صَبَاحَاهْ فَاجْتَمَعَتْ إِلَيْهِ قُرَيْشٌ قَالُوا مَا لَكَ قَالَ أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَخْبَرْتُكُمْ أَنَّ الْعَدُوَّ يُصَبِّحُكُمْ ، أَوْ يُمَسِّيكُمْ أَمَا كُنْتُمْ تُصَدِّقُونِي قَالُوا بَلَى قَالَ فَإِنِّي نَذِيرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَيْ عَذَابٍ شَدِيدٍ فَقَالَ أَبُو لَهَبٍ تَبًّا لَكَ أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا
“একদিন রাসূল (সা.) সাফায় উঠলেন এবং সবাইকে আহবান করলেন, কুরাইশগণ সেখানে একত্রিত হলো এবং বললো, হে মুহাম্মদ (সা.) তোমার কি হয়েছে? রাসূল (সা.) বললেন, আমি যদি বলি পাহাড়ের বিপরিতে তোমাদের শত্রু লুকিয়ে আছে তোমরা কি বিশ্বাস করবে? তারা সবাই বললো, অবশ্যই বিশ্বাস করব। রাসূল (সা.) বললেন, আমি তোমাদেরকে কঠিন আযাব থেকে সতর্ক করছি। এ কথা শুনে আবু লাহাব বলল, ধ্বংস হও তুমি, এ কথা বলার জন্য আমাদেরকে একত্রিত করেছ।” (সহীহ আল-বুখারী)
এরপর থেকে রাসূল (সা.) ও সাহাবীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য শত্রুতা শুরু হয়। মক্কায় ইসলামী দা‘ওয়াতের তৃতীয় পর্যায় যখন মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে শুরু করল, তখন কাফিরদের পক্ষ থেকে রাসূল (সা.) ও সাহাবীদের উপর যুলুম-নির্যাতনের মাত্রাও চরম পর্যায়ে পৌঁছাতে থাকল। রাসূল (সা.) কে শি’বে আবি তালিবে বন্দি জীবন-যাপন করতে হলো, সুমাইয়া, খুবাইব, আম্মারসহ বেশকিছু সাহাবীকে শহীদ করা হলো। বেলাল, খাব্বাবের মত সাহাবীদের প্রতি যুলুম-নির্যাতনের মাত্রা চরম সীমায় পৌঁছে গেল এ সময় একদিন হযরত খাব্বাব ইবনে আরাত (রা.) রাসূল (সা.) এর নিকট গেলেন, রাসূল (সা.) তখন ক্বাবা শরীফের ছায়ায় বসেছিলেন। হযরত খাব্বাব (রা.) বললেন-
أَلَا تَسْتَنْصِرُ لَنَا أَلَا تَدْعُو اللَّهَ لَنَا يَا رَسُوْلَ الله-
“হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আপনি কি আমাদের জন্য সাহায্য চাইবেন না, আমাদের জন্য দোয়া করবেন না?” হযরত খাব্বাব (রা.) এর প্রশ্নের জবাবে রাসূল (সা.) উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেন।
আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যা
যুগ যুগ ধরে যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল তাদের উপর যে যুলুম-নির্যাতন হয়েছে আলোচ্য হাদীসে রাসূল (সা.) সে সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যত নবী-রাসূল এবং তাঁদের উত্তরসূরী এই পৃথিবীতে দ্বীনে হকের দাওয়াত দিয়েছেন, দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন তাদের বিরুদ্ধেই ইসলাম বিরোধী শক্তি শত্রুতা করেছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا مِنَ الْمُجْرِمِينَ
“আর এভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর জন্য অপরাধীদের মধ্য থেকে শত্রু বানিয়েছি।” (সূরা ফুরকান, ৩১)
এ আয়াতের শিক্ষা হচ্ছে যারা ইসলামী আন্দোলনের কাজ করবে, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহতে অংশগ্রহণ করবে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবে তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা হবে, যুলুম-নির্যাতন হবে, তাদেরকে শহীদ করা হবে, ঘর-বাড়ী থেকে বিতাড়িত করা হবে। নির্যাতনের মাত্রার সীমা ছাড়িয়ে গেলেও দ্বীনে হকের উপর তারা টিকে থাকবে। রাসূল (সা.) ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উপর যুলুম-নির্যাতনের অতীত ইতিহাস তুলেধরে হযরত খাব্বাব (রা.) কে সে কথায় বলেছেন-
كَانَ الرَّجُلُ فِيمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِي الْأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيهِ فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيدِ مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ
“তোমাদের আগে যারা এই পৃথিবীতে দ্বীনের দা‘ওয়াত দিতে এসেছিল তাদেরকে সমাজ শক্তি-রাষ্ট্র শাক্তি ধরত, তাদের জন্য জমিনে গর্ত খনন করা হত, সে গর্তে তাদেরকে গেড়ে দিত, এরপর করাত আনা হত, সে করাত তার মাথার উপরে রাখা হত, এরপর করাত চালিয়ে জীবিত মানুষটাকে চিরে দ্বিখন্ডিত করে ফেলা হত। এর পরেও তাদেরকে একচুলও আল্লাহর দ্বীন থেকে সরানো সম্ভব হয়নি। কোন কোন ক্ষেত্রে লোহার চিরুনী দিয়ে তাদের শরীরের হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলা হত, এর পরেও তাদেরকে দ্বীন থেকে সারানো সম্ভব হয়নি।”
আল্লাহর সার্বভৌম ভিত্তিক ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার কাজ করার কারণে পৃথিবীতে অনেক নবী-রাসূলগণকে শহীদ করা হয়েছে, জেল খানায় বন্দি করা হয়েছে, অমানুসিক নির্যাতন করা হয়েছে। যারা তাঁদের উপর ঈমান এনেছিল তারাও রেহায় পায়নাই, তাদেরকেউ অনুরূপ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে, এর পরেও তাদেরকে হকের রাস্তা থেকে দূরে সরানো সম্ভব হয়নি। যুগযুগ ধরে নবী-রাসূলগণের প্রতি যুলুম-নির্যাতনের বর্ণনায় আল-কুরআন ঘোষণা করেন-
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ-
“নাকি তোমরা ভেবেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ এখনো তোমাদের নিকট তাদের মত কিছু আসেনি, যারা তোমাদের পূর্বে বিগত হয়েছে। তাদেরকে স্পর্শ করেছিল কষ্ট ও দুর্দশা এবং তারা কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তার সাথী মু’মিনগণ বলেছিল, ‘কখন আল্লাহর সাহায্য (আসবে)’? জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।” (সূরা আল-বাকারা, ২১৪)
আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে পরীক্ষা করার মাধ্যমে জেনে নেন ঈমানের দাবিতে কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী।
আল-কুরআনে বার্ণিত হয়েছে-
أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ-
“মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্যবাদী এবং তিনি এটাও জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী।” (সূরা আনকাবুত, ২-৩)
ষঢ়যন্ত্রকারীরা সব সময় ষঢ়যন্ত্র করবে, ঈমানদারদের শহীদ করবে, ক্ষতি সাধন করবে কিন্তু তারা বিজয়ী হতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দ্বীনের আলোকে জ্বালিয়ে রাখবেন।
আল্লাহ বলেন-
يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
“তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূরকে পূর্ণতাদানকারী। যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।” (সূরা আস-সফ, ৮)
আল-কুরআন থেকে জানা যায়, বড় বড় ইসলাম বিরোধী শক্তি ইসলাম-ইসলামী আন্দোলনকে পৃথিবী থেকে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছে, কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি। যেমন-
হযরত ইবরাহীম (আ.) নমরুদকে দ্বীনের দা‘ওয়াত দিলেন, নমরুদ সহ্য করতে পারল না, রাগান্বিত হয়ে হযরত ইবরাহীম (আ.) কে হত্যা করার জন্য অগ্নিককুুন্ড তৈরী করে সে আগুনে তাঁকে ফেলে দিল, আল্লাহ তা’আলা সে আগুনকে ইবরাহীম (আ.) এর জন্য শান্তিদায়ক এবং ঠান্ডা করে দিলেন।
আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
قَالُوا حَرِّقُوهُ وَانْصُرُوا آلِهَتَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ فَاعِلِينَ قُلْنَا يَا نَارُ كُونِي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلَى إِبْرَاهِيمَ
“তারা বলল, ‘তাকে আগুনে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের দেবদেবীদেরকে সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও। আমি বললাম, ‘হে আগুন, ইবরাহীমের জন্য তুমি শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।” (সূরা আম্বিয়া, ৬৮-৬৯)
হযরত মুসা (আ.) ফিরাউনকে তাওহীদের দা’ওয়াত দিলেন। ফিরাউন বলল, হে মুসা এতবড় তোমার কলিজায় সাহস আমার ভুখন্ডে দাড়িয়ে তুমি আমাকে বাদ দিয়ে অন্যকে ইলাহরূপে গ্রহণ করছ? আমি তোমাকে জেলখানায় বন্দি করব।
আল-কুরআনের বাণী-
قَالَ لَئِنِ اتَّخَذْتَ إِلَهًا غَيْرِي لَأَجْعَلَنَّكَ مِنَ الْمَسْجُونِينَ
“ফিরাউন বলল, ‘যদি তুমি আমাকে ছাড়া কাউকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাকে কয়েদীদের অন্তর্ভুক্ত করব।” (সূরা শুআরা, ২৯)
হযরত মূসা (আ.) বললেন-
وَقَالَ مُوسَى رَبَّنَا إِنَّكَ آتَيْتَ فِرْعَوْنَ وَمَلَأَهُ زِينَةً وَأَمْوَالًا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا رَبَّنَا لِيُضِلُّوا عَنْ سَبِيلِكَ رَبَّنَا اطْمِسْ عَلَى أَمْوَالِهِمْ وَاشْدُدْ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُوا حَتَّى يَرَوُا الْعَذَابَ الْأَلِيمَ
“আর মূসা বলল, ‘হে আমাদের রব, আপনি ফিরাউন ও তার পারিষদবর্গকে দুনিয়াবী জীবনে সৌন্দর্য ও ধন-সম্পদ দান করেছেন। হে আমাদের রব, যাতে তারা আপনার পথ থেকে গোমরাহ করতে পারে। হে আমাদের রব, তাদের ধন-সম্পদ নিশ্চিহ্ন করে দিন, তাদের অন্তরসমূহকে কঠোর করে দিন। ফলে তারা ঈমান আনবে না, যতক্ষণ না যন্ত্রণাদায়ক আযাব দেখে।” (সূরা ইউনূচ, ৮৮)
আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধচারণ করার কারণে এই ফিরাউনকে আল্লাহ তা‘আলা চরম শিক্ষা দিলেন। মিসরের নীল দরিয়ার মাঝে তাকে ও তার পারিষদবর্গকে সলিল সমাধি করলেন।
আল্লাহ বলেন-
وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَجُنُودُهُ بَغْيًا وَعَدْوًا حَتَّى إِذَا أَدْرَكَهُ الْغَرَقُ قَالَ آمَنْتُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ
“আর আমি বনী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করিয়ে নিলাম। আর ফিরাউন ও তার সৈন্যবাহিনী ঔদ্ধত্য প্রকাশ ও সীমালঙ্ঘনকারী হয়ে তাদের পিছু নিল। অবশেষে যখন সে ডুবে যেতে লাগল, তখন বলল, ‘আমি ঈমান এনেছি যে, সে সত্তা ছাড়া কোন ইলাহ নেই, যার প্রতি বনী ইসরাঈল ঈমান এনেছে। আর আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত’।” (সূরা ইউনূচ, ৯০)
এখানেই শেষ নয়, পৃথিবীবাসীর জন্য নিদর্শন ও শিক্ষণীয় হিসেবে আল্লাহ তা‘আলা ফিরাউনের লাশকে সংরক্ষণ করে রেখে দিলেন ।
আল্লাহ বলেন-
آلْآنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنْتَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ فَالْيَوْمَ نُنَجِّيكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ لِمَنْ خَلْفَكَ آيَةً وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ عَنْ آيَاتِنَا لَغَافِلُونَ
“এখন অথচ ইতঃপূর্বে তুমি নাফরমানী করেছ, আর তুমি ছিলে ফাসাদকারীদের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। আর নিশ্চয় অনেক মানুষ আমার নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে গাফেল।” (সূরা ইউনূচ, ৯১-৯২)
যুগে যুগে যারা ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উপর যুলুম-নির্যাতন করেছে আল্লাহ তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিয়েছেন। কালের সাক্ষী হিসেবে আজো তা পৃথিবীতে বিদ্যমান রয়েছে।
আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
وَمَكَرُوا مَكْرًا وَمَكَرْنَا مَكْرًا وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ مَكْرِهِمْ أَنَّا دَمَّرْنَاهُمْ وَقَوْمَهُمْ أَجْمَعِينَ فَتِلْكَ بُيُوتُهُمْ خَاوِيَةً بِمَا ظَلَمُوا إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ وَأَنْجَيْنَا الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ
“আর তারা এক চক্রান্ত করল এবং আমিও কৌশল অবলম্বন করলাম। অথচ তারা উপলদ্ধিও করতে পারল না। অতএব দেখ, তাদের চক্রান্তের পরিণাম কিরূপ হয়েছে। আমি তাদের ও তাদের কওমকে একত্রে ধ্বংস করে দিয়েছি। সুতরাং ঐগুলো তাদের বাড়ীঘর, যা তাদের যুলমের কারণে বিরান হয়ে আছে। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে সে কওমের জন্য যারা জ্ঞান রাখে। আর আমি মু’মিনদের মুক্তি দিলাম এবং তারা ছিল তাকওয়া অবলম্বনকারী।” (সূরা নামল, ৫০-৫৩)
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উপর পরীক্ষা সম্পর্কে অন্য একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ، عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ ، أَنَّهُ قَالَ : عِظَمُ الْجَزَاءِ مَعَ عِظَمِ الْبَلاَءِ ، وَإِنَّ اللَّهَ إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلاَهُمْ ، فَمَنْ رَضِيَ فَلَهُ الرِّضَا ، وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السُّخْطُ-
“হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) রাসূল (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.) বলেন, বিপদ-আপদ ও পরীক্ষা যত কঠিন হবে তার প্রতিদানও তত মূল্যবান হবে। আর আল্লাহ যখন কোন জাতিকে ভালোবাসেন তখন অধিক যাচাই-বাচাই ও সংশোধনের জন্য তাদেরকে বিপদ-আপদ ও পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। অতঃপর যারা আল্লাহর সিদ্ধান্তকে খুশি মনে মেনে নেয় এবং ধৈর্যধারণ করে, আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হন। আর যারা এ বিপদ ও পরীক্ষায় আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট হয় আল্লাহও তাদের উপর অসন্তুষ্ট হন। (সূনান আত-তিরমিযি, ইবনে মাজা)
এই বিপদ-আপদ, যুলুম-নির্যাতনের মাঝেও যারা ধৈর্য অবলম্বন করবে, দ্বীনে হকের উপর টিকে থাকবে, জান-মাল দিয়ে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহতে অংশগ্রহণ করবে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে উত্তম প্রতিদান দিবেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ وَأُخْرَى تُحِبُّونَهَا نَصْرٌ مِنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ
“তোমরা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আর তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত এবং চিরস্থায়ী জান্নাতসমূহে উত্তম আবাসগুলোতেও (প্রবেশ করাবেন)। এটাই মহাসাফল্য। এবং আরো একটি (অর্জন) যা তোমরা খুব পছন্দ কর। (অর্থাৎ) আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও নিকটবর্তী বিজয়। আর মু’মিনদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও।” (সূরা আস-সফ, ১১-১৩)
উক্ত হাদীসের শেষাংশে রাসূল (সা.) হযরত খাব্বাব (রা.) কে সেই সুসংবাদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, খাব্বাব এ রাস্তায় মার খাও, শহীদ হও, যুলুম-নির্যাতনে ধৈর্য অবলম্বন করে দৃঢ়তার সাথে ইসলামের পথে টিকে থাক তাহলে খুব তাড়াতাড়ি তোমরা আল্লাহর সাহায্যে বিজয় অর্জন করবে।
রাসূল (সা.) বললেন-
وَاللَّهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الْأَمْرَ حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ لَا يَخَافُ إِلَّا اللَّهَ أَوْ الذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُونَ
“(ও খাব্বাব শোন!) আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, এমন এক সময় আসবে যখন সানা থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত মানুষ চলবে, এ মানুষ গুলোর মনের মধ্যে আল্লাহর ভয় ছাড়া আর কোন ভয় থাকবে না। আর মেষ পালের জন্য বাঘের ভয় ছাড়া কোন ভয় থাকবে না। বরং তোমরা বড্ড তাড়াহুড়ো করছ।”
উপরিউক্ত হাদীস থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনের কাজ করতে গেলে বিপদ-মুসিবত, যুলুম-নির্যাতন আসবে। এ অবস্থায় আল্লাহর পথে দৃঢ়তার সাথে টিকে থাকতে হবে, ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে তিনি যেন আমাদেরকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেন। আমীন।
লেখকঃ মাওলানা হাবীবুর রহমান, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ
দারসুল হাদীস-৪
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ ( সা:) বলেছেন, আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে শুধু যে অস্বীকার করেছে সে ছাড়া। সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল ( সা:) কে অস্বীকার করবে ? রাসুলুল্লাহ ( সা:) বললেন, যে আমার আনুগত্য করল সে জান্নাতে যাবে আর যে আমার অবাধ্য হল বা অমান্য করল, সে অস্বীকার করল। (সহীহ আল-বুখারী)।
রাবী পরিচিতি:
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হোরায়রা রা. এর প্রকৃত নাম আবদুর রহমান বিন সখর আদ্ দাওসী। তিনি ৭ম হিজরীতে ত্রিশ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর নাম রাখেন আবদুর রহমান বা আবদুল্লাহ। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল স. এর সঙ্গ কোনভাবেই ত্যাগ করেননি। তিনি যেখানেই সফরে যেতেন তিনি তাঁর সাথে থাকতেন। সাহাবীগণের মধ্যে তিনি সর্বাধিক হাদীস বর্ণনা কারী । ইমাম আস্-সুয়ূতী র.( মৃ. ৯১১ হি.) এর মতে তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৩৭৪ টি। এর মধ্যে বুখারী এবং মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে ৩২৫ টি। অবশেষে হাদীসের এই মহান সাধক ৫৯ হিজরীতে ৭৮ বছর বয়সে মারা যান।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীসের ভাষ্য অত্যন্ত পরিষ্কার । নবী করিম স. এর প্রকৃত উম্মতগণ জান্নাতে যাবে, কিন্তু যারা নবী স. কে মানবে না অথবা অস্বীকার করবে তাদের কী হবে ? অপর দিকে যারা রাসূল স. কে অনুসরণ করছে তাঁরা কতটা করবে? এ ধরনের কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে। সুতরাং আমরা এ সংক্রান্ত আলোচনা আল- কুরআন এবং আল- হাদীসের আলোকে উপস্থাপন করছি।
হাদীসের প্রথম অংশ ( كُلُّ أُمَّتِيْ يَدْخُلوْنَ الجَنَّةِ ) এ অংশের সাথে মানুষের অনেক কিছু জড়িত। তবে এ হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী পহেলা যে বিষয়টা এসেছে তা হলো (مَنْ أَطَاعَنِيْ ) অর্থাৎ ‘যে আমার আনুগত্য করল’। এই আনুগত্যের দাবী হলো নবী করিম (স.) দীর্ঘ ২৩ বছরে আল-কুরআনের যত নির্দেশনা পেয়েছেন এবং নিজের বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে যে সকল কাজ করেছেন তা সবই নিজের পরিমন্ডলে বাস্তবায়ন করা। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা আল- হাশরের ৭ নং আয়াতে বলেন:
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَاب
(রসূল যা কিছু তোমাদের দেন তা গ্রহণ করো এবং যে জিনিস থেকে তিনি তোমাদের বিরত রাখেন তা থেকে বিরত থাকো। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা)
উক্ত আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে রাসূল (স.) এর উপর যে নির্দেশনা এসেছে তা অনুসরণ করতে হবে । সেক্ষেত্রে কোন ছাড় নেই। যদি এমন কোন ব্যাপার হয় যা আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে জড়িত, অথবা এ সংক্রান্ত কোন বিষয় নিয়ে পরস্পরের মধ্যে বাদানুবাদ হয় তবে সে-সব কিছুর সমাধানের জন্য মুমিনদেরকে সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ এবং রাসূল (স.) এর পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً
(হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রসূলের আর সেই সব লোকের যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী। এরপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন ব্যাপারে বিরোধ দেখা দেয় তাহলে তাকে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান এনে থাকো। এটিই একটি সঠিক কর্মপদ্ধতি এবং পরিণতির দিক দিয়েও এটিই উৎকৃষ্ট।) সুরা আন-নিসা: ৫৯।
যে ব্যক্তি রাসূল (স.) এর আনুগত্য করবে সে আল্লাহ তায়া‘লার আনুগত্য করল , আর যদি কেউ নবী করিম (স.) কে বাদ দিয়ে জীবনের কোন বিষয় বাস্তবায়ন করে তবে তা আল্লাহর দায় থেকে সে মুক্ত হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ সুরা আন-নিসার ৮০ নং আয়াতে বলেন:
مَّنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللّهَ وَمَن تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا
(যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করলো সে আসলে আল্লাহরই আনুগত্য করলো। আর যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নিলো, যাই হোক, তাদের ওপর তো আমি তোমাকে পাহারাদার বানিয়ে পাঠাইনি।) মানব জীবনের সকল স্তরে যদি আল্লাহ নিদের্শিত এবং রাসূল (স.) প্রদর্শিত নির্দেশাবলীর প্রতিফলন না ঘটে তবে তা হবে আনুগত্যহীন কাজ এবং তা এক পর্যায়ে মানুষকে কুফরির দিকে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে আল কুরআনের নির্দেশনা হলো :
قُلْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَالرَّسُولَ فإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبُّ الْكَافِرِينَ
( হে নবী ! তাদেরকে বলুন, আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর। তবে যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে নিশ্চই আল্লাহ এমন লোকদের মহব্বত করবেন না যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে অস্বীকার করে। সুরা আল ইমরান: ৩২।
রাসূল সা.) এর আনুগত্যের মাধ্যমে জান্নাত ও আল্লাহর রহমত পাওয়ার নিশ্চয়তা বিদ্যমান। মহান আল্লাহ বলেন:
وَأَقِيمُوا الصَّلاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
নামায কায়েম করো, যাকাত দাও এবং রসূলের আনুগত্য করো, আশা করা যায়, তোমাদের প্রতি করুণা করা হবে।- সুরা আন-নূর: ৫৬।
তিনি আরও বলেন:
(হে নবী! লোকদের বলে দাওঃ “যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।” তাদেরকে বলোঃ আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য করো।) সুরা আলে ইমরান: ৩১।
রাসূল (স.) এর আনুগত্য করার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর নির্দেশনা এসেছে আল-কুরআনে। নবী করিম (স.) এর কোন ফয়সালা , নিয়মাবলী ও কার্যাবলীর ব্যাপারে সামান্যতম কোন ভিন্নতার মনোভাব পোষণ করলে তারা মুমিন হিসেবে গণ্য হবেনা । মহান আল্লাহ বলেন:
فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُواْ فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسْلِيمًا
(না, হে মুহাম্মাদ! তোমার রবের কসম, এরা কখনো মু’মিন হতে পারে না যতক্ষণ এদের পারস্পরিক মতবিরোধের ক্ষেত্রে এরা তোমাকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে না নেবে, তারপর তুমি যা ফায়সালা করবে তার ব্যাপারে নিজেদের মনের মধ্য যে কোনো প্রকার কুণ্ঠা ও দ্বিধার স্থান দেবে না, বরং সর্বান্তকরণে মেনে নেবে।) সুরা আন-নিসা:৬৫।
আল হাদীসেও আনুগত্যের ব্যাপারে খুব জোরালো যে নির্দেশ এসেছে তাহলো:
وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله:من أطاعني فقد أطاع الله، ومن عصاني فقد عصى الله، ومن يطع الأمير فقد أطاعني، ومن يعص الأمير فقد عصاني- متفق عليه.
– হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন: যে আমার আনুগত্য করল সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার হুকুম অমান্য করল সে আল্লাহ্র হুকুমই অমান্য করল। আর যে আমীরের আনুগত্য করল সে আমারই আনুগত্য করল। যে আমীরের আনুগত্য করল না সে আমাকে অমান্য করল। (বুখারী, মুসলিম)
নবী করিম (স.) এর আনুগত্য ও তাঁর অনুসরণ করা ওয়াজিব। এ ব্যাপারে উলামাদের ‘ইজমা হলো :
وقد أجمع العلماء على وجوب طاعة النبي صلى الله عليه وسلم واتباعه؛
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, জান্নাতী মানুষ হবার জন্য কখনই আল্লাহ এবং রাসূলের সামান্যতম বিরোধিতা করা যাবেনা ।
হাদীসের শেষ অংশ (مَنْ أَبَى) ‘যে অস্বীকার করল’। কে অস্বীকার করল? সাহাবাগণের এমন প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (স.) বললেন: ‘যে আমার অবাধ্য হলো বা আমাকে অমান্য করল’। সুতরাং আমাদের কাছে দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার যে, নবী (স.) এর উম্মতের মধ্যে জান্নাতে যাবেনা শুধুমাত্র সে, যে ‘ রাসূল এর অবাধ্য হয়েছে এবং তাঁকে অমান্য করেছে’।
আমাদের ভাবনার বিষয় হলো, আমরা কী নিম্নে বর্ণিত বিষয়সমূহে রাসূল (স.) কে অমান্য করছি? যেমন: ক. আমরা ফরজ ওযাজিব কাজগুলো কতটা গুরুত্বের সাথে করি ? খ. আমাদের আর্থিক জীবনে হালাল- হারাম, সুদ-ঘুষ, ন্যায়- অন্যায় কতটা দেখে চলি? গ. একজন ছাত্র, শিক্ষক, এম.পি,মন্ত্রী, সচিব, পরিবারের কর্তা এবং দায়িত্বশীল হিসেবে আমার উপর অর্পিত আমানত কতটা পুরো করি? ঘ. সামাজিক জীবনে সকলের অধিকারের কতটুকু আদায় করতে পারি? ঙ. আমাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ডে রাসূল স. এর কতটুকু অনুসরণ করি? চ. যারা আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে তাদের কতটা বিরোধিতা করি? ছ. আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য আল্লাহ তা‘য়ালার দেয়া সময়, অর্থ, মেধা এবং শ্রম দেয়ার জন্য আমরা কতটা উদগ্রীব ?
এ জাতীয় বিষয়গুলো সবসময় ভাবতে হবে। সে ভাবনা নবী (স.) এর দেখানো পথে হতে হবে, অন্যথায় আমাদের অজান্তেই রাসূল (স.) কে অমান্যকারিদের কাতারে শামিল হয়ে যেতে পারি এবং জান্নাতে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে হেফাযত করুন।
হাদীসের শিক্ষা:
১. সর্বাবস্থায় আল্লাহর এবং রাসূল (স.) এর আনুগত্য করার
মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম করতে হবে।
২. রাসূলুল্লাহর (স.) এর সিরাত সবসময় অধ্যয়ন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী যথাযথভাবে মনে রাখতে হবে।
৩. ব্যক্তিগত, সামাজিক , পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ে রাসূল (স.) এর কর্মনীতি অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
৪. সর্বোপরি কোন কাজ করার আগেই ভাবতে হবে- এটা কী নবী (স.) এর দেখানো অথবা করণীয় পদ্ধতিতে হচ্ছে?
মহান আল্লাহ তাঁর নির্দেশমত এবং রাসূল ( স.) এর দেখানো পথে আমাদের সকলকে চলার তৌফিক দিন।
লেখক : মুহা.রফিকুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দারসুল হাদীস-৫
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, “হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে আসনি।” সে বলবে, “আমি আপনাকে কিভাবে দেখতে আসতে পারি? আপনিতো সারা বিশ্বজগতের প্রতিপালক!!” তিনি বলবেন, “তুমি তো জেনে ছিলে যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল, তবুও তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, যদি তুমি তাকে দেখতে যেতে, তবে তুমি আমাকে তার নিকট পেতে।” (তিনি বলবেন) “হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাদ্য দাওনি।” সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আপনিতো বিশ্বজাহানের প্রভু! আমি আপনাকে কিভাবে খাওয়াতে পারি? তিনি বলবেন, তুমিতো জেনে ছিলে যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে খাদ্য দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে খাবার খাওয়াতে তাহলে আমার কাছ থেকে তা পেয়ে যেতে। (তিনি বলবেন) “হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম অথচ তুমি আমাকে পানি দাওনি।” সে বলবে, আপনি হলেন সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতিপালক, আপনাকে আমি কিভাবে পান করাতাম? তিনি বলবেন, “তুমি তো জেনে ছিলে যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিল কিন্তু তুমি তাকে পানি দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, যদি তুমি তাকে পান করাতে তবে তার পুরস্কার আমার নিকট পেতে।” (সহিহ মুসলিম)
রাবির পরিচয়
রাসূল (সা.) এর জালিলুল কদর সাহাবী, সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী আবু হুরাইরা (রা.)। আবু হুরাইরা তাঁর উপনাম, প্রকৃত নাম আবদুল্লাহ অথবা আবদুর রহমান। (মতভেদ রয়েছে) তিনি ইয়েমেনের দাওসি গোত্রের লোক ছিলেন। ত্রিশ বছর বয়সে খায়বারে আগমন করে রাসূল (সা.) এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পরে তিনি যাবতীয় দুনিয়াবি ভোগবিলাস ত্যাগ করে আল্লাহর রাসূল (সা.) এর সাহচর্যে থেকে ইলম অর্জন করাকেই প্রাধান্য দেন। তিনি আহলে সুফফার একজন অন্যতম সদস্য ছিলেন। রাসূল (সা.) এর দোয়ার বরকতে তাঁর স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতেন। তিনি নবী করীম (সা.) থেকে মোট ৫৩৭৪টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর শাসনামলে তিনি দুইবার মদিনার গভর্নর নিযুক্ত হন। ৫৮-৫৯ হিজরিতে মদিনাতেই ইন্তেকাল করেন। এই সময় তাঁর বয়স ছিল প্রায় ৮০ বছর।
হাদিসের ব্যাখ্যা
আলোচ্য হাদিসে ‘খিদমাতে খালক’ তথা সৃষ্টির সেবার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হাদিসের মূল কথা হলো, আল্লাহর রহমত, বরকত ও সওয়াব হাসিলের সবচেয়ে সহজ এবং সংক্ষিপ্ত পথটি হচ্ছে, আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি বিশেষত মানুষের প্রতি সহযোগিতা, কল্যাণ ও উপকারের হাত বাড়িয়ে দেয়া। পার্থিব জীবনে আমরা জিকির, সালাত, সাওম বা তাহাজ্জুদ ইত্যাদি ইবাদতের সওয়াব সম্পর্কে যতটুকু সচেতন, সৃষ্টির সেবার ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে ঠিক ততটাই যেন বেখবর। আল্লাহকে ভালোবাসতে হলে অবশ্যই তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে এবং তাদের সেবা ও সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। আল্লাহর রাসূল (সা:) অপর এক হাদিসে বলেন, “প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা।” (সহীহ আল বুখারি)
মানবকল্যাণের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা:) বলেন, “যতক্ষণ একজন মানুষ অন্য কোনো মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা তার কল্যাণে রত থাকবেন। (সহিহ মুসলিম)
অন্য স্থানে আল্লাহর রাসূল (সা:) বলেন, “আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে প্রিয় যে মানুষের বেশি উপকার করে।” (আল মু’জামুল আওসাত)
আলোচ্য হাদিসে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। যথা :
১. অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করা ও খোঁজখবর নেয়া
২. ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাদ্য দান করা
৩. পিপাসিত ব্যক্তিকে পানি পান করানো
আমরা নিচে পর্যায়ক্রমে বিষয় তিনটির গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাবো।
প্রথমতঃ অসুস্থ মানুষের প্রতি সমাজের অন্য মানুষের দায়িত্ব হলো, তাদের সেবা করা, দেখতে যাওয়া, চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহ প্রদান, মানসিক আস্থা তৈরি করা এবং দোয়া করা। হাদিসের ভাষ্যমতে, কাউকে অসুস্থ জানার পরও তাকে দেখতে না গেলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে। রাসূল (সা:) বলেন, “যদি কেউ কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যায় তবে সে যেন ফিরে না আসা পর্যন্ত অবিরত জান্নাতের বাগানে ফল রোপণ করতে থাকে।” (সহিহ মুসলিম)
অপর হাদিসে আছে, “যদি কেউ কোনো রোগীকে দেখতে যায় তখন সে (আল্লাহর) রহমতের মধ্যে সাঁতার কাটতে থাকে। আর যখন সে রোগীর পাশে বসে, তখন যেন সে রহমতের মাঝে ডুব দেয়।”
তিরমিজি শরিফে এসেছে, রাসূল (সা:) বলেন, যদি কোনো মুসলিম সকালে কোনো রোগীকে দেখতে যায় তাহলে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদিন তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা দোয়া করতে থাকে। আর যদি সন্ধ্যায় কোনো রোগীকে কোনো ব্যক্তি দেখতে যায় তবে সত্তর হাজার ফেরেশতা সকাল পর্যন্ত তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকে এবং তার জন্য বেহেশতে একটি বাগান হবে।
আবু হুরাইরা (রা:) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একজন মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! সেগুলো কী কী? তিনি বললেন-
১.সাক্ষাতে সালাম বিনিময় করা
২.আমন্ত্রণ করলে গ্রহণ করা
৩.উপদেশ চাইলে উপদেশ দেয়া
৪.হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে উত্তরে ইয়ারহামু কাল্লাহ বলা
৫.অসুস্থ হলে সাক্ষাৎ করে খোঁজখবর নেয়া এবং
৬.মৃত্যুবরণ করলে জানাজায় উপস্থিত থাকা। (মুসলিম-৪০২৩)
দ্বিতীয়তঃ মানবসেবার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাদ্য দান করা। আল্লাহর একজন অভাবী-অভুক্ত বান্দাকে ক্ষুধার্ত রেখে নিজে পেটপুরে খাবার গ্রহণ করলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। প্রকৃত মুমিন হতে হলে এবং আল্লাহর প্রিয় হতে চাইলে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাওয়ানোর কোনো বিকল্প নেই। হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে তৃপ্তি সহকারে আহার করে সে মুমিন নয়।” (বাযযার, হাকিম ও তাহাবি)
অন্যত্র আল্লাহর রাসূল (সা:) বলেন, আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে প্রিয় যে মানুষের বেশি উপকার করে। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো, কোনো মুসলিমের অন্তরে আনন্দ প্রবেশ করানো কিংবা তার বিপদ বা কষ্ট ইত্যাদি দূর করা, ঋণ আদায় করে দেয়া অথবা তার ক্ষুধা নিবারণ করা। (সহিহুত তারগিব)
আবু যার (রা:) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে আবু যার! তুমি তরকারি রান্না করলে তাতে পানি (ঝোল) বেশি রাখো এবং তা তোমার প্রতিবেশীকে পৌঁছাও। (মুসলিম, আবু দাউদ, দারিমি ও হিব্বান)
হজরত আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন, বিধবা এবং মিসকিনের সহযোগিতাকারী আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর ন্যায়, বা সর্বদা রাতে নামাজরত ও দিনের বেলা রোজাদার ব্যক্তির মত। (সহিহ বুখারি)
যারা অভাবী ও মিসকিনকে খাবার দেয় না আল্লাহতায়ালা তাদের ব্যাপারে বলেন-
১) (হে রাসূল) আপনি কি সেই ব্যক্তিক দেখেছেন যে আখেরাতের পুরস্কার ও শাস্তিকে মিথ্যা বলছে?
২) সে-ইতো এতিমকে ধাক্কা দেয়
৩) এবং মিসকিনকে খাবার দিতে উদ্বুদ্ধ করে না। (সূরা আল মাউন, আয়াত নং ১-৩ )
তৃতীয়তঃ পিপাসিত ব্যক্তিকে পানি পান করানো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। এটি একটি মানবকল্যাণমুখী কর্ম। হাদিসের ভাষায় একে উত্তম সদকা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। রাসূল (সা:) বলেন, “সবচেয়ে উত্তম সদকা হলো মানুষকে পানি পান করানো।” (আহমদ, আবু দাউদ শরিফ)
হজরত সাদ বিন উবাদা (রা:) এসে নবীজিকে বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমার মা মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি তার জন্য কোনো কিছুর ওসিয়ত করে যাননি। আমি যদি তার পক্ষ হয়ে কিছু সদকা করি, তবে কি তা আমার মায়ের কোনো উপকারে আসবে? নবীজি বললেন, হ্যাঁ, হবে। তুমি মানুষকে পানি পান করাও।
একবার হজরত ইবনে আব্বাস (রা:)-কে প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘কোন দান সর্বাপেক্ষা উত্তম?’ উত্তরে তিনি বললেন, রাসূল (সা:) বলেছেন, ‘উত্তম দান হলো পানি। তোমরা কি শোননি যে জাহান্নামিরা জান্নাতিদের কাছে প্রথমে পানি, তারপর খাদ্য ভিক্ষা চাইবে। ইমাম কুরতুবি একটি আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে বলেছেন, যার গোনাহ বেশি হয়ে গেছে, সে যেন মানুষকে পানি পান করায়। রাসূল (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে পানি পান করাবেন, আল্লাহ তাকে হাউজে কাওছার থেকে এমন পানি পান করাবেন, যার পর জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত আর পিপাসা লাগবে না।’ (বায়হাকি, ইবনে খুজাইমা)
শুধুমাত্র মানুষ নয়, সৃষ্টিজীবের যেকোনো প্রাণীকে পানি পান করানোর মধ্যেই সওয়াব নিহিত। সহিহ বুখারিতে আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একজন লোক রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে তার ভীষণ পিপাসা লাগলো। সে কূপে নেমে পানি পান করল। এর পর সে বের হয়ে দেখতে পেল যে, একটা কুকুর হাঁপাচ্ছে এবং পিপাসায় কাতর হয়ে মাটি চাটছে। সে ভাবল, কুকুরটারও আমার মতো পিপাসা লেগেছে। সে কূপের মধ্যে নামল এবং নিজের মোজা ভরে পানি নিয়ে মুখ দিয়ে সেটি ধরে ওপরে উঠে এসে কুকুরটিকে পান করাল। আল্লাহ্পাক তার আমল কবুল করলেন এবং আল্লাহ তার গোনাহ মাফ করে দেন। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! চতুষ্পদ জন্তুর উপকার করলেও কি আমাদের সাওয়াব হবে? তিনি বললেন, প্রত্যেক প্রাণীর উপকার করাতেই সাওয়াব রয়েছে।
উপরের তিনটি কর্মই মানবকল্যাণমুখী কর্ম। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এ ধরনের কাজগুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। খ্রিষ্টান মিশনারিগণ এই ধরনের সেবামূলক কাজ-কর্ম করার মাধ্যমে তাদের ধর্মের প্রসার ঘটাচ্ছে। মানবসেবার মাধ্যমে তারা ধর্মান্তকরণ করছে। অতএব আমাদের দাওয়াতি কাজের সম্প্রসারণ ঘটাতে হলে এই জাতীয় কল্যাণমুখী কর্মের কোনো বিকল্প নাই। আল্লাহর কাছেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূল (সা:) বলেন, মানবকল্যাণমুখী কর্ম বিপদাপদ ও অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। গোপন দান আল্লাহর ক্রোধ নির্বাপিত করে। রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা আয়ু বৃদ্ধি করে। (হাইসামি)
লেখক : মুহা. আক্তার হোসেন, ইসলামী চিন্তাবিদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ।
দারসুর হাদীস-৬
বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করিম (সা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা সাত ধরনের ব্যক্তিকে তাঁর আরশের ছায়া দ্বারা আচ্ছাদিত করবেন যেদিন ঐ ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না। ১. ন্যায়পরায়ণ শাসক, ২. ঐ যুবক যে আল্লাহ্ তায়ালার ইবাদাতে বেড়ে ওঠে, ৩. এমন ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহ্ তায়ালাকে স্মরণ করে এবং তার নয়নযুগল অশ্রুসিক্ত হয়, ৪. ঐ ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে ঝুলন্ত থাকে, ৫. এমন দুই ব্যক্তি যারা একে অন্যকে শুধুমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের আশায় ভালোবাসে, ৬. এমন ব্যক্তি যাকে কোন প্রভাবশালী সুন্দরী রমণী কুপ্রস্তাব দেয় আর সে উত্তরে বলে আমি আল্লাহ্কে ভয় করি, ৭. ঐ ব্যক্তি যে নিজের দানকে এমনভাবে গোপন করে যে তার বাঁ হাত জানতে পারে না ডান হাত দ্বারা কী দান করল। (সহীহ বুখারী, ষষ্ঠ খন্ড, পৃ. ২৪৯৬, হাদিস নম্বর ৬৪২১)
রাবি পরিচিতি
আবু হুরায়রা উপনামে সর্বাধিক পরিচিত। নাম ও পিতার নাম নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ মতে জাহেলি যুগে তাঁর নাম আবদে শামস বা আবদে আমর এবং ইসলাম গ্রহণের পর আবদুল্লাহ বা আবদুর রহমান এবং পিতার নাম সাখর। তিনি দাওস গোত্রের লোক ছিলেন। আবু হুরায়রা (রা) একদা জামার আস্তিনের ভেতরে বিড়াল বহন করে রাসূলুল্লাহ সা:-এর দরবারে হাজির হলেন, রাসূলুল্লাহ সা: জানতে চাইলেন জামার আস্তিনের ভেতের কী? উত্তরে তিনি বললেন বিড়াল। তখন থেকেই রাসূলুল্লাহ (সা:) তাকে আবু হুরায়রা উপনামে ডাকতেন এবং এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। জীবনী লেখকগণ তাঁর নাম ‘উপনাম অধ্যায়ে’ উল্লেখ করেন এবং আবু হুরায়রা হিসেবেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন।
সপ্তম হিজরিতে খায়বার যুদ্ধের সময় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এরপর থেকে তিনি সর্বদা রাসূলুল্লাহ সা:-এর সংস্পর্শেই থাকতেন এবং এ কারণে তিনিই সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবীর মর্যাদা লাভ করেন। একদা তিনি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে ভুলে যাওয়ার অভিযোগ করলে তিনি তাকে চাদর বিছাতে বললেন, অতঃপর চাদর বিছালে রাসূলুল্লাহ সা: তাতে হাত ভর্তি করে দান করলেন এবং চাদর গুটিয়ে নিতে বললেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি চাদর গুটিয়ে নিলাম এবং এর পর থেকে আর কোন কিছু ভুলিনি। ইমাম বুখারী (রহ) বলেন, সাহাবা ও তাবেয়ি মিলে আটশত জনের বেশি লোক আবু হুরায়রা (রা.) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। উমর ইবনে খাত্তার (রা.) এর জামানায় তাঁকে বাহরাইনের শাসনকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছিল এবং পরে সেখান থেকে তাঁকে অপসারণ করা হয়। ৭৮ বছর বয়সে আবু হুরায়রা (রা.) ঊনষাট হিজরি সালে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। কারো কারো মতে তিনি সাতান্ন মতান্তরে আটান্ন হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। মদিনার তৎকালীন আমির ওয়ালিদ ইবনে উকবা তাঁর জানাজায় ইমামতি করেন।
হাদিসের ব্যাখ্যা
আলোচ্য হাদিসে কিয়ামত দিবসের ভয়াবহ সময়ে যখন মানুষ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করবে একটু ছায়ার সন্ধানে তখন উপরোক্ত বিশেষণে বিশেষিত ব্যক্তিবর্গ আল্লাহ তায়ালার বিশেষ কৃপা লাভ করবেন এবং তাঁর ছায়াতলে আশ্রয় পাবেন। এখানে আল্লাহর ছায়া দ্বারা কারো কারো মতে আল্লাহ্ তায়ালার বিশেষ তত্ত্বাবধান ও সুরক্ষাদানকে বুঝানো হয়েছে। অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মতে আরশের ছায়াকে বুঝানো হয়েছে যা অন্য সূত্রে বর্ণিত হাদিস দ্বারা সমর্থিত। হাদিসে বর্ণিত সাত ব্যক্তির বর্ণনা নিম্নে সবিস্তারে উল্লেখ করা হলো :
১. ন্যায়পরায়ণ বাদশা বা শাসক
হাফিয ইবনে হাজার আসকালানির (রহ) মতে এখানে শাসক দ্বারা কোন দেশ বা এলাকার নির্বাহী প্রধানকে বুঝানো হয়েছে। তবে মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত যে সকল লোক ন্যায়ানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তাদের ক্ষেত্রেও উক্ত বিধান প্রযোজ্য হবে। ন্যায়পরায়ণতা বলতে প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তায়ালার বিধান অনুসরণ করাকে বুঝানো হয়েছে। ন্যায়ের বিপরীত হলো অত্যাচার বা অনাচার। আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে বলেন : আর যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচার করবে ন্যায়পরায়ণতার সাথে করবে। (সূরা নিসা : ৫৮)
২. যে যুবক আল্লাহ্ তায়ালার ইবাদতের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে।
এখানে যুবককে বিশেষিত করা হয়েছে এ কারণে যে, যৌবনকালে মানুষ প্রবৃত্তি দ্বারা বেশি তাড়িত হয়ে থাকে। তাই প্রবৃত্তিকে দমন করে আল্লাহভীতিকে প্রাধান্য দিয়ে যে যুবক আল্লাহর ইবাদতে আত্মনিয়োগ করে তার জন্য এ মহান পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
৩. যে ব্যক্তির অন্তর মসজিদের সাথে ঝুলন্ত থাকে
অর্থাৎ মসজিদের বাইরে অবস্থান করলেও মসজিদের সাথে মন লেগে থাকে এবং অপেক্ষায় থাকে আবার কখন মসজিদে প্রবেশ করবে। এমনিভাবে যেকোনো কাজেই থাকুক না কেন আজানের সময়ের অপেক্ষায় থাকবে এবং যথাসময়ে মসজিদে প্রবেশ করবে। কেউ কেউ এর দ্বারা মসজিদের প্রতি মহব্বত বা ভালোবাসাকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ মসজিদ থেকে বের হয়ে পুনরায় মসজিদে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত এর সাথে ভালোবাসা পোষণ করা। কেননা পানির মধ্যে মাছ যেমন প্রশান্তি পায় মু’মিন তেমনি মসজিদে প্রশান্তি পায়। আর খাঁচার মধ্যে পাখি যেমন ছটফট করে মুনাফিক তেমনি মসজিদের মধ্যে ছটফট করে।
৪. এমন দুই ব্যক্তি যারা একে অন্যকে আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের আশায় ভালোবাসে
উল্লেখ্য যে, এই ভালোবাসা বাহ্যিকভাবে হলে হবে না বরং তা প্রকৃতপক্ষেই ভালোবাসা হতে হবে। দু’জনে একত্রে থাকুক বা আলাদা থাকুক এই ভালোবাসায় কোন ঘাটতি হবে না। সাহাবা-তাবেঈন, সালফে সালেহিনদের মাঝে এই ভালোবাসার বহু নজির বা দৃষ্টান্ত রয়েছে। মুতার যুদ্ধের সেই তিন যোদ্ধা- যারা পিপাসার্ত অবস্থায় হাতের নাগালে পানি পেয়েও অন্য ভাইয়ের জন্য উৎসর্গ করেছেন এবং শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেছেন- এই ঈমানী ভ্রাতৃত্বের মূর্তপ্রতীক। অন্য হাদিসে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করাকে ঈমানের অংশ বলে অভিহিত করা হয়েছে। হাফিয ইবনে হাজারের (রহ) মতে এই ভালোবাসা এমন হতে হবে যে, দুনিয়াবি কোনো কারণে তা বিঘ্নিত হবে না এবং উপস্থিত অনুপস্থিত সর্বাবস্থায়ই বলবৎ থাকবে যতক্ষণ না মৃত্যু তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায়।
৫. যে ব্যক্তি লৌকিকতা পরিহার করে নির্জনে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করে-মুখে হোক বা অন্তরে হোক- এবং তার দু’নয়ন অশ্রুসিক্ত হয়
সকল মানুষ যখন নিদ্রায় মগ্ন থাকে তখন নির্জনে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকাকে জান্নাত লাভের অন্যতম পাথেয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে অন্য হাদিসে।
৬. এমন ব্যক্তি যাকে কোন সুন্দরী, বংশীয় ও প্রভাবশালী রমণী ব্যভিচারের দিকে আহবান করে তখন সে বলে আমি আল্লাহকে ভয় করি
অর্থাৎ আল্লাহ্ তায়ালার ভয়ে ঐ রমণীর আহবানকে প্রত্যাখ্যান করে যদিও তাতে কোন দুনিয়াবি শাস্তির আশঙ্কা থাকে। আল্লাহর নবী হযরত ইউসুফ (আ) মিসরের আযীয পত্মী জুলেখার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে জেলখানাকে উত্তম বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করেছেন যা পবিত্র কুরআনের সূরা ইউসুফে বিধৃত হয়েছে।
৭. এমন ব্যক্তি যিনি তার দানকে এমনভাবে গোপন রাখেন যেন ডান হাত কী দান করল বাম হাত জানতে পারল না
এখানে বাহ্যিকভাবে সকল প্রকার দানকে বুঝানো হলেও আল্লামা নববী (রহ) বিশেষজ্ঞ আলিমগণের বরাতে বলেছেন যে, ফরয দান গোপনে করার চাইতে প্রকাশ্যে করাই উত্তম। ইবনে মালেক বলেন: এই গোপনীয়তা নফল দানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, কারণ জাকাত প্রকাশ্যে দেয়া উত্তম। স্মর্তব্য যে, উপরোক্ত হাদিসে কিয়ামাত দিবসে আরশের নিচে ছায়া প্রাপ্য যে সাত শ্রেণীর লোকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাতেই সীমাবদ্ধ নয়। হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (রহ) অনুসন্ধান চালিয়ে আরো অনেক বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পেয়েছেন যেগুলো আরশের নিচে ছায়া প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহায়ক হবে এবং এ বিষয়ে তিনি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। এতে বুঝা গেল যে, উপরোক্ত হাদিসের সাত সংখ্যাটি মুখ্য নয়।
হাদিসের শিক্ষা
ক. ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয়সহ সকল পর্যায়ে ন্যায়নীতি ও ইনসাফ অবলম্বন করা সর্বোত্তম ইবাদত। এর বিপরীতে রয়েছে অন্যায়, অনাচার, অত্যাচার যা জঘন্য অপরাধ এবং পরলোকে তা শুধুই অন্ধকার আর অন্ধকার।
খ. ইবাদত জীবনের সকল স্তরে গুরুত্বপূর্ণ হলেও যৌবন কালের ইবাদতের মর্যাদা বেশি। কারণ এ সময়ে মানুষের কুরিপু এবং প্রবৃত্তি দমন অন্য বয়সের তুলনায় কষ্টসাধ্য।
গ. মু’মিনের অবস্থান যেখানেই হোক, যে কাজেই সে লিপ্ত থাকুক তার অন্তর সর্বদা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে এবং মসজিদই হবে তার আত্মার ঠিকানা।
ঘ. মু’মিনদের পারস্পরিক ভালোবাসা, বিদ্বেষ, হাদিয়া প্রদান, হাদিয়া গ্রহণ, সুসম্পর্ক বজায় রাখা, পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়ানো ইত্যাদি সকল কর্মই হবে আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। এ সকল বৈশিষ্ট্য ঈমানের পূর্ণতার লক্ষণ।
ঙ. আল্লাহ্ তায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য নির্জনতা সর্বোত্তম কৌশল এবং মু’মিনের চোখের পানি আল্লাহ্ তায়ালার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান ও প্রিয়।
চ. প্রতিকূল পরিবেশে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজের সম্ভ্রম বজায় রাখা সর্বোত্তম ইবাদত।
ছ. নফল দান খয়রাত করার সময় সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা ও আত্মপ্রচার থেকে নিজেকে দূরে রাখা মু’মিন চরিত্রের সর্বোত্তম ভূষণ।
পরিশেষে কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণ লাভ এবং সুখী সমৃদ্ধ জাতি গঠনে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ দ্বারা মু’মিনদের চরিত্র গঠনে আল্লাহ্ তায়ালার অনুকম্পা লাভের প্রত্যাশায় মুনাজাত করছি। আমিন! ছুম্মা আমিন!!
লেখক : ড.মুহা. ওলীউল্লাহ, প্রফেসর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
দারসুল হাদীস-৭
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ قَال أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ{رواه الترمذي
আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম (জ্ঞান) অর্জন করার উদ্দেশ্যে পথ চলবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দিবেন। (তিরমিযী হা/২৬৪৬; ইখনু মাজাহ হা/২২৩; সহিহুল জামে‘ হা/৬২৯৮, সনদ সহিহ।)
রাবির পরিচয় : আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি একজন প্রসিদ্ধ সাহাবা। যাঁর প্রকৃত নাম আবদুর রহমান ইবনে সা’খর অথবা উমায়র ইবনে আমির। (তিনি তিন বছর নবী মুহাম্মদ (সা:)-এর সান্নিধ্যে ছিলেন এবং বহুসংখ্যক হাদিস আত্মস্থ করেন এবং বর্ণনা করেন। হিসাব অনুযায়ী ৫,৩৭৫টি হাদিস তাঁর কাছ থেকে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে আটশত তাবেঈ হাদিস শিক্ষা লাভ করেছিলেন।
আলোচ্য বিষয় : আলোচ্য হাদিসে ‘ইলম তথা জ্ঞান অর্জনের ফজিলত ও মর্যাদার কথা আলোচনা করা হয়েছে।
হাদিসের ব্যাখ্যা : ইলম অর্জনের মর্যাদা অত্যধিক। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহ যাদেরকে জ্ঞান দান করেছেন তাদেরকে উচ্চমর্যাদায় উন্নীত করবেন। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত।’ (মুজাদালাহ ৫৮/১১)। ইলম অর্জনের মর্যাদা সম্পর্কে অত্র হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে পথ চলবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেবেন।
অন্য হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِى أُمَامَةَ الْبَاهِلِىِّ قَالَ ذُكِرَ لِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَجُلاَنِ أَحَدُهُمَا عَابِدٌ وَالآخَرُ عَالِمٌ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِى عَلَى أَدْنَاكُمْ ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللَّهَ وَمَلاَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ حَتَّى النَّمْلَةَ فِى جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ.
আবু উমামা আল-বাহিলি (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সামনে দু’জন লোকের কথা উল্লেখ করা হলো। যাদের একজন আলিম অপরজন আবিদ। তখন তিনি বলেন, আলিমের মর্যাদা আবিদের ওপর। যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের সাধারণের ওপর। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, নিশ্চয়ই তার প্রতি আল্লাহ রহমত করেন এবং তার ফেরেশতামন্ডলী, আসমান-জমিনের অধিবাসী, পিপীলিকা তার গর্তে থেকে এবং এমনকি মাছও কল্যাণের শিক্ষা দানকারীর জন্য দোয়া করেন। ( তিরমিজি হা/২৬৮৫; মিশকাত হা/২১৩, সনদ হাসান।)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,
مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَطْلُبُ فِيهِ عِلْمًا سَلَكَ اللَّهُ بِهِ طَرِيقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِى السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِى الأَرْضِ وَالْحِيتَانُ فِى جَوْفِ الْمَاءِ .
‘যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করার উদ্দেশ্যে কোনো পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তা‘আলা তা দ্বারা তাকে জান্নাতের কোন একটি পথে পৌঁছে দেন এবং ফেরেশতাগণ ইলম অন্বেষণকরীর ওপর খুশি হয়ে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন। এ ছাড়া আলেমদের জন্য আসমান ও জমিনের সকল অধিবাসী আল্লাহর নিকট দোয়া ও প্রার্থনা করে। এমনকি পানির মধ্যে বসবাসকারী মাছও (তাদের জন্য দোয়া করে)। ( আবুদাউদ হা/৩৬৪১; মিশকাত হা/২১২; সহিহুল জামে‘ হা/৬২৯৭, সনদ সহিহ।)
ইলম অর্জনের গুরুত্ব : রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ওপর সর্বপ্রথম প্রত্যাদেশকৃত শব্দ হল, اِقْرَأْ ‘আপনি পড়ুন!। রাসূলুল্লাহ (সা:) তখন বলেছিলেন, أَنَا بِقَارِئٍ
‘আমি পড়তে জানি না’। তখন জিবরিল (আ:) তাকে জাপটে ধরেছিলেন। এই একই দৃশ্য তিনবার হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর নিকট সূরা ‘আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাজিল হয়। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে অহির জ্ঞান শিক্ষা দেন। সুতরাং আমাদের সমাজ ও দেশ থেকে অন্যায়, অপকর্ম দূর করতে ইলমের গুরুত্ব অপরিসীম। ইলম অর্জনের নির্দেশনাস্বরূপ রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন,
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ
‘প্রত্যেক মুসলিমের ওপরে জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরজ। (ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮, সনদ হাসান।)
দ্বীনি ইলম অর্জনের প্রতি আল্লাহর উৎসাহ প্রদান :
আল্লাহ জ্ঞানার্জনের প্রতি উৎসাহিত মানুষকে উৎসাহিত করেছেন, কেননা মানুষ ইলম অর্জন করবে, সে অনুযায়ী আমল করবে এবং নিজেদের মাঝে ইলম প্রচার করবে এটাই আল্লাহর দাবি। মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
‘সুতরাং এমন কেন হয় না যে, তাদের প্রত্যেকটি বড় দল হতে এক একটি ছোট দল বের হবে, যাতে তারা দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আর যাতে তারা নিজ কওমকে ভয় প্রদর্শন করতে পারে যখন তারা ওদের নিকট প্রত্যাবর্তন করে, যেন তারা সতর্ক হয়।’ (সূরা তওবা ৯/১২২)
মানুষ অজ্ঞ-মূর্খ হয়ে পৃথিবীতে আসে। আল্লাহ বলেন,
عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ
‘আমি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছি, যা সে জানত না।’ (সূরা আলাক ৯৬/৫) ইলম বা জ্ঞান দ্বারা ভাল-মন্দ নির্ণয় করা যায়। এর দ্বারা অন্যায়ের প্রতিরোধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সুতরাং আল্লাহ যার মঙ্গল চান এবং যার দ্বারা হকের বাস্তবায়ন সম্ভব তাকেই মহামূল্যবান জ্ঞান দান করে থাকেন। যেহেতু জ্ঞানের মালিক আল্লাহ, তাই এই জ্ঞান আল্লাহ যাকে চান তাকে দান করেন। তিনি বলেন,
يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ
‘তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমত দান করেন এবং যাকে হিকমত দান করা হয় তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয় এবং কেবল বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই শিক্ষা গ্রহণ করে।’ (সূরা বাকারাহ ২/২৬৯) এ সম্পর্কে রাসূল (সা:) বলেন,
خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّين مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ
আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন’। (ইবনু মাজাহ হা/২২৩; সহিহুল জামে‘ হা/৬২৯৭, সনদ সহিহ)
‘আলিমগণই নবীদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী : রক্ত সম্পর্ক কিংবা বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে কোন ব্যক্তির ওয়ারিশ হওয়া যায়। কিন্তু ইলম এমন একটি মূল্যবান সম্পদ, যে ব্যক্তি তা অর্জন করবে আল্লাহ তাকে নবীদের ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী বানাবেন। সুতরাং আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক ধারণাসম্পন্ন ব্যক্তিরা মূলত নবীদের উত্তরাধিকারী। আর উত্তরাধিকার জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন,
إِنَّ الْعُلَمَاءَ هُمْ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ إِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلاَ دِرْهَمًا إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ.
‘আলেমরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দিনার বা দিরহামের উত্তরাধিকারী করেন না। বরং তারা ইলমের উত্তরাধিকারী করেন। ফলে যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করল সে বৃহদাংশ গ্রহণ করল। (সহিহুল বুখারী হা/৭১)
আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন।’ (ইবনু মাজাহ হা/২২৩; সহিহুল জামে‘ হা/৬২৯৭, সনদ সহিহ।) অতএব দ্বীনি ইলম অর্জন করলে নবীদের উত্তরাধিকারী হওয়া যায়।
আল্লাহর নিকট উপকারী ইলমের প্রার্থনা করা : আল্লাহর নিকট ইলমসহ যাবতীয় কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহর নিকট চাওয়ার মাধ্যমে ইলম অর্জিত হলে তা দিয়ে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই অর্জন করা সম্ভব। আর যদি না চাওয়াতেই ইলম আসে, তা দিয়ে দুনিয়া সম্ভব আখিরাত কখনই অর্জন করা সম্ভব নয়। আল্লাহ বলেন,
مَنْ يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا
وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ
‘অনেকে বলে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে দান কর। অথচ তার জন্য পরকালের কোন অংশ নেই।’ (সূরা বাকারাহ ২/২০০)
আর এজ্যই নবী-রাসূলগণ একমাত্র আল্লাহর নিকটেই চাইতেন। যেমন ইবরাহিম (আ:) প্রার্থনা করে বলেন,
رَبِّ هَبْ لِي حُكْمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ
‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে প্রজ্ঞা দান কর এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর।’ (শু‘আরা ২৬/৮৩) অনুরূপ মুসা (আ:) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন। আল্লাহ বলেন,
رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي- وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي- وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي- يَفْقَهُوا قَوْلِي
‘হে আমার পালনকর্তা! আমার বক্ষকে প্রশস্ত করে দাও, আমার কাজকে সহজ করে দাও এবং আমার জিহবা থেকে জড়তা দূর করে দাও, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (ত্বহা ২০/২৫-২৮) আর এরই ধারাবাহিকতায় রাসূল (সা:) আল্লাহর নিকট উপকারী ইলমের প্রার্থনা করতেন। হাদিসের ভাষায় রাসূল (সা:) প্রতি ফজর সালাতের পর প্রার্থনা করতেন এই বলে যে,
اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا وَرِزْقًا طَيِّبًا وَعَمَلاً مُتَقَبَّلاً
‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট উপকারী জ্ঞান, কবুলযোগ্য আমল ও পবিত্র রুজি প্রার্থনা করছি।’ (আহমাদ ইবনে মাজাহ, তাবারানি, মিশকাত হা/২৪৯৮) সুতরাং আমাদের সকলেরই উচিত একমাত্র আল্লাহর নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করা।
‘আলিম তথা জ্ঞানীদের করণীয় : জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই করণীয় হলো জানা বিষয়গুলো মানুষের নিকট প্রচার করা। যেমন আল্লাহ তাঁর নবীদের নিকট অহি প্রেরণের পর তা মানুষের নিকট প্রচারের নির্দেশ দেন। আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ
‘হে রাসূল! পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন তবে আপনি তাঁর পয়গাম পৌঁছালেন না।’ (সূরা মায়েদা ৫/৬৭)
এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন,
بَلِّغُوا عَنِّى وَلَوْ آيَةً
‘আমার পক্ষ হতে মানুষের নিকটে পৌঁছে দাও, যদি একটি আয়াতও হয়’। (বুখারী হা/৩৪৬১; তিরমিজি হা/২৬৬৯)
পক্ষান্তরে আলিমগণ দ্বীন প্রচারে অবহেলা করলে কিংবা বিরত থাকলে তাদের অবস্থা হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। হাদিসে এসেছে,
عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمِ يُجَاءُ بِالرَّجُلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيُلْقَى فِى النَّارِ فَتَنْدَلِقُ بِهِ أَقْتَابُهُ فَيَدُورُ بِهَا فِى النَّارِ كَمَا يَدُورُ الْحِمَارُ بِرَحَاهُ فَيُطِيفُ بِهِ أَهْلُ النَّارِ فَيَقُولُونَ يَا فُلاَنُ مَا لَكَ مَا أَصَابَكَ أَلَمْ تَكُنْ تَأْمُرُنَا بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَانَا عَنِ الْمُنْكَرِ فَقَالَ كُنْتُ آمُرُكُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَلاَ آتِيهِ وَأَنْهَاكُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَآتِيهِ.
ওসামা ইবনু যায়েদ (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, এক ব্যক্তিকে ক্বিয়ামতের দিন নিয়ে আসা হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এতে করে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাবে। আর সে তা নিয়ে ঘুরতে থাকবে যেমনভাবে গাধা আটা পিষা জাঁতার সাথে ঘুরতে থাকে। জাহান্নামিরা তার নিকট একত্রিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করবে, আপনি কি আমাদের ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করতেন না? সে বলবে, হ্যাঁ। আমি তোমাদের ভালো কাজের আদেশ করতাম, কিন্তু নিজে করতাম না। আর খারাপ কাজের নিষেধ করতাম কিন্তু নিজেই তা করতাম। (সহিহুল বুখারী হা/৩২৬৭; মিশকাত হা/৫১৩৯)
অতএব আমলবিহীন ইলম কিয়ামতের দিন বড় শাস্তির কারণ হবে। আরবি প্রবাদে রয়েছে,
رجل بلا عمل كشجرة بلا ثمر
‘আমলবিহীন ব্যক্তি ফলবিহীন বৃক্ষের ন্যায়’। জনৈক আরব কবি বলেন,
لو كان للعلم شرف من دون التقي* لكان أشرف خلق الله إبليس
‘যদি তাক্বওয়াবিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত, তবে ইবলিস আল্লাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হতো। (নবীদের কাহিনী, ১/১৩ পৃ:)
প্রকৃত ‘ইলম তথা জ্ঞানের সফলতা : গোটা বিশ্ব আজ অশান্তিতে ভরপুর। এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র হাতিয়ার হলো প্রকৃত ইলম অর্জন তথা সুশিক্ষা। কেননা সুশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে দুনিয়াতে যেমন মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে ও সমাজে শান্তি আসবে, তেমনি আখেরাতের পাথেয় অর্জনের পথ সুগম হবে। মৃত্যুর পর মানুষের আমল বন্ধ হয়ে যায় অথচ দ্বীনি ইলম অর্জন করে শিক্ষা দিলে তা কবরে পৌঁছানোর অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন,
إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
‘যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি আমল ব্যতীত। এই তিনটি আমল হলো, প্রবহমান ছাদাকা, এমন ইলম যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং এমন সুসন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম হা/১৬৩১)
হাদিসের শিক্ষা :
১. ‘ইলম (জ্ঞান) অর্জন করার সম্মান ও মর্যাদা অত্যধিক।
২. ‘ইলম (জ্ঞান) অর্জনের উদ্দেশ্যে যে পথ চলবে আল্লাহ তার জান্নাতের পথ সুগম ও সহজ করে দেবেন।
৩. ‘ইলম অনুযায়ী আমল তথা কাজ হতে হবে।
৪. ‘ইলম প্রচার করতে হবে।
লেখক : ড.মোস্তাফিজুর রহমান, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ
দারসুল হাদীস-৮
“হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, তোমাদের সামনে যখন ইসলামবিরোধী কাজ হতে দেখবে তখন হাত দিয়ে প্রতিরোধ করবে। যদি এতে অক্ষম হও তবে মুখ দিয়ে প্রতিবাদ জানাবে। যদি তাতে অক্ষম হও তবে অন্তর দিয়ে তাকে ঘৃণা করবে, তবে এটি দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক।” (সহীহ মুসলিম)
হাদিসের সূত্র
হাদিসটি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হিসেবে ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাত আল-কুশাইরী আন নিশাপুরী তার ইতিহাস বিখ্যাত সহীহ মুসলিম শরীফে গ্রহণ করেছেন। হাদিসটি মরফু ও মুত্তাসিল সনদে বর্ণিত। মুসলিম দুনিয়া যে ছয়খানা হাদিসের কিতাবকে বিশুদ্ধ বলেছে, তার মধ্যে বুখারী শরীফের পরই যে কিতাবকে বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে সফলভাবে উত্তীর্ণ তা সহীহ মুসলিম শরীফ। ইমাম মুসলিম (রহ) দীর্ঘ ১৫ বছর অবিশ্রান্ত সাধনা করে বাছাইয়ের পর বাছাই করে সরাসরি উস্তাদদের নিকট হতে শ্রত তিন লক্ষ হাদিস থেকে বাছাই করে তাকরার সহ বার হাজার আর তাকরার বাদে চার হাজার হাদিস এ মহান কিতাবে সন্নিবেশিত করেছেন। মুসলিম শরীফ রচনায় তিনি অত্যন্ত সতর্কতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। প্রত্যেকটি হাদিসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সমসাময়িক মুহাদ্দিসদের সাথে পরামর্শ করেন ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সহীহ মুসলিম সঙ্কলন করেন। এ কিতাবের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ইমাম মুসলিম নিজেই বলেছেন- কেবল আমার বিবেচনায় সহীহ হাদিসসমূহ আমি এ কিতাবে শামিল করি নাই বরং যে সকল হাদিস এ কিতাবে সন্নিবেশিত করেছি তার বিশুদ্ধতার ব্যাপারে যুগের মুহাদ্দিসগণের ইজমাহ হয়েছে।
সাহেবুল হাদিস
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) নবীজির (সা) প্রসিদ্ধ সাহাবীদের একজন। তাঁর পিতা মালিক ইবনে সিনান ও মাতা আনিসা বিনতে আবিল হারিছ হিযরতের আগে ইসলামে দাখিল হন। আর হিযরতের ১০ বছর আগে আবু সাঈদ ‘খুদরী’ নামে পরিচিত ছিলেন বিধায় তার নামের সাথে সংযুক্ত হয়েছে খুদরী। রাসূল (সা) হিযরতের পর মদিনার মসজিদ নির্মাণে তিনি অংশ নেন। বয়স কম থাকায় তিনি বদর ও ওহুদ যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। পরে আহযাব, হুদায়বিয়া, খায়বর, হুনায়ন, তাবুক ও মক্কা বিজয় অভিযানসহ ১২টি গাযওয়ায় তিনি অংশ নিয়েছিলেন। তিনি হযরত উমর (রা)-এর সময় মদিনার মুফতির পদে নিযুক্ত হন। তিনি সাহাবীদের যুগে অন্যতম একজন ফকীহ্ ছিলেন। তিনি হাদিস বর্ণনাকারীদর মধ্যেও একজন। তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ১ হাজার ১৭০টি। তিনি সাদাসিধা জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। আর সুন্নাতে রাসূলের কঠোর অনুসারী ছিলেন। ৮৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। জান্নাতুল বাকীর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
হাদিসের ব্যাখ্যা
হাদিসখানার মূল বিষয় হলো ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ প্রসঙ্গে। এই বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার, ইসলাম ছাড়া তথা অহির সমর্থন ছাড়া যা কিছু সব অগ্রহণযোগ্য। আল্লাহর নিকট ইসলামই একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন। মুমিনেরা ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু মানবে না মানতে পারে না। নবীদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মানবরচিত আদর্শের ওপর আল্লাহতায়ালার নাজিলকৃত দ্বীনে হক্ক তথা ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার। হাদিসের আলোচনায় আমরা সরাসরি যেতে চাই।
“তোমরা যখন তোমাদের সামনে কোন ‘মুনকার’ অর্থাৎ ইসলাম অনুমোদন করে না এমন কিছু সংঘটিত হতে দেখবে সাথে সাথে একে পরিবর্তন করার জন্য তোমাদের হাতের শক্তি প্রয়োগ করবে।” অন্যায়কে দেখার পর চুপ থাকা, কোন প্রকার অজুহাত পেশ করে তার সাথে আপস করা ঈমানের দাবি নয়। ব্যক্তিগত জীবনে যতটুকু সম্ভব ইসলামী আচরণ নিজে পালন করাকে মুসলমানেরা আজ যথেষ্ট মনে করছে। ধর্মনিরপেক্ষবাদীরাও অপরের কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা, কারো সভ্য বা অসভ্য আচরণ বা কর্তব্যকে ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা স্বাধীন মতপ্রকাশে হস্তক্ষেপ বলে এড়িয়ে যাওয়াকে আজকের গণতান্ত্রিক সভ্যতা মনে করা হচ্ছে। ইসলামের বক্তব্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলাম জীবনের প্রতিটি বিষয়ে সত্য ও অসত্য, ন্যায় ও অন্যায়, বৈধ ও অবৈধতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছে। যা কোন মানুষের পক্ষে অথবা মানবগোষ্ঠীর পক্ষে অসম্ভব বিষয় যে তাদের জ্ঞান, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা দিয়ে সত্য ও মিথ্যার বিধান দেবে। এ বিষয়ে আল্লামা মওদূদী (র) এর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। ‘মানুষ তার জীবনের প্রতিটি বিষয়ে আল্লাহতায়ালার হেদায়েতের মুহতাজ।’ আদম (আ)কে পৃথিবীতে প্রেরণ করে আল্লাহতায়ালা বলে দিলেন আমার পক্ষ থেকে হেদায়েতের বিধান অবতীর্ণ হবে, তুমি শুধু তাকে অনুসরণ করবে তাহলে তোমার চিন্তার কারণ থাকবে না। কুরআন বলছে-
“আমার পক্ষ হতে তোমাদের জন্য হেদায়েতের বিধান অবতীর্ণ হবে, যারা এ পথনির্দেশ অনুসরণ করবে তাদের জন্য ভয়ভীতির কোনো বিষয় নেই, চিন্তারও কোনো কারণ নেই।” (সূরা বাকারা : ৩৮)
সুতরাং এ কথা নিশ্চিত যে মানুষ বা মানুষের পার্লামেন্ট মানুষের জন্য হিদায়াত বা পথনির্দেশ বা ভালো ও মন্দের বিধান রচনা করতে পারবে না। অন্তত যারা বিশ্বাসী বলে দাবি করে তাদের জন্য আল্লাহর অবতীর্ণ হেদায়েতে যা হারাম তা পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত হারাম থাকবে, এ ঈমানত অপিরহার্য। সে মোতাবেক খোদার বিধানে যা অবৈধ বা হারাম তাকে পরিবর্তন করে ন্যায়ের বিধান প্রতিষ্ঠা করা সকল মুমিনের ঈমানের দাবি। আবার ইসলামের মূল আকিদা বিশ্বাস, আল্লাহ, রাসূল (সা) বা কুরআনের অসম্মান ও পবিত্রতার ওপর যে কেউ আঘাত করবে এর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ উম্মাহর বিশ্বাসের অনিবার্য দাবি। কেউ যদি তাকে কারো বাকস্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে এড়িয়ে যেতে চায় আমরা তাদেরকেও অপরাধীদের খাতায় লিপিবদ্ধ করবো। হাদিসের মর্মানুসারে মুসলমানেরা হাত দিয়ে বাধা দেবে অর্থাৎ প্রয়োজনে যুদ্ধ ঘোষণা করবে।
“যদি হাত দিয়ে প্রতিরোধ করতে অক্ষম হও তবে জবান দিয়ে প্রতিবাদ জানাবে।”
অর্থাৎ অন্যায়কারীদের অবস্থান, তাদের শক্তি ও ক্ষমতার প্রতাপ যদি এমন হয় যে হাত দিয়ে প্রতিরোধ সম্ভব নয় তবে হাদিস বলছে প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে তবে হাতের জায়গায় মুখ দিয়ে। ঈমান কোন অবস্থায় আপস করে না। শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ সম্ভব না হলে মুমিনদেরকে প্রতিবাদ সভা, পোস্টার, লিফলেট ও পুস্তক লিখে প্রতিবাদ করতে হবে। অন্যায় ও অসত্যকে মেনে নেয়ার কোনো অজুহাত ইসলামে স্বীকৃত নয়, তবে কুরআন বলছেন- সাধ্যের বাইরে কোন বিষয়ে দায়িত্ব নেই। সূরা বাকারার ২৮৬ নম্বর আয়াতে রয়েছে
“আল্লাহ কারো ওপর সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা দেন না।” যদি জালেমদের অবস্থান এতই শক্তিশালী হয় যে প্রতিবাদের কোনো আওয়াজ তোলা যায় না তবে সেখানে যতটুকু সম্ভব সাধ্যের মধ্যে থেকে প্রতিবাদ জানাতে হবে।
“যদি জবান দিয়ে প্রতিবাদে অক্ষম তবে অন্তর দিয়ে প্রতিবাদ করবে অর্থাৎ অন্যায় ও খোদাদ্রোহিতাকে কোন অবস্থায় মেনে নেয়া যাবে না। অন্তত মনে মনে তাকে ঘৃণার সাথে দেখতে হবে। সন্তুষ্টচিত্তে পাপাচারকে মেনে নেয়া কোন অবস্থায় বৈধ হতে পারে না। শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা নেই আবার প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ যদি জালেম শক্তি মেনে না নেয় তবে কিছু করতে না পারার অসহ্য কষ্ট নিয়ে অন্যায় ও অসত্যকে হৃদয় দিয়ে চুপিসারে গ্রহণ করা ইসলামে স্বীকৃত নয়। অন্তত সর্বশেষ মনের মধ্যে প্রচণ্ড ঘৃণা দিয়ে প্রতিবাদ জানাবে। তবে চোখে, মুখে বিরক্তির ও নীরব প্রতিবাদের ভাষা অন্যরা লক্ষ্য করবে। এ অবস্থার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত মুমিন স্বাভাবিক হতে পারে না, স্বাস্থ্যের নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না। ব্যথায় তার অন্তরের চাপ বেড়ে যায়। নবীজি (সা) অন্তরের প্রতিবাদকে দুর্বল ঈমানের পরিচয় বলেছেন। হাত দিয়ে শক্তভাবে বাধা দেয়া আর কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ সবল ঈমানের অস্তিত্ব বুঝিয়ে দেয়। মুমিনগণ তৃতীয় ও দুর্বল অবস্থায় নয় বরং ভালো অবস্থায় ঈমানের ওপর থাকার প্রচেষ্টা নিরন্তর চালাতে হবে। তৃতীয় অবস্থান হচ্ছে ঈমান অসুস্থ ও মরণের রোগে আক্রান্ত।
হাদিসের শিক্ষা
১. ঈমানের অস্তিত্ব জিহাদের মধ্যে। যেখানে জিহাদ নেই সেখানে ঈমান নেই।
২. ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি রয়েছে। আর কুরআন তিলাওয়াত ঈমানের মধ্যে প্রচণ্ড শক্তি সঞ্চার করে।
৩. ঈমান কোন অপরাধ বা অন্যায়কে মেনে নেবে না। বরং পাপাচারকে বিলুপ্ত করার জন্য সাধ্যানুসারে লড়াই করবে।
৪. ঈমানকে শক্তিশালী ও মজবুত করতে অব্যাহতভাবে চেষ্টা ও সক্রিয় থাকতে হবে।
৫. নিফাক হচ্ছে ঈমানের কঠিন রোগ, সন্দেহ ও রাইবুন থেকে ঈমানকে দূরে রাখতে হবে।
উপসংহার
যে একটি বিষয় মুসলমানদেরকে সারা দুনিয়ায় একদিন বিজয়ী করেছিল, যে বিষয়টির সাথে জান্নাত ও জাহান্নামের ফায়সালা নিহিত, মুসলিম উম্মাহর আজকের বিপর্যয় যার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত তা হচ্ছে শক্তিতে ছিল বলীয়ান। বিশ্বাস তাদের কলিজায় এইভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল যেমন পাহাড় জমিনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। দুনিয়ার কোন আনন্দ বা কঠিন বেদনা তাদের ঈমানের ওপর কোন আছর সৃষ্টি করেনি। ভালো-মন্দ, কল্যাণ ও অকল্যাণের একমাত্র মালিক যে আল্লাহ তায়ালা এ দৃঢ় আস্থা এতটুকু তাদের হৃদয়ে শিকড় গেড়েছিল যে, জ্বলন্ত লাল কয়লার ওপর শুইয়ে রেখে বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়েছেন, হযরত বিলাল সে সময় আহাদুন আহাদুন বলছিলেন। মাথার ওপর করাত রেখে ঈমান ত্যাগ করতে বলা হয়েছে, তাদের দেহ দ্বিখণ্ডিত হয়েছে কিন্তু তাদের থেকে ঈমানকে বের করা যায়নি। তাওহিদ ও রিসালাত মুহাম্মদীর ওপর তাদের বিশ্বাস এত কঠিন ছিল যে সারা দুনিয়ার সম্মিলিত শক্তি যেন আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘনে তাদের ওপর কোন প্রভাব রাখতে পারেনি। খোদার বিধানের সামনে দুনিয়ার চলমান সভ্যতাকে তারা জাহেলিয়াত কাদেসিয়ার মাঠে দাঁড়িয়েছিল বিশ্ব বিখ্যাত বীর রুস্তমের নেতৃত্বে আর মুসলিম বাহিনী কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়ালো অশ্বারোহী পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল লাখ লাখ ইরানী বাহিনীকে। রুস্তম নিহত হলে অগণিত লাশ মাঠে রেখে তারা রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। কাদেসিয়ার বিজয়ের সংবাদ যখন মদিনায় পৌঁছল আমিরুল মুমেনিন হযরত উমর (রা) সিজদায় পড়ে এমনভাবে কাঁদতে ছিলেন যেন তাঁর কান্না থামছিল না। কাদেসিয়ার ঐতিহাসিক বিজয়ের পর সাদের বাহিনী সামনে রাওয়ানা হলো ইরানী সাম্রাজ্যের রাজধানী মাদায়েনের দিকে। তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ দজলা পার হয়ে যেতে হবে কিন্তু ইরানীরা সমস্ত পুল, সাঁকো ও কালভার্ট ধ্বংস করে দিয়েছিল মুসলিম বাহিনীর অগ্রযাত্রা রোধে, তারা জ্বালিয়ে দিয়েছিল সমস্ত জলযান। দজলার পারে এসে থমকে দাঁড়ালেন মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি আশারায়ে মুবাশ্বেরার অন্যতম সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা)। তিনি আল্লাহু আকবর বলে দজলার তরঙ্গের ওপর ঝাঁপ দিলেন আর তাকে অনুসরণ করে হাজার হাজার অশ্বারোহী এইভাবে দজলার ওপর দিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে চললেন যেন তারা স্থলভাগের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলেন। যে দৃশ্য চোখে দেখে ইরানীরা চিৎকার করে বলেছিল, পালাও। দরিয়ার ওপর দিয়ে রমেয় সম্পদ, সোনা, চাঁদি রেখে শ্বেতপাথর নির্মিত হোয়াইট হাউজ নামক রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো ইতিহাসের কাছে এ বিজয়ের ব্যাখ্যা কী? যা ঘটেছিল প্রকাশ্য দিবালোকে আর অগণিত বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের উপস্থিতিতে। আমরা জানি ঈমানের দৃষ্টিকোণ ছাড়া বস্তুবাদী ও কুফরি চিন্তা চেতনার কাছে এর ব্যাখ্যা নেই। এর রহস্য উন্মোচন অসম্ভব, কেউ বুঝুক আর না বুঝুক তাই ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা। আজকের দুর্বল ঈমানের অধিকারী মুসলমানদেরকে সে বিশ্বাসের অপরিমেয় শক্তির নিকট ফিরে যেতে হবে। আবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে। মুনাফিকী আর কাপুরুষতার খোলস দূরে বহু দূরে নিক্ষেপ করতে হবে। পরাশক্তির ভয়াল অস্ত্র আর হুমকি মুমিনদের নিকট কাগজের বাঘ যা দেখতে ভয়ঙ্কর কিন্তু ঈমানের প্রচণ্ড আঘাতে তা চুরমার হয়ে যেতে বাধ্য। কুরআন বলছে, তোমরা জাহেলিয়াতের ওপর আঘাত কর, তাদের ঈমান দুর্বল। ঈমান কুফুরির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংঘাতে জড়িয়ে যেতে বাধ্য আর মুমিনেরা চির সংগ্রামী। একটি নির্ঝঞ্ঝাট জামেলাবিহীন, নিরিবিলি জীবন- খাও, দাও আর বংশ বিস্তার কর এই পশুর জিন্দেগি কোন মুমিন গ্রহণ করতে পারে না।
“শুধু অর্থ সম্পদ জমা করে আর গণনা করে আর ধারণা করে এ সম্পদগুলোকে অমর করে রাখবে।” (সূরা হুমাজাহ : ৩-৪)
কারুন আর ফেরাউনের জীবনকে যারা গ্রহণ করেছে তারাই শুধু সম্পদ আর প্রাচুর্যকে জীবনের লক্ষ্য বানাতে পারে। মুমিনদের সামনে সে আবু – বকরের জিন্দেগি আদর্শ যিনি রাসূলের (সা) সামনে সমস্ত সহায় সম্পদ এমনকি রান্নার পাতিল পর্যন্ত হাজির করে দিয়েছিলেন তাবুকের যুদ্ধে। ‘পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ’ রাসূলের (সা) এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি। সুবহান আল্লাহ! পৃথিবী কি আর একটি আবু বকর কোন দিন খুঁজে পাবে? আজকের সমাজের দায়িত্বশীল, কর্তাব্যক্তি ও অপরিমেয় সম্পদ ও প্রাচুর্যের মালিক হয়েও ব্যস্ত রয়েছে যারা লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হত্যা, গুম ও খুন এর ন্যায় ভয়াল অপকর্মে। এদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জেদ, সম্পদের পর্বত, সৃষ্টির লিপ্সা ও দুর্নীতির ভয়াল থাবায় কোটি কোটি মানুষ নির্যাতিত মজলুম। কোন মুমিনের ঈমান যদি দুর্বল ও নিঃশেষ হয়ে না যায় তবে জালেম, শোষক, দুর্নীতিবাজ, মিথ্যাবাদী ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শুরু করতে হবে ক্ষমাহীন লড়াই। কুরআন বলছে-
“তোমরা শয়তানের চেলাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হও। শয়তানদের যাবতীয় চক্রান্ত দুর্বল।” (সূরা নিসা : ৭৬)
লেখক : অধ্যাপক মফিজুর রহমান,বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ
দারসুল হাদীস-৯
হজরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম (সা) ইরশাদ করেছেন : দুনিয়া ঈমানদারের বন্দিশালা এবং কাফিরের জান্নাত (সহীহ আল মুসলিম)
বর্ণনাকারীর পরিচয়
হজরত আবু হুরাইরা (রা) হলেন সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী। আবু হুরাইরা তার উপাধি। ইসলাম গ্রহণের আগে তার নাম ছিল ‘আবদে শামস’ বা আবদে ওমর। রাসূলে আকরাম (সা) সে নাম পরিবর্তন করে ‘আব্দুর রহমান’ রাখেন। ইসলাম গ্রহণের পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো তিনি নবী (সা) এর সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। সর্বদা মসজিদে নববিতে পড়ে থাকতেন। তিনি ছিলেন আসহাবে সুফফাদের অন্যতম একজন। তিনি সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী হওয়ায় অনেকে তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। তাই তিনি বলেন, ‘তোমরা হয়তো মনে করছো আমি খুব বেশি হাদিস বর্ণনা করি। আমি ছিলাম হতদরিদ্র। পেটে পাথর বেঁধে সর্বদা রাসূলে আকরাম (সা) এর সাহচর্যে কাটাতাম। আর মুহাজিররা ব্যস্ত থাকতো ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে আর আনসারগণ ব্যস্ত থাকতো ধনসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে।’
হজরত আবু হুরাইরা (রা) ছিলেন জ্ঞানের সাগর। মহানবী (সা) নিজেই বলেছেন : ‘আবু হুরাইরা জ্ঞানের আধার।’ (বুখারী) হাদিসের এই জীবন্ত উজ্জ্বল নক্ষত্র হিজরি ৫৯ সনে ৭৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা মোট ৫ হাজার ৩৭৪টি।
হাদিসটির গুরুত্ব
মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা। দুনিয়া মানুষের কর্মক্ষেত্র। এখানে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক জীবন পরিচলনা করতে হবে। যাদের জীবন আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক হবে, তারাই মুমিনের মর্যাদা লাভ করবেন। আর যারা ইচ্ছেমতো আল্লাহর নির্দেশের সীমা অতিক্রম করে জীবন পরিচালনা করবে তারাই কাফির। সে জীবনদর্শনের দিকে ইঙ্গিত করেই এ হাদিসের বক্তব্য। প্রকৃতপক্ষে একজন মুমিন ও কাফিরের জীবনের স্বরূপ উন্মোচন করা হয়েছে উল্লিখিত হাদিসটিতে।
ব্যাখ্যা
বন্দিশালায় কোন কয়েদি পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। বন্দিজীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কর্তৃপক্ষের আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ আইন লঙ্ঘন করার অধিকার কোন বন্দীর নেই। যখন যে আদেশ তাকে দেয়া হয় সে আদেশ মানতে সে বাধ্য। বন্দী কখনো এ কথা বলতে পারে না যে, আমি এ আদেশ মানবো, অমুক আদেশ মানবো না। দুনিয়ার জীবনও মুমিনের জন্য বন্দিশালার মতো। কারণ এখানে সে পূর্ণ স্বাধীন নয়। মন যা চায় তা সে করতে পারে না। দুনিয়ার প্রেমে প্রেমাসক্ত হয়ে মুমিন আল্লাহর হুকুমের বিপরীত কোন হুকুম পালন করতে পারে না।
অপর দিকে জান্নাতের বৈশিষ্ট্য হলো সেখানে কোন কাজ ও তৎপরতা নিয়ন্ত্রিত নয়। ইচ্ছেমতো জীবন যাপন করতে পারবে। জান্নাতিদের কোন ইচ্ছে অপূর্ণ থাকবে না। সর্বত্র সুখ আর সুখ। জান্নাতের আরাম আয়েশ ছেড়ে জান্নাতিগণ কখনো বাইরে যেতে চাইবে না। কোটি কোটি বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও কোন জান্নাতবাসী হাঁফিয়ে উঠবে না।
যদিও পৃথিবী কখনো জান্নাতের সাথে তুলনীয় হতে পারে না। তবুও পৃথিবীকে কাফিরদের জান্নাত বলার অর্থ হচ্ছে কাফিররা দুনিয়াকে জান্নাত মনে করে। তারা তাদের জীবনকে আল্লাহপ্রদত্ত সীমার বাইরে থেকে ভোগ করতে চায়। তারা দুনিয়ার জীবনকে উপভোগ করার জন্য সম্ভাব্য সকল পথ অবলম্বন করে থাকে। প্রবৃত্তির হুকুম ও চাহিদা অনুযায়ী জীবন যাপন করে। তারা আখিরাতে বিশ্বাসী না হওয়ার কারণে দুনিয়ার জীবনকে সুন্দর ও উপভোগ্য করার জন্য জীবনপাত করে। অথচ একদিন তাকে এ সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে খালি হাতে মুসাফিরের মতো বিদায় নিয়ে চলে যেতে হবে। বন্দীগণ যেমন বন্দিশালাকে নিজের গৃহ মনে করে না, নিজ গৃহে ফেরার জন্য সর্বদা ব্যাকুল থাকে। তেমনি মুমিনগণ পৃথিবীকে আবাসস্থল মনে করে না। তাই দুনিয়ার জীবনে আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসের মোহ তার থাকে না। বরং তার মন চির সুখের জান্নাতে যেতে ব্যাকুল থাকে। এ জন্য সে তা লাভ করার জন্য কঠিন প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকে এবং সকল বিপদ আপদ দুঃখ-কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করে নেয়। আল্লাহ বলেন, ‘‘বস্তুত আমরা মানুষকে কঠোর কষ্ট ও শ্রমের মধ্যে সৃষ্টি করেছি।” (সুরা বালাদ : ৮)
সুতরাং এ দুনিয়া মানুষের জন্য আরাম আয়েশের জায়গা নয় বরং কঠোর শ্রম ও কষ্টের জায়গা। পৃথিবীর সকল সুখ, আরাম আয়েশ একত্র করলেও আখিরাতের তুলনায় খুবই নগণ্য। রাসূলে আকরাম (সা) বলেন :
আল্লাহর কসম! আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার দৃষ্টান্ত হলো তোমাদের কোন ব্যক্তি সমুদ্রের মধ্যে তার আঙুল ডুবিয়ে দেখল যে, তাতে কত পানি লেগে এসেছে। (মুসলিম)
অন্য হাদিসে আছে যে, গোটা পৃথিবীর মূল্যও আল্লাহর নিকট মাছির পালকের তুল্য নয়। তাই এই নগণ্য বস্তুর পেছনে যারা ব্যস্ত থাকে তারা বোকা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যদি পরকালের অনন্ত সুখ-সম্ভার চির-বসন্ত বিরাজিত জান্নাত কেউ পেতে চায় তবে তাকে কঠোর পরিশ্রমের পথই বেছে নিতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
শিক্ষাবলি
১. দুনিয়ার সুখ আসল ও চিরস্থায়ী নয়।
২. পৃথিবী মানুষের স্থায়ী নিবাস নয় সাময়িক পরীক্ষাকেন্দ্র মাত্র।
৩. পরকালের বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের কারণেই মানুষের কৃতকর্মে দুটো ধারার সৃষ্টি হয়। ইতিবাচক ও অপরটি নেতিবাচক।
৪. ইতিবাচক পথের শেষ মানজিল জান্নাত এবং নেতিবাচক পথের শেষ মানজিল জাহান্নাম।
তথ্যসূত্র :
১. সহীহ আল মুসলিম।
২. মিশকাতুল মাসাবিহ।
৩. মা’আরিফুল কুরআন : মুফতি মুহাম্মাদ শফী
দারসুল হাদীস-১০
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা:) নবী করীম (সা:) থেকে বর্ণনা করেছেন, কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদম ও স্ব স্থান হতে নড়তে দেওয়া হবে না। ১) তার জীবন কাল কি ভাবে অতিবাহিত করেছে, ২) যৌবনের সময়টা কিভাবে ব্যয় করেছে, ৩) ধন সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে, ৪) তা কিভাবে ব্যয় করেছে, ৫) সে দ্বীনের যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে সেই অনুযায়ী আমল করেছে কিনা।
রাবির পরিচয়ঃ-
ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক অবস্থায় যে কয়জন মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা:) ছিলেন তাদের একজন। তিনি আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন এবং নবীকরিম (সা:) এর মদিনায় হিজরতের পর মদিনায় চলে আসেন। তিনি সর্বদা রাসূল (সা:) এর খেদমতে নিয়োজিত থাকতেন, এবং ছায়ার মত তাকে অনুসরণ করতেন। হযরত আবু মুসা আশরারী বলেন, “আমরা ইয়েমেন থেকে এসে বহুদিন পর্যন্ত ইবনে মাসুদ (রা:) কে নবী পরিবারের লোক বলে মনে করতাম।”
হযরত আব্দুল্লাহর ইবনে মাসুদ (রা:) একজন বিজ্ঞ আলেম ছিলেন। তিনি কোরআন, হাদিস, ইত্যাদি সব বিষয়েই সমান পারদর্শী ছিলেন। মদিনার যে কয়জন সাহাবী ফতোয়া দিতেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম, কোরআন শিক্ষায় তিনি বিশেষ পারদর্শী। নবী করিম (সা:) বলেন: “কুরআন শরীফ যে ভাবে নাজিল হয়েছে হুবহু সে ভাবে যদি কেহ পড়তে চায় সে যেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদের কাছে যায়।”
এই জ্ঞানের বিশাল মহিরুহ হিজরী ৩২ সালে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ৮৪৮ টি। ইমাম বুখারী ও মুসলিমের ঐক্যমতের হাদিস ৬৪টি, তাছাড়া বুখারী ২৬৪টি এবং মুসলিম ৩৫টি হাদিস বর্ণনা করেছেন।
হাদিসের গুরুত্বঃ-
আলোচ্য হাদিসে মানুষের নৈতিক চরিত্র সংশোধন কল্পে আখিরাতের জবাব দিহির অনুভূতি জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে খোদাভীতি ও পরকালের জবাবদিহি অনুভূতি জাগ্রত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নৈতিক চরিত্র সংশোধনের আশা করা বৃথা, কারণ আমাদের এ জীবনের পর অনন্ত কালের এক জীবন আছে এবং সে জীবনের সাফল্য এবং ব্যর্থতা সম্পুর্ণরুপে নির্ভর করে এ জীবনের কর্ম ফলের উপর; আর প্রতিটি কর্মেরই সুক্ষভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা হবে একমাত্র এই অনুভূতিই মানুষকে মহৎ হতে বাধ্য করে।
তাছাড়া পার্থিব জীবনের আচার আচরণ সম্বন্ধেও ইংগিত প্রদান করা হয়েছে এ হাদিসের মধ্যে। তাই প্রতিটি মুসলমানের জীবনে এ হাদিসটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
ব্যাখ্যাঃ-
১. মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য, যেমন কুরআনে বলা হয়েছে
অর্থ: “আমি মানুষ ও জ্বীনকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য।”
ইবাদত করতে প্রতিটি মানুষ অথবা জ্বীনকে জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর দাসত্ব বা গোলামী করার কথা বলা হয়েছে। কারণ ইয়াবুদুন শব্দটি আবদুন শব্দ হতে নির্গত আর আব্দুন শব্দের অর্থ হলো গোলাম বা দাস। কাজেই দাসত্ব বা গোলামী জীবনের কোন একটি সময় বা মুহুর্ত পর্যন্ত সীমিত নয় বরং সমস্ত জীবন ব্যাপী এ দায়িত্ব।
অন্যত্র বলা হয়েছে
অর্থ: “তোমরা কি মনে করেছ আমরা তোমরাদেরকে অকারনেই সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে কখনই আমার নিকট ফিরে আসতে হবে না। (মুমিনুন-১১৫)
তাই দেখা যায় পৃথিবীর প্রতিটি চাকচিক্য ময় বস্তু মানুষের পরীক্ষার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এ পরীক্ষার সফলতা বা ব্যর্থতার কেন্দ্র করেই শুরু হবে পরকালের জীবন। সত্যি কথা বলতে কি ছোট্র একটি প্রশ্নের উত্তর সমস্ত জীবন ব্যাপী বিস্তৃত।
২. প্রতিটি বস্তুরই একটি উৎকৃষ্ট অংশ থাকে আর জীবনের উৎকৃষ্ট অংশ হচ্ছে যৌবন কাল। নিম্নে চারটি গুণের পরিপূর্ণ সমাবেশ ঘটে এই যৌবনে।
১. চিন্তা শক্তি
২. ইচ্ছা শক্তি
৩. মনন শক্তি
৪. কর্ম শক্তি
অতএব দেখা যাচ্ছে ভাল অথবা মন্দ যে কাজই করা হোকনা কেন যৌবন ই তার প্রধান উদ্যোক্তা। কারন মানুষ চুরি, ডাকাতি, জুলুম, নির্যাতন, অহংকার ইত্যাদি সব কিছুই করে যৌবন কালে দেখা যায়। যৌবনের দুধর্ষ এক লোক বার্ধক্যের কষাঘাতে নেহায়েত গোবেচারায় রুপান্তরিত হয়। কারন বার্ধক্য মানুষকে নিরীহ করে দেয়। তাই বার্ধক্য যেমন অন্যায় অত্যাচারের পথ রুদ্ধ করে দেয় তদ্রুপ যতো সৎ নিয়ত এবং প্রচেষ্টাই থাকে না কেন বার্ধক্য আসার পর কোন একটি ভাল কাজ ও সুচারু রুপে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়, এখানে বার্ধক্য তার প্রধান অন্তরায়। এজন্য যৌবন এত গুরুত্বপূর্ণ।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে
“পাঁচটি বস্তুকে গণিমতের মাল বলে মনে করতে হবে। তার একটি হলো বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনের।” (মিশকাত)
অনেকেই মনে করে যৌবন যা কিছু মনে চায় করে বার্ধক্য আসার পর আল্লাহর নিকট তওবা করে সৎকাজে মনোনিবেশ করবো। এই ধারনাই মানুষকে স্বৈরাচারী করে তোলে। তাই হাদিসে এর প্রতিবাদ করা হয়েছে। এ জন্যই পরকালের প্রশ্নাবলীর মধ্যে যৌবন সংক্রান্ত প্রশ্নটি অন্যতম।
৩. মানুষ পৃথিবীতে ভোগের জন্য সর্বদা পাগল পারা। তার একটা লক্ষ্য ধন সম্পদের স্তুপে সুখের সন্ধান করা। এ জন্য চুরি, ডাকাতি, অপরের সম্পদ হরণ অথবা ধোকাবাজী যা কিছু হোকনা কেন তাতে পরওয়া নেই। আর এভাবে যদি কোন সমাজ চলে তবে সে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। তাই বিশ্ব প্রভু সমাজের ভারসাম্য বজায় রেখে একটি সুখী সমৃদ্ধশীল সমাজ কায়েমের লক্ষে ধন-সম্পদ আয় এবং তার ব্যয়ের মধ্যেও শর্তারোপ করেছেন। যাতে সমাজের কারো কোন অধিকার ভোগ করতে পারে। নিম্নে সম্পদ অর্জনের মৌলিক বিধি নিষেধ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. কারও অধিকার নষ্ট করে সম্পদ অর্জন করা যাবে না। যেমন মিরাসের অংশ না দিয়ে অথবা মহরের প্রাপ্ত টাকা না দিয়ে ভোগ করা এতিমের মাল ভোগ করা ইত্যাদি।
২. ব্যভিচার বা কোন প্রকার দেহ ব্যবসার মাধ্যমে ও সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
৩. চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুন্ঠন, ইত্যাদির মাধ্যমেও জীবিকা বা সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
৪. কাউকে ধোকা দিয়ে বা ঠকিয়ে ধন সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
৫. গান, বাজনা, অভিনয় ইত্যাদিকেও জীবনের পেশা হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না।
৬. হারাম মালের দ্বারা ব্যবসার মাধ্যমে
৭. মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দ্রব্য সামগ্রী ৪০ দিনের অধিক জমা রেখে ঐ মুনাফা লব্ধ টাকার মাধ্যমে।
৮. সুদ অথবা ঘুষের মাধ্যমে সম্পদ আহরন বা বর্ধিত করা যাবে না।
৯. জুয়া, হাউজি, ভাগ্যগণনা, লটারী ইত্যাদির মাধ্যমেও সম্পদ অর্জন করা যাবে না।
১০. ওজনে কম দেওয়া।
উপরের বিধি গুলি সামনে রেখে উপার্জন করতে হবে। ব্যয়ের মৌলিক খাত সমূহ নিম্নে দেওয়া হলো।
১. ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যয় করার অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে কিন্তু শর্তারোপ করা হয়েছে অপচয় না করার।
২. নেছাবের মালিক হলে যাকাত দিতে হবে।
৩. ছাদকা
৪. নিকট আত্মীয়ের হক
৫. ইয়াতিমের হক
৬. মিসকীনের হক, ভিক্ষুকের হক
৭. জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ
৮. বিভিন্ন ধরনের কাফ্ফারা আদায়
৯. পথিক বা পর্যটকের হক।
বস্তুত প্রত্যেকটি বনী আদমকেই প্রশ্ন করা হবে যে উপরোক্ত শর্তাবলীই পালন করেই সে সম্পদ আয় ও ব্যয় করেছে কি না?
৪. বিশ্ব বাসীকে লক্ষ্য করে রাসূল (সা:) এর মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রথম ফরমান-
“পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন।”
এই আয়াতের তাৎপর্য হলো রবকে জানা বা বুঝার উদ্দেশ্য পড়তে হবে, অন্য কথায় দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। মহানবী (সা:) বলেছেন:
“মুসলমান প্রতিটি নরনারীর উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ”
স্রষ্টা-সৃষ্টি ও বিশ্ব জাহান সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই প্রতিটি লোক তার নিজের এবং স্রষ্টার সম্বন্ধে জানতে ও বুঝতে পারে এবং সেই সাথে আরও বুঝতে পারে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক কি আর তার দায়িত্ব ও কর্তব্য কি? এমনিভাবে মানুষ যখন তার স্রষ্টাক জানতে ও বুঝতে পারে তখন স্রষ্টার দেওয়া দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন তার জন্য সহজ হয়ে যায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে ইরশাদ করেন
“আল্লাহ ঈমানদারের বন্ধু। তিনি মানুষকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে পথ দেখান।”
তবে আল্লাহর উপর ঈমান আনতে হবে তাগুতকে অস্বীকার করে। সুরা বাকারার অন্যত্র বলা হয়েছে
“যে তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর পথে ঈমান আনল সে এমন একটি মজবুত রশি ধারণ করল যা কখনও ছিড়বে না।”
দারসুল হাদীস-১১
“হজরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, নবীয়ে কারিম (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও এহতেসাবের সাথে রমজান শরীফে ‘সিয়ামুন্নাহার’ পালন করবে তার অতীত অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমান ও এহতেসাবের সাথে রমজান শরীফে ‘কিয়ামুল্লাইল’ পালন করবে তারও অতীত জীবনের গুনাহসমূহ মার্জনা করে দেয়া হবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি কদরের রজনীতে দণ্ডায়মান থাকবে তারও পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ প্রমার্জন করা হবে।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
ইলমুল হাদিস
যে জ্ঞানের সাহায্যে আমরা রাসূল (সা)-এর কথা, কাজ ও অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারি তাই ইলমুল হাদিস। কুরআনের পরে সকল প্রকার জ্ঞানের মধ্যে ইলমুল হাদিসের বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মুহাদ্দিসগণ নবী কারিম (সা)-এর মত সাহাবীদের কথা ও কাজকে হাদিসের ইলমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এমনকি তাবেয়িদের কর্মকাণ্ড ও রায়কে এর মধ্যে শামিল করা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণের রায় এই যে, নবীয়ে কারিম (সা)-এর কথা ও কাজকে হাদিসে মারফু, সাহাবীদের কথা ও কাজকে হাদিসে মাওকুফ এবং তাবেয়িদের কথা ও আমলকে মাকতু বলা হয়।
হাদিস সঙ্কলন ঃ
হিজরি তৃতীয় শতকের শুরুতে মুসলিম জাহানের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা হাদিসে রাসূল (সা) এর মানিক রতনগুলো সংগ্রহ, যাচাই ও বাছাই এবং সঙ্কলনের এক কঠিন কাজ সম্পাদিত হয়। অনেক মুহাদ্দিস তাদের জীবনকে এ দায়িত্বের জন্য উৎসর্গ করেছেন। তাদের মধ্যে (১) ইমাম আহমদ, (২) ইমাম বুখারী, (৩) ইমাম মুসলিম, (৪) ইমাম তিরমিযী, (৫) ইমাম নাসাঈ, (৬) ইমাম ইবনে মাজাহ, (৭) ইমাম আবু দাউদের নাম উল্লেখযোগ্য। তাদের সকলের মধ্যে যিনি সবচেয়ে হাদিস বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন ও বিশেষজ্ঞ তিনি মুহাম্মদ বিন ইসমাইল বুখারী (রহ)। যাঁর সম্পর্কে তার যোগ্য ছাত্র প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ইমাম মুসলিমের উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন-
“আমার উস্তাদ ইমাম বুখারী (রহ) ছিলেন সমগ্র পৃথিবীর সকল মুহাদ্দিসের নেতা ও উস্তাদতুল্য, তিনি ছিলেন হাদিস রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।”
আলোচিত হাদিসের বিশুদ্ধতা
হাদিস সঙ্কলনের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ যে দু’টি হাদিস গ্রন্থ ‘সহীহুল বুখারী ও মুসলিম শরীফের মধ্যে উক্ত হাদিস গৃহীত হয়েছে। আজকের যুগে সহীহ হাদিস পাওয়া ও চেনা অনেকটা সহজ। কঠিন ও দুর্বহ দায়িত্বটা পালন করেছেন পূর্ববর্তীরা। মুহাদ্দিসদের জানা রয়েছে ইমাম বুখারী (রহ) কোন হাদিসকে সহীহ্ বলার পর তার দিকে সন্দেহের আঙুল উঁচু করা রীতিমত অসাধ্য ব্যাপার। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি (রহ) বুখারী শরীফের বিখ্যাত তাফসির ‘উমদাতুল কারীর’ ভূমিকায় ইমাম বুখারী (রহ) এর উক্তি উল্লখ করে বলেন-
“আমি প্রত্যেকটি হাদিস সম্পর্কে ইস্তেখারার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা থেকে জ্ঞান হাসিল না করে, দুই রাকাত সালাত আদায় না করে ও হাদিসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে একটি হাদিসও এ কিতাবে সংযোজিত করিনি।”
এ মহামূল্যবান কিতাবটিকে তিনি কিয়ামতের কঠিন দিনে মুক্তির দলিল হিসেবে পেশ করে বলেন- “আমি এ কিতাবখানি আমার ও আল্লাহতায়ালার মধ্যে নাজাতের দলিল রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি।”
ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রহ) উভয় মনীষী এ হাদিসখানা মারফু হাদিস হিসেবে ও মুত্তাসিল সনদে সহীহ্ হিসেবে তাদের সহীহ্ হাদিসদ্বয়ে গ্রহণ করেছেন।
সাহেবুল হাদিস ঃ
প্রখ্যাত হাদিস বর্ণনাকারী রাসূলুল্লাহ (সা) এর প্রিয়তম সাহাবীদের অন্যতম হজরত আবু হোরাইরা (রা)। তিনি সপ্তম হিজরিতে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আসেন। তাঁর ইলমের পিপাসা ছিল প্রবল ও অতৃপ্ত। লোহার গুঁড়া যেমন চুম্বকের সাথে লেগে থাকে তেমনি তিনি নবুওয়তের মহা চুম্বকের সাথে লেগে থাকতেন। অন্য সাহাবীরা যেখানে ব্যবসা বাণিজ্য বা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি নিজে বলেন- “আমার মুহাজির ভাইয়েরা ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন আর আমি রাসূলের সাথে লেগেই থাকতাম।” (সহীহ বুখারী)
তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে মায়ের সেবায় নিয়োজিত থাকতেন। জীবিতাবস্থায় মায়ের একাকীত্বের ভয়ে তিনি হজ আদায়ের জন্যও যাননি। তিনি খাইবর, মক্কা বিজয়, হুনাইন ও তাবুকের যুদ্ধে বিশ্বনবীর সাথে ছিলেন। রাসূল (সা) এর ওফাতের পর তিনি হজরত আবু বকর (রা)-এর সাথে জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে ও ভণ্ড নবীদের দমনের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। হযরত উমর (রা) এর যুগে তিনি বাহরাইনের গভর্নর নিযুক্ত হন। দায়িত্ব পালন শেষে যখন ৪ লাখ দিরহাম অর্থ নিয়ে মদিনায় আসেন হজরত উমার (রা)-কে বায়তুলমালের জন্য দেন। হযরত উমার প্রশ্ন করেন, তোমার নিজের জন্য কী এনেছ? তিনি বললেন, ‘‘২০ হাজার দিরহাম।” খলিফা জিজ্ঞেস করেন, কেমন করে এ অর্থ হাসিল করেছ, জবাবে তিনি বলেন ‘ব্যবসার মাধ্যমে।’ আমিরুল মোমেনিন বললেন, “হে আবু হুরাইরা তোমার মূলধন রেখে বাকি সমুদয় সম্পদ বায়তুলমালে জমা দিয়ে দাও।” তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশ নেন ও কঠিন ভূমিকা পালন করেন। হজরত উসমান (রা)-এর শাহাদাতের নির্মম ঘটনায় তিনি এতই মর্মাহত হয়েছেন যে এরপর তিনি নির্জনতা অবলম্বন করেন। তিনি অধিক সংখ্যক হাদিস বর্ণনাকারীদের অন্যতম। তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ৫,৩৭৪টি এর মধ্যে ৩২৫টি বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারীর বর্ণনা মতে হজরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে হাদিস বর্ণনাকারী আটশরও বেশি।
৫৮ হিজরিতে আবু হুরাইরা (রা) কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। বাঁচার আশা নেই, তাঁর চোখে অশ্র, লোকেরা ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “দুনিয়ার মায়া আমার ক্রন্দনের কারণ নয়, আমি কাঁদছি এই জন্য যে আখেরাতের দীর্ঘ সফরে আমার কোন পাথেয় নেই। আমি জানি না জান্নাত ও জাহান্নামের আমি কোথায় থাকব।” ৭৮ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। মদিনার আমির ওয়ালিদ বিন উৎবা হজরত আবু হুরাইরার জানাজার ইমামতি করেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) তার জানাজায় হাজির ছিলেন। জান্নাতুল বাকির কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
হাদিসের ব্যাখ্যা ঃ
হাদিসে রাসূল (সা) এর বিশাল সমুদ্র থেকে আজকে সিয়ামু রমাদানের বিষয়ে হাদিসটি চয়ন করা হয়েছে। এ হাদিসটির মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয়েছে-
১. রমাদান শরীফের দিনে সিয়াম পালন এর ফজিলত
২. রমাদানে তারাবিহ ও সেহেরির জন্য রাত জাগরণের গুরুত্ব
৩. মহা সম্মানিত রজনী ‘লাইলাতুল কদরের’ রাতে ইবাদাতের প্রসঙ্গে। আসুন আমরা এক একটি করে আলোচনায় যাই :
“যারা ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে ‘সিয়াম’ পালন করবে তাদের অতীত জীবনের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।”
‘সিয়ামে রমাদানকে’ ইসলামের ৫টি বুনিয়াদি বিষয়ের একটির মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। যে সিয়ামকে আল্লাহতায়ালা অতীত সব জাতির ওপর ফরজ করেছেন আখেরি রাসূলের আনীত কিতাবেও ফরজ যাতে মানুষ তাকওয়ার গুণে ভূষিত হতে পারে।
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম সাধনাকে ফরজ করা হয়েছে, যা তোমাদের পূর্ববর্তী সকল নবীর শরীয়তে ফরজ করা হয়েছিল যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।” (সূরা বাকারা : ১৮৩)
‘সিয়াম’ শব্দের অর্থ বিরত থাকা। সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন প্রয়োজন পূর্ণ করা থেকে বিরত থাকাই সিয়াম। ‘সিয়াম’ পালন একটি উদ্দেশ্যবিহীন ইবাদাত নহে। বরং তা একটি লক্ষ্যে পৌঁছার মাধ্যম মাত্র। আর লক্ষ্য হচ্ছে তাকওয়ার গুণ অর্জন। নবীজি (সা) বলেন, কিছু সিয়াম পালনকারী এমন রয়েছে যারা অনুভূতিহীন, ক্ষুধার কষ্ট ছাড়া সিয়াম তাদের জীবনে আর কিছুই আনে না। মানবজীবন ধ্বংসের ও বিপর্যয়ের মূল কারণ গুনাহ। জলে-স্থলে যত অশান্তি ও গজবের সুনামি আসছে এর মূল কারণের প্রতি আমাদের আজও দৃষ্টি পৌঁছেনি। তা আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন করা ছাড়া আর কিছু নয়। মানব ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যেসব জাতির আসমানি গজবের ভয়াবহতা আঘাত হেনেছে কওমে নূহ, কওমে আদ, কওমে সামুদ, কওমে ইবরাহিম, কওমে শোয়াইব, কওমে লুত এদের সকল জাতিকে নবীগণ পাপাচার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। সীমালঙ্ঘনকারী জাতিগণ নবীদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে খোদার গজবকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। কিন্তু বিরান হয়ে যাওয়া জনপদের অহঙ্কারী মানুষগুলো বারবার একটি বিষয়কে বুঝেও যেন বুঝেনি। তাদের সম্পদ, প্রাচুর্য, শক্তি, জনবল, হাজার উপায়, উপকরণ ও কলাকৌশল সব কিছু আল্লাহর হুকুমের সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়াবার কোন ক্ষমতাই রাখে না। আল্লাহতায়ালা পাপাচারীদেরকে একটি অবকাশ দেন যেন তারা ফিরে আসতে পারে যেমন ইউনুস (আ) এর জাতি ফিরে এসেছিল। সম্ভবত এটাই একমাত্র ব্যতিক্রম জাতি বলে ইতিহাস সাক্ষ্য প্রদান করে। বাকি জাতিরা তো আল্লাহর শাস্তিকে আহবান করেছিল- “তাদের প্রত্যেককে আমি তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়েছিলাম। তাদের কারও প্রতি পাঠিয়েছিলাম প্রচণ্ড সাইক্লোন, কাকেও আঘাত করেছিলাম কানের পর্দা ছিঁড়ে যাওয়ার মত ভয়াবহ আওয়াজ দিয়ে, আবার কাকেও আমি মাটির মধ্যে গেড়ে ফেলেছিলাম, আবার কাকেও মহাপ্লাবন দিয়ে ডুবিয়েছিলাম। আল্লাহ তাদের প্রতি কোন জুলুম করেননি, বরং তারা নিজেরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল।” (সূরা আনকাবুত : ৪০)
সুপ্রিয় পাঠক! পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার আগে জীবন পাতা থেকে গুনাহের কাল দাগ মুছে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অপরাধের বোঝা নিয়ে পরকালের কঠিন ঘাঁটিগুলো অতিক্রম করা কঠিন হবে। নবী কারিম (সা) বলেন, “সিয়াম পালনে যত্নশীল যারা সিয়ামই আদের জীবন থেকে গুনাহের কালিমা মোচন করবে।”
এক হাদিসে রাসূল (সা) বলেন, ‘সিয়াম’ আমাদেরকে গুনাহ থেকে এভাবে নিষ্পাপ করে দেবে যেমন নবজাতক সন্তানকে তার মা নিষ্পাপ অবস্থায় প্রসব করে। ” (নাসাঈ)
সিয়াম যেন কঠিন এক তাওবাহ যা আমাদের কলুষমুক্ত জীবন গঠনে সাহায্য করে। যারা জীবনের গুনাহের জং তুলে দিতে পারে আর জীবনকে করতে পারে নির্মল ও অমলিন। সে সিয়ামটির দু’টি বৈশিষ্ট্য এ হাদিসে রয়েছে- যারা ঈমান ও এহতেসাবের সাথে সিয়াম পালন করে তাদের সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে। এবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই।
ক. ঈমান : যা সমস্ত নেক আমলের বুনিয়াদ। যা হৃদয়ে না থাকলে কোন ইবাদাত গ্রহণ করা হবে না। নবুওয়তের জীবনে বেশির ভাগ সময় এ ঈমানের জন্য ব্যয় হয়েছে। ইহা নবীগণের দাওয়াতের মূল বিষয়। এই বিশ্বাসকে হৃদয়ে বদ্ধমূল করে নিতে হবে। আর ঈমানকে দৃশ্যমান জগৎ থেকে তুলে গায়েবের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ গায়েব হচ্ছে ইন্দ্রিয় যাকে আয়ত্তে আনতে পারবে না। আর তা আল্লাহ তায়ালা যিনি সকল শক্তির আধার, যিনি কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক। এ ঈমানের সাথে প্রতিনিয়ত সম্পর্ক রেখে সিয়াম পালন করতে হবে। ঈমান ব্যতিরেকে ‘সিয়াম’ পালন মানে সিয়ামের নামে শুধু উপবাস করা, সিয়াম যখন আল্লাহর হুকুম হিসেবে পালিত হবে। যখন তা আল্লাহতায়ালার অলংঘনীয় বিধান হিসেবে ঈমান এনে পালন করা হবে তখনই ‘সিয়াম’ ইবাদতের মধ্যে গণ্য হবে।
খ. ইহতেসাব : ইহতেসাবের সাথে সিয়াম পালনের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ইহতেসাবের অর্থ হিসাব নিকাশ ও আত্মবিশ্লেষণ সহ সিয়াম পালন করা। তার অর্থ অনুভূতিসহ ও হাকিকত উপলব্ধি করে সিয়াম পালন করা। কোন ইবাদাতের মূল উদ্দেশ্য না বুঝে, হাকিকতকে না জেনে পালন নিছক আনুষ্ঠানিকতা বৈ আর কিছু নয়। ‘ইহ্তেসাব’ হচ্ছে সিয়ামের জীবনতুল্য। তাছাড়া সিয়াম পালন একটি নিষ্প্রাণ, অর্থহীন, পানাহার বর্জন করার কসরত। অনুভূতিহীন ও ইহতেসাববিহীন সিয়ামকে ক্ষুধার্ত পিপাসার কষ্ট বলা হয়েছে- “নবীজি (সা) বলেন, এমন কতেক সিয়াম পালনকারী রয়েছে, যারা সিয়ামের নামে শুধু উপবাসের যাতনাই ভোগ করে।”
কী প্রয়োজনে একটি নির্দিষ্ট সময় সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সমস্ত হালাল খাদ্য ও পানিয়কে হারাম করা হলো, নিজ স্ত্রীর সাথে সহঅবস্থান ও মিলনকে বর্জন করা ফরজ করা হলো এর কারণ উপলব্ধিসহ সিয়াম পালনই ইহ্তেসাবের সাথে সিয়াম করা।
আমরা জানি ‘নফস’ সর্বদা আমাদেরকে সীমালংঘন ও গুনাহের প্রতি বাড়াবাড়িতে লিপ্ত করতে চায়। কোন কিছুই যেন নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। নফসের চাহিদা হচ্ছে উৎকৃষ্ট খাদ্য পানীয় ও যৌন মিলন। একটি মাত্র ইবাদাত ‘সিয়াম’ যা নিয়ন্ত্রণহীন এ নফসের মুখে লাগাম কষে দিতে পারে। কারণ নফস শুধু উপবাসের নিকট অসহায় ও আতত্মসমর্পণ করতে পারে। এ অনুভূতিসহ সিয়াম পালন করলে তা অসংখ্য কল্যাণের মুখ খুলে দেবে। ঐ সিয়াম পালনকারীর হায়াতের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেবে আর মৃত্যুর পর পরম সুখের জান্নাতে দাখিল করা হবে।
হাদিসের দ্বিতীয় অংশের ব্যাখ্যায় যেতে চাই- “যারা ঈমান ও ইহ্তেসাবের সাতে রমজানের রাতে জাগরণ করবে তাদেরও জীবনের গুনাহ খাতা মাফ করে দেয়া হবে।” হাদিসের এ অংশে রমজানের রাত জাগরণের ফজিলত আলোচনায় উঠে এসেছে।
এমনিতে রাতের শেষে জাগরণ ও তাহাজ্জুদের বিষয় বিশুদ্ধ হাদিসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছেÑ “প্রতিরাতের শেষাংশে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর নিকটতর আসমান থেকে জমিনের দিকে ঘোষণা দেন, হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের মধ্যে কোন কিছু পার্থক্য করার আছে কি? আমি তোমার আবেদন মঞ্জুর করব।
তোমাদের মধ্যে গুনাহ মাফ চাওয়ার কেউ আছে নাকি? আমি গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেব। আমার নিকট কোন কিছু কেউ আছে নাকি আমি তা তোমাকে দান করব।” (সহীহ বুখারী)
প্রিয় পাঠক! রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত সময় অতি মূল্যবান। যেখানে লাখ লাখ নফল ইবাদাত একত্র করলে একটি ফরজের সমান হবে না কিন্তু রমজান শরীফের একটি নফল ইবাদাত অন্য মাসের একটি ফরজের সমান।
এ মাসের ক্ষুদ্র এবাদত অন্য মাসের পাহাড়ের তুল্য। তাই এ মাসের সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ পবিত্র ও পূণ্যবান মাসের সময় অপচয় হতে দেয়া যাবে না । প্রতিটি মুহূর্ত সময় পরিকল্পিতভাবে ব্যয় করতে হবে। এক ফিরিস্তা প্রতিনিয়ত এ মাসের গুরুত্ব ও ইবাদত বন্দেগিতে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে ঘোষণা দিতে থাকে।
হাদিস শরীফে এসেছে- “হজরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত নবী করিম (সা) বলেন, রমজানের চন্দ্র উদয় হলে আসমান থেকে এক ফেরেস্তা জমিনের দিকে ঘোষণা করে হে নেক আমলের ইচ্ছা পোষণকারী তোমরা উঠ ও কোমর বাঁধ, হে পাপাচারী তোমরা সংযত হও । জাহান্নাম থেকে মুক্তির সময় আসন্ন, পুরা রমজান মাস তা চলতে থাকে।” (তিরমিজি)
প্রিয় পাঠক! এ মাসের দিনে যেমন সিয়াম সাধনায় নিরন্তর ব্যস্ত থাকতে হবে তেমনি রাতকেও ইবাদাতের জন্য জাগ্রত রাখতে হবে। এশারের সালাত আদায় শেষে দীর্ঘ ২০ রাকাত সালাতুত তারাবিহ তাও খতমে কুরআনের সাথে আদায় করতে হবে। অল্প সময়ের নিদ্রা শেষে আবার উঠতে হবে সেহেরি খাওয়ার জন্য এর পর সালাতুত্ তাহাজ্জুদ চলবে ফজর সালাতের পূর্ব পর্যন্ত। এভাবে পুরো রমজানের ৩০টি রাত ইবাদাতের ব্যস্ততায় কাটাতে হবে। প্রতিটি সালাতুল মাকতুবা আদায় করতে হবে জামায়াতের সাথে। নিরন্তর কুরআন তেলাওয়াত ও অধ্যয়নে দিন ও রাত কাটাতে হবে, অপ্রয়োজনীয় ও অপবিত্র কথা বলা থেকে জিহ্বা এবং কাজ করা থেকে স্বীয় অঙ্গকে হিফাজত করতে হবে। মোদ্দাকথা একটি কঠোর রুটিনের মধ্যে রমজানের প্রতিটি দিন ও রাত অতিবাহিত করতে হবে। নবীয়ে কারিম (সা) বলেন, রমজানে যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহ্তেসাবের সাথে রাত জাগরণ করে আল্লাহতায়ালা তার সমগ্র জীবনের গুনাহ মাফ করে দেবেন। তবে ঈমান ও ইহ্তেসাব ব্যতিরেকে এ রাত জাগরণ অর্থহীন। হাদিস শরীফে এসেছে-
“অনুভূতিহীন অনেক রোজাদার রয়েছে তাদের রোজা শুধু ক্ষুধার যাতনা ভোগ করা, আর অনুরূপ এমন কিছু রাত জাগরণকারী আবেদ আছে তাদের রাত জাগরণ বা কিয়ামুল লাইল অনিদ্রার কষ্ট ভোগ করা ছাড়া আর কিছু লাভ হয় না।” (দারামী শরীফ)
হাদিসে রাসূল স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন দিনের সিয়াম বা রাতের কিয়াম ইবাদাত গ্রহণযোগ্য হওয়ার শর্ত ঈমান বা ইহতেসাবের সংযোগ, তা ছাড়া সবকিছু অর্থহীন। ইতঃপূর্বে ঈমান ও ইহ্তেসাব বিষয়ে বিস্তারিত না হলেও মোটামুটি আলোচনা হয়েছে। তাই এখানে পুনরাবৃত্তি থেকে বিরত রইলাম।
হাদিসের তৃতীয় অংশের ব্যাখ্যায় যেতে চাই :
“যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বাদরের পবিত্র রাতে ঈমান ও ইহ্তেসাবের সাথে রাত জাগরণ করবে আল্লাহতায়ালা তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবে।” এই কদরের রজনী অতি পূণ্যবান, মহা পবিত্র একরাত। যে রাতে আল্লাহর আখেরি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এ রাতের বুজুর্গির ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে সূরা অবতীর্ণ হয়েছে।
“নিশ্চয়ই আমি কুরআনকে কদরের রাতে নাজিল করেছি। তোমরা কি জান ক্বদরের রাত কি? তা এক সহস্র মাসের চেয়ে অধিক মর্যাদাবান। (সূরা ক্বাদর : ১-৩)
এ এক রাতের ইবাদত এক সহস্র মাসের নিরস্তর ইবাদাতের সমষ্টির চেয়ে বেশি। কুরআনুল কারীমেও হাদিসে রাসূলের দিকে দৃষ্টিপাত করলে সহজে অনুমেয় হবে এই কদরের মূল্যবান রজনীর চেয়ে অধিক সম্মানিত ও মূল্যবান কোন সময় কালের ইতিহাসে নেই, ছিল না, হবে না। এ রাতের এক মুহূর্ত সময়ের মধ্যে শত শত বছর ঘুমিয়ে রয়েছে। এ রাতের অন্বেষণে রাসূল কারিম (সা) পরিবার পরিজন ছেড়ে দিয়ে মদিনার মসজিদে এতেকাফ করছেন এবং ইবাদাতের কঠোর সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। হাদিস শরীফে এসেছে- “হজরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা) কে রমাদানের শেষ ১০ দিন-রাত কঠোর ইবাদাতের সাধনায় নিয়োজিত দেখা গেছে এমনটি অন্য সময় দেখা যায়নি। (মুসলিম শরীফ)
সে মহান রাতটি সঠিকভাবে স্পষ্ট নয়, তবে বিশুদ্ধ হাদিসের ভাষ্যমতে তা রমজানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতের মধ্যে। নবীয়ে করিম (সা) বলেন, “তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে শবে ক্বদর অন্বেষণ কর।” এ মহান রাতে হজরত জিবরাইল ফেরেশতাদের দলসহ পৃথিবীতে অবতরণ করেন। (সহীহ বুখারী)
“লাইলাতুল কদরের রজনীতে একদল ফেরেস্তাসহ জমিনে অবতরণ করেন তারা রাত জাগরণকারী ইবাদাতে মশগুল বান্দাদের সাথে মোসাফাহ করেন, তাদের জন্য দোয়া করেন ও তাদের মুনাজাত কবুল হওয়ার জন্য ‘আমিন’ বলেন এবং ফজর পর্যন্ত তা চলতে তাকে।” (বায়হাকী শরীফ)
এ সময়ে লায়লাতুল কদরের পবিত্র রাতের অন্বেষণে নবীয়ে করিম (সা) নিজ বাড়িঘর ছেড়ে রমজানের শেষ দশদিন মসজিদে নববীতে এতেকাফ করতেন। হাদিস শরীফে রয়েছে “একদিনের এতেকাফে জাহান্নামকে তার থেকে তিন খন্দক দূরে নিয়ে যায় আর এক খন্দক এর দূরত্ব আকাশ ও জমিনের ব্যবধান।” (তিবরানী)
এ মহান রাতে বান্দাদের কী করা উচিত সূর্যাস্ত থেকে ভোর হওয়া পর্যন্ত রাতের সময়।
নবী কারিম (সা) লাইলাতুল ক্বদরের জন্য কী কঠিনভাবে ইবাদাত করেছেন।
হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত, “রমজানের শেষ দশকের রাতগুলোতে নবী কারিম (সা) তাঁর পায়জামার রশি মজবুত করে বেঁধে নিতেন, নিজে সারা রাত সালাতে দণ্ডায়মান থাকতেন ও আহলদেরকে জাগিয়ে দিতেন।” (সহীহ বুখারী)
তাই উম্মতের নর-নারীকে এ রাতসমূহে জাগ্রত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। আর প্রতি মুহূর্ত সময়কে অপচয় না করে বন্দেগিতে লিপ্ত থাকতে চেষ্টা করতে হবে।
দণ্ডায়মান করতে হবে দীর্ঘ কিয়ামের সাথে সালাত আদায়ে, আর যে কুরআনকে বেশি তিলাওয়াত ও অধ্যয়নে ব্যস্ত থাকবে আর নিজের ও গোটা উম্মতের জন্য চোখের পানিতে সিক্ত দোয়া ও মুনাজাত করবে এবং গুনাহ ক্ষমা চেয়ে আল্লাহর দরবারে তাওবাহ ও ক্রন্দনে রাত শেষ করবে। হযরত আয়েশা (রা) নবী করিম (সা) কে জিজ্ঞাসা করেন , “আমি যদি লাইলাতুল ক্বাদরের রাত পেয়ে থাকি তবে আমি আল্লাহর কাছে কী চাইব? নবীজি (সা) উত্তরে বলবে তুমি বলবে “হে প্রভু! তুমি বান্দাদের ক্ষমা কর তাই আমাকে ক্ষমা কর।” (আহমদ)
সুপ্রিয় পাঠক! পূর্বে আলোচনায় এসেছে গাফেলদের ইবাদাত, অনুভূতিহীনদের সিয়াম ও কিয়ামের প্রতি আল্লাহতায়ালা নজর করেন না। এ হাদিসের মধ্যেও পূর্বের শর্তটি সংযুক্ত হয়েছে। যারা শবে কদরের পবিত্র রজনীতে ইবাদাত পালন করে ঈমান ও ইহ্তেসাব সহকারে তাদের জীবনের সমস্ত অপরাধসমূহ আল্লাহতায়ালা মার্জনা করে দেন। তাই ঈমান ও আত্মবিশ্লেষণ সকল ইবাদাত মকবুল হওয়ার জন্য অপরিহার্য এক বিষয়।
হাদিস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়
সিয়ামকে আল্লাহতায়ালা উম্মতে মুহাম্মদী (সা)-এর উপর ফরজ করেছেন যেমন পূর্বের নবীদের উম্মতের ওপর ফরজ করেছেন।
সিয়াম সাধনাকে আল্লাহতায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে তা ‘ঈমান’ ও ‘ইহতেসাবের’ সাথে পালন করতে হবে।
মকবুল সিয়াম আমাদের জীবন থেকে গুনাহের সমস্ত কালিমা মোছন করে দেবে।
রমজান শরীফের প্রতিটি মুহূর্ত অতি মূল্যবান। একটি কঠিন পরিকল্পনার মাধ্যমে সময় অপচয় রোধ করতে হবে।
এ মাসে কঠোরভাবে ইবাদাত পালনে যেমন সচেষ্ট হতে হবে তেমনি পাপাচার থেকে তাওবাহ করে ফিরে আসতে হবে।
এ মাসের গুরুত্বপূর্ণ রাত লাইলাতুল কদরকে রিয়াজতের মাধ্যমে নিরন্তর ইবাদাতে কাটাতে হবে।
এ মাস কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার মাস, তাই কুরআনকে তিলাওয়াত ও অধ্যয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে বানাতে হবে।
এ মাসে যাদের জীবন পাপমুক্ত হবে না অথচ রমজান বিদায় হবে তাদের ব্যাপারে নবীয়ে কারিম (সা) অভিসম্পাদ দিয়েছেন।
উপসংহার
যে পাঁচটি খুঁটির ওপর ইসলামের বিশাল প্রাসাদ দাঁড়িয়ে রয়েছে তার অন্যতম স্তম্ভ সিয়াম। তা অতিব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ইবাদাত। তা তাকওয়া অর্জনের খোদায়ি ট্রেনিং। কোন ইবাদাত আল্লাহ ভীতিকে মানব মনে এইভাবে বদ্ধমূল করে না সিয়াম প্রতিটি মুহূর্কে খোদাভীতিকে যেভাবে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করে। একজন রোজা পালনকারী ভয়ানক তৃঞ্চার্ত অবস্থায় পানির দরিয়ায় ডুব দেয়, ইচ্ছা করলে পানি পান করতে পারে একান্ত সংগোপনে কিন্তু শুধু আল্লাহর ভয় ছাড়া কেউ রুখতে পারবে না। এ প্রশিক্ষণ চলতে থাকে প্রতি মুহূর্তে? প্রতিটি ১০ দিন করে ৩ বার লাগাতার এ ট্রেনিং চলতে থাকে। আবার গোটা বিশ্বের প্রতিটি জনপদে মুসলমানদের জীবনে এ তরবিয়াত চলে এক সাথে। একটি স্বর্গীয় আবহ যেন চারদিকে বহমান থাকে। মানুষের জীবনে যত প্রকার পাপাচার রয়েছে সমস্ত সীমালংঘনের মূল উৎস নফসের বাড়াবাড়ি। শয়তানের বড় এজেন্ট হচ্ছে ‘নফসে আম্মারা’। একে বশীভূত করতে না পারলে বিপর্যয়ের পর বিপর্যয় শুধু আমাদেরকে গ্রাস করবে। সিয়াম খাদ্য পানীয় ও জৈবিক দাবি পূরণে বিরত থাকার লাগাম কষে দিয়ে নফসকে আল্লাহর নির্দেশের নিকট অনুগত করতে বাধ্য করে। উপবাস ছাড়া আর কোন কিছু নফসকে এমনি বশীভূত করতে পারে না। অসংযত নফসকে সিয়ামের লাগাম কষে নিয়ন্ত্রণের খাঁচায় বন্দি করি।
প্রিয় পাঠক! রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে মাহে রমজান আমাদের মাথার ওপর ছায়া বিস্তার করছে। আমরা একটি কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি আর অবগাহন করি রহমতের অতল সমুদ্রে। একটি মানুষের সমগ্র জীবনের নফল ইবাদাত যোগ করলে একটি ফরজ ইবাদাতের সমান হবে না অথচ এ মাসের একটি নফল একটি ফরজের বরাবর এ সুযোগ জীবনে আর হয়তো পাব না এ কথা স্মরণে নিয়ে আসুন আমরাই ইবাদাতের জন্য কোমর বাঁধি। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকাতে ভয় লাগে সেখানে রয়েছে আল্লাহর নাফরমানি, পাপাচার ও গুনাহের বাড়াবাড়ি। মাহে রমজান নিয়ে এসেছে মাগফিরাতের অফুরন্ত সুযোগ। সেহেরি, তাহাজ্জুদ, তারাবিহ, ইফতার ও কদরের প্রতিটি সময়ে ক্ষমা ও নাজাতের সুসংবাদ এসেছে আল্লাহর কিতাব ও নবীজি (সা) এর বিশুদ্ধ হাদিসে। মা সন্তানকে যেভাবে নিষ্পাপ অবস্থায় জন্ম দেয় রাসূল (সা) বলেন, সিয়াম সেভাবে নিষ্পাপ করে দেয় রোজাদারকে। রমজান ছাড়া আর কোন মাসে পাপ মার্জনার এ দুর্লভ সুযোগ নেই। এ সুযোগ সে হাতছাড়া করেছে তার জন্ম না হলে যেন ভাল ছিল। নবীজি (সা) তার ওপর লা’নত বর্ষণ করেছে, অভিষাপ দিয়েছে সাইয়্যেদেনা জিবরিল। ‘হে প্রভু! আমাদেরকে নাজাত প্রাপ্তদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন।’
আমরা জানি এ মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে। অবাক হওয়ার বিষয় আল্লাহর সমস্ত আসমানি কিতাব এ মাসে নাজিল হয়েছে বলে হাদিসের সমর্থন রয়েছে। এ মাসের এত মর্যাদার কারণও যেন কিতাবের নাজিলে। যে কুরআন নাজিল হওয়ার কারণে এ মাস হলো এত ধন্য, নাজিলের রজনী হলো হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আমরা অনেকে জীবনের এতটা বছর পেরিয়ে এসেওে আল্লাহর অবতীর্ণ মহামূল্যবান ও অমর এ কিতাবটি আজও পড়া হলো না, জানা হলো না এর অতলান্ত রহস্যাবলি মানা হলো না এর হালাল ও হারামের বিধান। আর নয়, এবারের রমজানে আল কুরআন ও কাগজ কলম নিয়ে বসে যাই, শুরু করি গভীর অধ্যয়ন।
এতেকাফের ১০ দিন সময় শুধু কুরআনের সাথে থাকি। যে কথাটি না বলে ইতি টানতে পারছি না, মাহে রমজান সহানূভূতি ও সহমর্মিতার মাস। ক্ষুধার্ত মানুষের বেদনা কত তীব্র তা আমরা এ মাসে অনুভব করতে পারি। আমাদের প্রিয় দেশের ৫০ ভাগের চেয়ে বেশি মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে। কোটি কোটি মানুষ বিনা চিকিৎসায় কাতরাচ্ছে। শুধু অপুষ্টিতে অসংখ্য শিশু অন্ধ হয়ে জন্ম নিচ্ছে। সামর্থ্যবানদেরকে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে সিয়াম আমাদের চেতনাকে পীড়ন দিচ্ছে। সদকা ও জাকাত তাদেরকে সুন্দর জীবন গঠনে ও দরিদ্র বিমোচনে বড় অবদান রাখতে। তাই বলতে চাই আত্মগঠনে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে মানবিকতার বিকাশ সাধনে সিয়াম আমাদের জীবনে আসুক আলোর বন্যা হয়ে। স্বাগতম হে মাহে রমজান।
দারসুল হাদীস-১২
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি নবীয়ে করিম (সা)-কে একদা জিজ্ঞাসা করলাম যে, আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমলসমূহ কী কী?
উত্তর প্রদানে তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালার কাছে বান্দার সবচেয়ে প্রিয় আমলের অন্যতম
১. সময়মতো সালাত আদায় করা। ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, আমি অনুরূপ আর একটি আল্লাহর প্রিয় নেক আমল জানতে চাইলাম নবীজি (সা) বললেন
২. মাতা-পিতার সাথে সদাচরণ করা। সাহাবী বলেন, আমি আরো একটি প্রিয় আমল বলার জন্য অনুরোধ করলাম, তিনি বলেন
৩. আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা।”
(সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
আমরা জানি যে নবীয়ে করিম (সা)-এর পবিত্র জবান থেকে উচ্চারিত প্রতিটি কথা, তার জীবনের প্রতিটি কর্ম ও আমল এবং কোন কাজে তার পবিত্র মতামত ও সমর্থনকে- হাদিস ও সুন্নাহর মধ্যে শামিল করা হয়েছে।
এ হাদিসও রাসূল (সা)-এর এক প্রকার ওহি। যে ওহিকে ‘গাইরে মাতুলু’বলা হয়। নবুয়তের হায়াতে রাসূল (সা) যা বলেছেন ও করেছেন সব ওহি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত ছিল।
যেমন কুরআন শরীফে সূরা নজমে বলা হয়েছে وَمَا يَنْطِقُ عَنْ الْهَوَى، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَى
অর্থাৎ “তিনি নিজ থেকে কোন শব্দ উচ্চারণ করেননি তা ছাড়া যা তার ওপর ওহি করা হয়নি।” (সূরা নজম : ৩-৪)
সনদ
হাদিসের সনদ আলোচনা হাদিস বিশুদ্ধতার বিচার করার অন্যতম মানদন্ড। হাদিস গ্রন্থ বিশুদ্ধ হওয়া পর্যন্ত বর্ণনা পরম্পরায় যাঁরা রয়েছেন তাঁরা সকলেই সনদ আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। এ কঠিন কাজটি সাহাবীদের পরপরই শুরু হলেও ‘হিজরি দ্বিতীয় থেকে হিজরি চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত এ সময়কে হাদিস সংকলনের গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বলা যায় এটাই হাদিসের সনদ বিচার বিশ্লেষণ ও সংকলনের স্বর্ণযুগ।
এ সময়ে যারা এ অসাধারণ কষ্টসাধ্য বিষয়টিকে সম্পাদন করার জন্য নিজেদের হায়াত তিল তিল করে ব্যয় করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ইমাম আহমদ, ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী, ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী, ইমাম আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসাঈ, ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযিদ ইবনে মাযাহ প্রমূখ।
বিশুদ্ধতার দৃষ্টিতে প্রথম স্তরে যে সমস্ত হাদিসের গ্রন্থ রয়েছে তাদের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত হাদিসগ্রন্থের অন্যতম ১. মুয়াত্তা ইমাম মালিক ২. সহীহ বুখারী ৩. সহীহ মুসলিম এ তিনটি গ্রন্থ সনদের বিশুদ্ধতায় তুলনাহীন।
আলোচ্য হাদিসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম দু’জনে তাঁদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থে চয়ন করেছেন বিধায় বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে প্রথমশ্রেণীর পর্যায়ে।
হাদিসের রাবী
প্রথম রাবী হচ্ছেন সাহিবুল হাদিস। আলোচিত হাদিসের ক্ষেত্রে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হলেন সাহিবুল হাদিস। সাহাবীদের মধ্যে বিশিষ্ট পাঁচজন আবদুল্লাহ্ (রা) মধ্যে ইবনে মাসউদ অন্যতম। তিনি প্রথম যুগের ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবীদের অন্যতম। তিনি আবিসিনিয়ায় ও পরে মদীনায় হিজরতকারীদের একজন। মদীনায় তিনি হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা)-এর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। রাসূলে আকরাম (সা)-এর সাথে তিনি বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। দীর্ঘদিন তিনি কুফার কাজী ছিলেন ও সে জনপদের ইসলামী জ্ঞানের প্রাণপুরুষ হিসেবে বিবেচিত ছিলেন।
ইবনে মাসউদ (রা) ৮৪৮টি হাদিস বর্ণনা করেন এর মধ্যে ৬৪টি হাদিস ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেন। শুধু ইমাম বুখারীর সহীহ বুখারীতে ইবনে মাসউদ (রা) থেকে ২১৫টি হাদিস গ্রহণ করেছেন।
তিনি হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফতকালে ৩৩ হিজরি এর ৯ রমজান ইন্তেকাল করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। হয়রত উসমান (রা) তাঁর জানাজার ইমামতি করেন ও জান্নাতুল বাকীর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
হাদিসের ব্যাখ্যা
ইবনে মাসউদ (রা) নবীজি (সা)-কে বান্দার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রিয় নেক আমল সম্পর্কে জানতে চাইলে রাসূল (সা)-এর জবাবে ৩টি গুরুত্বপূর্ণ আমলে সালেহ সম্পর্কে অবহিত করেন। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে পৃথিবীর জীবনে দেখে নিতে চায় কারা নেক আমল করে আর কারা বদ আমল করে পৃথিবীর জীবনকে বরবাদ করে। তাই পৃথিবী হচ্ছে নেক আমলের পুঁজি সংগ্রহের সময়।
কুরআনে পাকে আল্লাহতায়ালা বলেন : الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً
“যিনি হায়াত ও মৃত্যুর সৃষ্টির মধ্যবর্তী একটি জীবনে তোমাদের পরীক্ষা করবেন কে আমলের দৃষ্টিতে ভাল।” (সূরা মূলক : ২)
রাসূল (সা) যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ নেক আমল সম্পর্কে বলেছেন তার ব্যাখ্যাঃ
সময়মতো সালাত আদায় করা : الصَّلاَةُ لِوَقْتِهَا
’প্রথমত সালাত আদায় প্রসঙ্গে,
‘সালাত’ হচ্ছে ঈমান আনার পর আল্লাহতায়ালার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হুকুম। যে বিষয়ে আল্লাহতায়ালা কুরআনে কারীমে অর্ধশতবারের বেশি তাকিদ করেছেন। অথচ কুরআনে কোন বিষয়ে একবার নির্দেশ এলে তা ফরজ হয়ে যায়।
‘সালাত’ সে বিষয় যে বিষয়ে আল্লাহতায়ালা সকল নবীকে ও সকল ওহিতে নির্দেশ দিয়েছেন। সকল যুগে সকল উম্মতের জন্য সালাতের বিধান ছিল জরুরি, অতীব জরুরি। মুমিনদের জান্নাতে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ আমল- বিনয়ের সাথে সালাত আদায় করা।
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ، الَّذِينَ هُمْ فِي صَلاتِهِمْ خَاشِعُونَ
“নিশ্চয়ই সে সব মুমিন সফল হবে যারা বিনয়ের সাথে সালাত আদায় করে।” (সূরা মুমিনুন : ১-২)
সমগ্র মানবজাতির মধ্যে আল্লাহর গজব এসেছিল তখন মানুষ যখন সালাত আদায় ছেড়ে দিয়েছিল। নবীগণের ইন্তেকালের পর উম্মতেরা যখন তাদের আদর্শ সালাত ত্যাগ করেছে তখন আল্লাহর গজব তাদেরকে ধংস করেছে। কুরআন বলছে فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيّاً
‘‘নবীদের পরে উম্মতের মধ্যে এমন অযোগ্য লোকেরা এলো যাদের জীবন থেকে সালাত বিদায় হয়ে গিয়েছিল তারা ছিল নিজেদের নফসের অনুসারী, তাই তারা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলো।’’ (সূরা মারইয়াম : ৫৯)
‘সালাতের’ বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রনায়কদের ওপর আইন অবতীর্ণ হয়েছে-
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلاةَ وَآتَوْا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنْ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الأُمُورِ
“আমি যখন তাদেরকে জমিনের রাজত্বে প্রতিষ্ঠিত করি তবে তারা সেখানে ১.সালাতের বিধান জারি করবে, ২. জাকাতের আইন চালু করবে, ৩. ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে আর ৪. অন্যায়কে উৎখাত করবে”। (সূরা হজ: ৪১)
এই আইন প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের ওপর খোদায়ী ফরমান। আর সালাতের বিধান এখানেও প্রথমে আলোচিত হয়ছে।
আর মুমিনদের ওপর শুধু সালাত প্রতিষ্ঠা ফরজ হয়নি বরং উহার সাথে সালাতের নিয়ম ও সময়কে নির্দিষ্ট করে বিধান অবতীর্ণ হয়েছে।
حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلاةِ الْوُسْطَى وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ
“তোমরা সালাতসমূহের হিফাজত কর বিশেষ করে মধ্যবর্তী সালাত, আল্লাহর সামনে অনুগত গোলামের ন্যায় সালাতে দণ্ডায়মান হও।’’ (সূরা বাকারা : ২৩৮)
উপরের আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা সালাত হিফাজত ফরজ করেছেন- অর্থাৎ সালাতের সমস্ত আরকান ও আহ্কাম সংরক্ষণ না হলে সালাত যথার্থভাবে সংরক্ষণ সম্ভব নয়। আবার যে সময়ের যে সালাত তাকে সে সময় আদায় না করলেও সালাত হিফাজত হবে না। তাই নির্দিষ্ট সময়ে সালাত আদায় করা ফরজ। কুরআন এ বিষয়ে আরো স্পষ্ট করে বলেছে-
إِنَّ الصَّلاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَاباً مَوْقُوتاً
“নিশ্চয়ই সালাতকে নির্দিষ্ট সময়ের সাথে মুমিনদের ওপর ফরজ করা হয়েছে।” (সূরা নিসা : ১০৩)
এ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত সম্পর্কে প্রথম প্রশ্ন দিয়ে আল্লাহ্তায়ালা বান্দার সাথে কিয়ামতের মাঠে জীবন জিজ্ঞাসা শুরু করবেন।
যারা সালাতের বিষয়ে আল্লাহতায়ালাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে তাদের জন্য পরবর্তী বিষয় সহজ হবে। এ হাদিসের মাধ্যমেও স্পষ্ট যে সমস্ত ইবাদাত এর মধ্যে সালাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ইচ্ছাকৃতভাবে এক ওয়াক্ত সালাত তরককারী বান্দার সাথে আল্লাহতায়ালা সম্পর্ক ছেদের ঘোষণা দিয়েছেন। নবীয়ে করীম (সা) হযরত মুয়াজ (রা)-কে নসিহত করার সময় এ ভয়াবহ হাদিস বর্ণনা করেন-
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم لِمُعَاذٍ (رضـ) لاَ تَتْرُكَنَّ صَلوَةً مَكْتُوْبَةً مُتَعَمِّدً فَاِنَّ مَنْ تَرَكَ صَلوةً مَكْتُوْبَةً مُتَعَمِّدًا فَقَدْ بَرِئَتْ مِنْهُ ذِمَّةُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ- (رواه احمد)
নবীয়ে আকরাম (সা) হযরত মুয়াজকে বলেন, “মুয়াজ সাবধান কখনও ফরজ নামাজ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিবে না। যদি ইচ্ছাকৃত এক ওয়াক্ত নামাজ ছেড়ে দাও তবে তুমি বান্দাহ হিসেবে আল্লাহতায়ালার দায়িত্ব থেকে বের হয়ে যাবে।” (মুসনাদে আহমদ)
দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ ও পুণ্যময়ী আমল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন তা-
“মাতাপিতার সাথে সদাচরণ করা”- قَالَ بِرُّ الوَالِدَيْن
সকল মানুষের সাথে সদাচরণ নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত।
সকল সৃষ্টির মধ্যে একজন সন্তানের জন্য তার নিজ মা-বাবার সাথে ভালো ব্যবহার করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও পুণ্যময়। যে বিষয়ে আল্লাহতায়ালা কুরআন শরীফে একাধিক স্থানে তাকিদের সাথে বর্ণনা করছেন পিতা-মাতার অধিকার প্রসঙ্গে। তার শরিয়তের পরিভাষায় মা-বাবার সাথে সদাচরণ ফরজের অন্তর্ভুক্ত যা অমান্য করলে গুনায়ে কবিরার পর্যায়ে পড়বে। কুরআন বলছে:
وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُوا إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلاً كَرِيماً [سورة الإسراء]
“আল্লাহর ফয়সালা এই যে তিনি ছাড়া আর কারো দাসত্ব করা যাবে না এবং তোমাদের পিতামাতার সাথে সদাচরণ করবে, তাদের দু’জন বা একজন যখন বার্ধক্যে পৌঁছে যায় তবে তোমাদের আচরণের কারণে তারা যেন উহ্ না বলে, তাদের সাথে ধমকের সুরে কথা বলবে না বরং তাদের সাথে সম্মানের সাথে কথা বলবে”। (বনী ইসরাইল:২৩)
আয়াতের আবেদন এতই তাৎপর্যপূর্ণ যে এর প্রতিটি শব্দের মধ্যে রয়েছে এক এক মহাসমুদ্রের বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা।
সমগ্র জীবনের কঠিন ও উত্তপ্ত মুহূর্তেও মাতা-পিতার সাথে সদাচরণের সীমা লংঘন করার সামান্যতম অনুমতিও আল্লাহ ও রাসূলের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি।
নবীয়ে পাক প্রিয় সাহাবী হযরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা)-কে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন,
وَلاَ تَعقنَّ وَالِدَيْكَ وَاِنْ اَمَراكَ اَنْ تَخْرُجْ مِنْ اَهْلِكَ وَمَالِكَ- (رواه احمد)
“মুয়াজ সাবধান! তোমার পিতা-মাতার সাথে এমন কোন আচরণ করবে না যাতে তাদের হৃদয়ে আঘাত লাগে। তারা যদি তোমাকে ঘর থেকে বের করে দেয় অথবা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তারপরও প্রতিবাদী হওয়া যাবে না।” (মুসনাদে আহমদ)
পিতা-মাতাগণ যদি শিরক ও কুফুরীর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে উহা গ্রহণ করা যাবে না কিন্তু এর পরও ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করার অনুমতি নেই। এ বিষয়ে কুরআনে পাক এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য
وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفاً
“তোমার পিতা-মাতা যদি আমার সাথে শিরিকের ক্ষেত্রে তোমার ওপর চাপ সৃষ্টি করে যার ভয়াবহতা তুমি জান না সাবধান তা অনুসরণ করবে না তবে পৃথিবীর জীবনে তাদের সাথে এর পরও ভালো ব্যবহার করবে।” (সূরা লোকমান : ১৫)
একব্যক্তি রাসূলে খোদার (সা) দরবারে এসে জিজ্ঞাসা করলেন যে সন্তানের ওপর মা-বাবার কী অধিকার?
عَنْ اَبِيْ اُمامَة اَنَّ رَجُلاً قَالَ يا رَسُوْلَ اللهِ مَا حَقُّ الوَالِدَيْنِ عَلى وُلِدِهِمَا؟ قَالَ هُمَا جَنَّتُكَ وَنَارُكَ – (ابن ماجه)
হযরত আবু উমামা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি রাসূল (সা)-এর দরবারে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন মা-বাবার অধিকার কী সন্তানের ওপর? নবীয়ে পাক (সা) বলেন, “তারা তোমার জন্য জান্নাত অথবা জাহান্নাম।” (ইবনে মাজাহ)
মাতা-পিতার সন্তুষ্টিতে সন্তানের জন্য জান্নাত আর তাঁদের অসন্তুষ্টির মধ্যে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নাম। হাদিস শরীফে রয়েছে,
الرب في رضا الوالد ضار
“যে সন্তানের ওপর তার মাতা-পিতা রাজি রয়েছে তার ওপর আল্লাহতায়ালাও রাজি রয়েছে।”
وَقَالَ رَسُوْلَ اللهِ (صـ) اِنَّ اللهَ حَرَّمَ عَلَيْكُمْ عُقُوْقَ الأمَّهَاتِ
নবীয়ে কারিম (সা) বলেন, “আল্লাহতায়ালা মায়ের অবাধ্যতা সন্তানের জন্য হারাম করে দিয়েছেন।
লেখক-মাওলানা এনায়েত করীম
দারসুল হাদীস-১৩
عَنْ عاَئِشة قالتْ قالَ رَسوْلُ الله (ص) لِخَديْجَةََ واَخْبَرَهاَ الْخَبَرَ لقََدْ خَسِيتُ على نَفسِىْ فَقالَتْ خَديجةَ كلاَّ واللهِ ما يُخزِِيْكَ الله اَبَدََ ১ اِنَّكَ لتَصِلُ الرَّحِمَ ২. و تُحْمِلُ الكَلَّ ৩. و تَكسِبُ المعْدومَ ৪. و تقْرِى الضَّيْفَ ৫. و تُعينُ على نَوَائبِ الحَقّ.ِ
অনুবাদ হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুহাম্মদ (সা) তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা) কে হেরা পাহাড়ে ঘটে যাওয়া অহি ও জিবরাইল-সংক্রান্ত সব কথা বলেন ও ভয়ার্ত চিত্তে বললেন, “আমি আমার জীবন সম্পর্কে আশঙ্কা করছি।” খাদিজা সান্তনা দিয়ে বলেন, “আল্লাহর শপথ! তা কখনও হতে পারে না, তিনি আপনাকে অপদস্থ করবেন না। ১. আপনি আত্মীয়াতার বন্ধন সংরক্ষণ করেন, ২. আপনি দুস্থ মানুষের বোঝা হালকা করেন, ৩. নিঃস্বদের আহার করান, ৪. অতিথিদের সেবা করেন, ৫. সত্যের পথে নির্যাতিতদের সাহায্য করেন।” (বুখারি)
হাদিসের শানে নুজুল :
আমরা জানি যে, নবীদেরকে আল্লাহতায়ালা জন্ম থেকে নবী করে পয়দা করেছেন। তবে নবুওয়ত ঘোষণা করার সময়টি আল্লাহ তাদেরকে অহির মাধ্যমে জানিয়ে দেন। এর পূর্বে তাদের নবুওয়তপ্রাপ্ত অবস্থায় থাকে। খোদ নবীরও কিছুই জানা থাকে না। তবে হ্যাঁ নবুওয়তের আগে সকল নবীর জীবন থাকে পবিত্র ও মাহফুজ। আল্লাহ তায়ালা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। মুহাম্মদ (সা) ছিলেন জন্ম থেকে সকল বিষয়ে ব্যতিক্রম। তার বাল্যকাল, কৈশোর ও যৌবনকাল কেটেছে আরব জাহেলিয়াতের মধ্যে। শরাব, নারী ধর্ষণ ও খুন-খারাবি এবং অসংখ্য মূর্তির পরিবেশে জন্ম নিলেন, পালিত হলেন কিন্তু আশ্চর্য! পাপাচার ও বর্বতার সামান্যতম কণাও তার পূত-পবিত্র চরিত্রকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারেনি। সমস্ত আরব জগতে শিশুকাল থেকে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘আল-আমিন’ ও আসসাদিক হিসেবে। তিনি পরম সত্যবাদী ও আমানতদার। মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ। তিনি ছিলেন সর্বদা মানবতার মুক্তির চিন্তায় ধ্যানস্থ ও চিন্তিত ও নিঃসঙ্গপ্রিয়।
قال علِىُّ كانَ رسول لله (ص) مُتَوَاصِلَ الاَحْزانِ – دائمَ الفِكْر- لسْتُ لهُ راحةُُ (ترمذى)
হযরত আলী (রা) বলেন, নবীজি (সা) যেন সর্বদা নিমজ্জিত ছিলেন ব্যথার সমুদ্রে, ছিলেন চিন্তার মহাজগতে এবং সদা অস্থির অবস্থায়।” (তিরমিজি)
৪০ বছর বয়সে তার এ নিঃসঙ্গতা অস্থিরতা অসহ্য অবস্থায় পৌঁছে। তিনি অহি নাজিলের সময় থেকে তিন বছর পূর্ব হতে প্রতি রমজান মাস ব্যক্তিগত ইবাদাত ও ধ্যানে কাটাতেন মক্কার অদূরে জাবালে নুরের চূড়ায় এবং গুহায়। সেখান থেকে সোজা কাবা দেখা যেতো, তিনি থাকতেন কাবামুখী হয়ে। সে সময়ের আমল সম্পর্কে যতটুকু সিরাতকারেরা বলেছেন, নির্বাক হয়ে দেখতেন অপলক নয়নে-মহাকাশের নীলাকাশ, রাতের তারার মিতালি, পূর্ণিমায় উদ্ভাসিত চাঁদের হাসি। মৌনভাবে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের পাহাড়, মরুর বালুসমুদ্রে খাঁ খাঁ ঊর্মিমালা, দেখতেন মরু পাহাড়ের পাখ পাখালি ও বিচিত্র প্রাণিকুল।
اِنَّ فىْ خَلْقِ الثمواتِ و الارضِ واخْتلافِ اللَّيلِ والنَّهارِ لايَتِ لِّاولى الْبابِ
“আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন লুক্কায়িত এ মহাকাশ, বিশ্ব চরাচর, পাহাড় মরু ও জীববৈচিত্র্য ছিল তাঁর অধ্যায়ের এক এক মহাকাব্য, আর এর মধ্যে ছড়িয়ে থাকা রহস্য যেন বিচিত্র অধ্যায়ের সূচিপত্র।”
প্রকৃতি যেন তাঁর পাঠশালা, তিনি তাঁর পাঠক ও গবেষক, তাঁর চিন্তার অন্যতম বিষয় মানবসমাজ ও বিপর্যস্ত মানবতা, তার চারদিকে নেশায় বুদ হয়ে থাকা নর-নারী, বিবস্ত্র নারী-পুরুষের কাবা প্রদক্ষিণ-তাওয়াফ করা, শত শত বিচিত্র রঙের ও আকার আকৃতির দেবদেবী যাদের সামনে সিজদায় লুটিয়ে থাকা সৃষ্টির সেরা মানুষ, অপ্রয়োজনে ও বিনা কারণে বছরের পর বছর রক্তের প্রতিশোধ ও যুদ্ধের হুঙ্কার, মানুষের জানমালের ওপর শক্তিশালীদের জুলুমের তাণ্ডব, নারীদের ওপর চলছিল নেশাখোরদের বলাৎকার ও মেয়েশিশুদেরকে জীবন্ত কবরে মাটিচাপা দেয়ার ভয়াল দৃশ্য দেখা মুহাম্মদের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও এ জাহেলিয়াতের প্লাবন থামাতে না পেরে মুহাম্মদ (সা) চিন্তায় নিমগ্ন হলেন হেরাগুহায়, চেয়ে থাকতেন কাবার রহস্যময় কালো ঘরটির দিকে যা সভ্যতার প্রথম সূতিকাগার। তিনি যেন অপেক্ষায় আছেন কাবার মালিকের হেদায়াতের প্রত্যাশায়।
কুরআন বলছে,
َ أَلَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَ – وَوَضَعْنَا عَنكَ وِزْرَكَ – الَّذِي أَنقَضَ ظَهْرَك
“আমি তোমার বক্ষকে কি নবুওয়তের জন্য প্রশস্ত করিনি? আমি তোমার থেকে সে চিন্তার বোঝা অপসারণই করেছি যা তোমার পাঁজর ভেঙে দিচ্ছিল।” (সূরা ইনশিরাহ : ১-৩)
এমনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ৪০ বছর পূর্ণ হলে ২৭ রমজান রাতে আল্লাহর অহি নিয়ে আবির্ভূত হলেন জিবরাইল (আ), আকাশ পৃথিবীজুড়ে তার বিশাল অবয়ব, যে দৃশ্য মুহাম্মদকে ভয়ে ও বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিল। তিনি এত নিকটে এলেন, যা কুরআনের ভাষায়;
ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى – فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى – فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى
“অতঃপর জিবরাইল তার নিকটে অতি নিকটে এলো। তাদের মধ্যে দুই ধনুকবাতারও কম দূরত্ব এলো, তখন সে মুহাম্মদের ওপর অহি পৌঁছালো যা পৌঁছার কথা ছিল।” (সূরা নজম : ৮-১০)
নবীজির ওপর সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাজিল হলো। রাসূল (সা.) অহি নাজিলের ভয়াল বিস্ময়ে কম্পিত দেহে অস্থির মনে হেরাগুহা ত্যাগ করে ঘরে গিয়ে খাদিজাকে বলেন,لَقَدْ خَشِيْتُ عَلئ نِفْسِي زَمِّلُونِي زَمِّلُونِي فَزَمِّلُوهُ
“আমাকে কম্বল জড়িয়ে দাও, কম্বল জড়িয়ে দাও, আমার জীবনের বিষয়ে আমি ভয় করছি।” (বুখারি)
তাকে কম্বল জড়িয়ে দিয়ে হযরত খাদিজা (রা.) ১৫ বছরের জীবনে রাসূলের একান্ত সান্নিধ্যে থেকে তাকে কিরূপ দেখেছেন, সান্তনা দিতে গিয়ে সে প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন যা এরপর আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
হাদিসের উৎস
সমগ্র দুনিয়ার হাদিসবেত্তাদের উসতাদ মুহাম্মদ বিন ইসমাইলের অমর গ্রন্থ, সহিহুল বুখারিতে এ হাদিস উক্ত হয়েছে। হাদিস মরফু, মুত্তাসিল সনদ সকল বর্ণনাকারী সেকাহ্ ১৬ বছর পরিশ্রম করে ছয় লাখ হাদিস হতে বাছাই করে ৭২৭৫টি হাদিস বুখারিতে গ্রহণ করেছেন (বুদরুদ্দিন আইনি)
সমস্ত দুনিয়ার মুহাদ্দিসদের ইজমা হলো, আল্লাহর কিতাবের পর আকাশের নিচে সর্বাধিক সহিহ্ গ্রন্থ ‘সহিহুল বুখারি।’ (ফাতেহুল বারি ও উমদাতুল কারি)
ইমাম নাসাঈ, বলেন, ‘হাদিসের সমস্ত কিতাবের মধ্যে বুখারি শরিফের চেয়ে উত্তম আর কোন কিতাব নেই।’ (মুকাদ্দমা মুসলিম) তিনি হাদিস বাছাইয়ের কঠিন কাজটি করেছেন বায়তুল্লাহ শরিফে বসে আর বাছাইকৃত হাদিস দিয়ে অধ্যায় রচনা করেছেন মসজিদে নববীর রিয়াজুল জান্নাতে বসে। ইমাম বুখারির শিরোনাম রচনার মধ্যে রয়েছে তার অসাধারণ জ্ঞান প্রজ্ঞা, চাতুর্য ও গভির পা-িত্য, যা এখনও পর্যন্ত মুহাদ্দিসদের হতবাক করে দেয়। তাই বলা হয় ‘ফিকহুল বুখারি ফি তারা জিমিহি’ বুখারির অসাধারণ পাণ্ডিত্য তার কিতাবের শিরোনামের মধ্যে লুকিয়ে আছে।
সাহিবুল হাদিস
প্রথম বর্ণনাকারী হিসেবে রয়েছেন উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা), যিনি হযরত আবু বকর (রা)-এর কন্যা। তিনি বেশি সুন্দরী ছিলেন বলে তাকে হোমায়রা বলতেন নবীজি (সা)। খাদিজার ইন্তেকালের পর নবীজি (সা) এর সাথে আয়েশার বিয়ে নিষ্পন্ন হয়। তখন আয়েশা মাত্র ছয় বছরের বয়স্কা, ৫০০ দিরহাম মহর নির্ধারিত হয়। হযরত আবু বকর বিয়ের খুতবা ও আকদ্ দেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে হযরত আবু বকর খুতবায় বলেন, আপনারা জানেন রাসূলুল্লাহ আমাদের নবী। তিনি আমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ প্রদর্শন করেছেন। এক সময় ছোট মেয়েদের নিয়ে আমরা অনেক কুসংস্কার গড়ে তুলেছি। মেয়েদের আমরা জীবিত পুঁতে ফেলেছি হাত-পা বেঁধে দেবীর পায়ে বলি দিয়েছি। আজ আমার প্রিয় কন্যাকে রাসূলের হাতে তুলে দিয়ে যাবতীয় কুসংস্কার মুছে ফেলতে চাই। রাসূলের সাথে আমার বন্ধুত্বকে অটুট রাখতে চাই। আমার প্রিয় কন্যা রাসূলের সাথে সাথে তাঁর আদর্শ ও বাণী প্রচার করবে।”
সবাই মারহাবা বলে স্বাগত জানালো। হিযরতের সাত মাস পরে মদিনায় রাসূলের গৃহে আসেন। নবীজি ইন্তেকালের সময় আয়েশার বয়স হয়েছিল ১৮ বছর এবং ওফাতের পর ৪৮ বছর জীবিত ছিলেন। হাদিস বর্ণনাকারীদের মধ্যে আয়েশার স্থান উচ্চে। তিনি রাসূল থেকে ২২১০টি হাদিস বর্ণনা করেন। ৫৮ হিজরি ১৭ রমজান ৬৭ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর অসিয়ত অনুসারে জান্নাতুল বাকির কবরস্থানে রাতে তাঁকে দাফন করা হয়। তাফসির, হাদিস সাহিত্য ও নসবনামায় তার পাণ্ডিত্য অসাধারণ। তিনি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। তাঁর চরিত্রের ওপর আল্লাহর আয়াত নাজিল হয়েছে। ইমাম যুহরী বলেন, ‘উম্মতের জ্ঞানসমুদ্র যত বড় আয়েশার জ্ঞানসাগর তার চেয়ে বড়।”
হাদিসের ব্যাখ্যা
কথাগুলো মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে হযরত খাদিজার উক্তি। তিনি নবীজি (সা) এর সবচেয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী। সকল উম্মতের মধ্যে প্রথম ঈমান আনয়নকারী, জগতের শ্রেষ্ঠতম চারজন রমণীর অন্যতম। যিনি তার সকল ধনসম্পদের পাহাড় রাসূলের কদমে হাজির করে দেন। রাসূলের সব ছেলেমেয়ে তাঁর গর্ভে জন্মলাভ করেন। তিনি ২৫ বছর উম্মুল মোমেনিন হিসেবে নবীজির সান্নিধ্য লাভে ধন্যা হন। অহি লাভের পর রাসূল (সা) এর অস্থিরতায় তিনি সান্তনা দেন ও বলেন, كلاّ واللهِ ما يُخزِيك الله اَبَدََ (ও)َ
“আল্লাহর শপথ তিনি আপনাকে কখন অপমান ও অপদস্থ করবেন না”।
একজন স্ত্রীর মন্তব্য স্বামীর ব্যাপারে খুবই প্রণিধানযোগ্য। কারণ সুখে-দুঃখে, দিনে-রাতে সকালে-বিকেলে, রাগ-বিরাগ সর্বাবস্থায় নিবিড়ভাবে স্বামীকে দেখার সুযোগ তিনিই লাভ করেন। আর যদি স্ত্রীও হন অতীব বিচক্ষণ, সচেতন ও জ্ঞান ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন তবে তো কথাই নেই। যে মুহাম্মদকে গোটা আরব জনপদ পূর্বেই আল আমিন বলে ঘোষণা দিয়েছে। নবুওয়ত-পূর্ব জীবনে বর্বতার মধ্যে সভ্য, অশ্লীতার মধ্যে পরিচ্ছন্ন, পুঁতিগন্ধময়ের মধ্যে সৌরভ, অন্ধকারের মধ্যে আলো হিসেবে দেখছেন। তারপরও সবার প্রশংসার চেয়ে খাদিজার উক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
নবীজি (সা) বলেন, “তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর বিবেচনায় উত্তম।” তিনি আরও বলেছেন, আমার স্ত্রীদের বিবেচনায় আমি উত্তম। নবীজি (সা) এর সাথে খাদিজার দাম্পত্য জীবনের ১৫টি বছর তখন চলছিল। জীবনীকারেরা আরও দেখেছেন এ দীর্ঘ সময়ের কোনদিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন বিষয়ে উচ্চবাচ্য হয়নি, মান অভিমান পর্যন্ত হয়নি। সম্ভ্রান্ত, ধনবতী ও গুণবতী এই রমণী নবীজির জীবনে কিভাবে ছায়া হয়েছিলেন, খাদ্যসামগ্রী নিয়ে হেরার চূড়ায়ও উঠেছেন যা আজও যেন বিস্ময়! পৃথিবীর জীবনে আমরা এমন প্রায়ই দেখি একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, সেনাপতি, দার্শনিক ও জ্ঞানী কিন্তু পারিবারিক জীবনে সফল নহেন। সেখানে দ্বন্দ্ব, কলহ অবিশ্বাস, খোনাখুনি পর্যন্ত হচ্ছে আর বিচ্ছেদ তো চলছে অগণনভাবে। সেখানে মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে আল্লাহর শপথ করে তার জীবনের পবিত্রতা ও সৌন্দর্যের ওপর আল্লাহর অনিবার্য সাহায্যের ব্যাপারে খাদিজার কথাগুলো কুরআনের বাণীরই প্রতিধ্বনি করছে। কিছুদিন অহি বন্ধ থাকায় নবীজি (সা) হৃদয়ে যে অস্থিরতা ও আশঙ্কা দেখা দিল, আল্লাহ সান্তনা দিয়ে বলেন,
وَالضُّحَى – وَاللَّيْلِ إِذَا سَجَى- مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلَى- وَلَلآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنْ الأُولَى .
“শপথ মধ্যাহ্নের আর নিশিথ রাতের। হে মুহাম্মদ (সা) তোমার প্রভু তোমাকে ত্যাগ করেননি, তোমার প্রতি বিরাগ ভাজনও হননি। নিশ্চয়ই বর্তমানের চেয়ে ভবিষ্যৎ তোমার অনেক উত্তম।” (সূরা দোহা : ১-১৪)
انك لتَصِلُ الرَّحِمَ (ওও)
“নিশ্চয়ই আপনি আত্মীয়দের সাথে মধুর সম্পর্ক ও সম্প্রীতি বজায় রাখেন।”
নবুওয়তের ঘোষণা দেয়ার পর যে বিষয় তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং কুরআন পরবর্তীতে যে আত্মীয়তার বিষয়ে আয়াত নাজিল করেছে রাসূলের জীবনে সে সকল চারিত্রিক মাধুর্য পূর্বেই বিকশিত হওয়ার ব্যবস্থা আল্লাহতায়ালা করেছেন। নবীজি (সা) রক্তের আত্মীয়দের ব্যাপারে সর্বদা যত্নশীল ছিলেন। এক আবু লাহাব ছাড়া অন্য চাচারা ঈমান না আনলেও নবীজির সাথে অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক রাখতেন। আবু তালেব যদিও ঈমান আনেননি কিন্তু নবীজির জন্য সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করেছেন। যেখানে ইবরাহিম (আ)-এর পিতা আজর ইবরাহিমকে ঘরছাড়া করেছেন নমরুদের সাথে সহযোগিতায় আগুনের কুণ্ডলীতে নিক্ষেপ করার ব্যবস্থায় নিয়োজিত সেখানে রাসূলের চাচা আবু তালেব কাবাঘরের দায়িত্ব ত্যাগ করেছেন মুহাম্মদকে ত্যাগ করেননি।
তিন বছর শিয়া’বে আবু তালিবে বন্দী অবস্থায় গাছের পাতা খেয়ে অনাহারে ছিলেন। বিনিদ্র রজনী মুহাম্মদকে পাহারাদারি করেছেন এর দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি পাওয়া কঠিন। নিশিথ রাতে মিনার উপত্যকায় মদিনাবাসীর সাথে আকাবার বায়াত অনুষ্ঠিত হচ্ছিল সে সময় খঞ্জর হাতে রাসূলের পাহারাদারিতে দণ্ডায়মান। সে ব্যক্তিটি রাসূলের চাচা হামজার ছোটভাই আব্বাস তখনও ছিলেন মুশরিকদের মধ্যে। আবার চাচা আবু তালিবের আর্থিক কষ্ট লাঘব করতে চাচাতো ভাই আলীর দায়িত্ব ছোট থেকেই রাসূল গ্রহণ করেছেন। নবুওয়তের দায়িত্ব পালনের পরও আত্মীয়তার বিষয়ে অনেক হাদিস উল্লেখ করেছেন আর নির্দেশ অবতীর্ণ হয়েছে কুরআনুল কারিমে,
وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَتَسَاءَلُونَ بِهِ وَالأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيباً.
“তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যার নামে তোমরা অধিকার দাবি কর আর সতর্ক থাক আত্মীয়তার অধিকার ও সম্পর্কের বিষয়ে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর তীক্ষণ দৃষ্টি রাখেন।” (সূরা নিসা : ০১)
رَّحِمْ قاطِعُ الجنَّةَ يدْخُلُ لا قال رسول لله (ص)
“সাবধান রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়তা ছিন্নকারীরা জান্নাতে যাবে না।” (বুখারি)
اللَّهَ قطعهُ قَطعنىْ وَمَنْ اللَّهَ وصلهُ وصلنِىْ مَنْ فقولُ بالْعرسِ مُعلَّقةُ الرَّحِمُ عَنْ عاَئشة قالتْ فَقال رسول لله
“আত্মীয়তার সম্পর্ক তথা ‘রেহেমকে’ আল্লাহ আরশের সাথে লটকিয়ে রেখেছেন যে তা ঠিক রাখবে সে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখবে, যে বিচ্ছিন্ন করবে সে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন বিনষ্ট করবে।” (বুখারি)
আজকের সমাজে ভাইয়ে ভাইয়ে, পিতা-পুত্রে, চাচা-জেঠাদের সাথে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক নেই বরং নিকট-আত্মীয়রা যেন অন্যদের চেয়েও বেশি শত্রু। সামান্য কারণে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই রয়েছে। তা চলছে বছরের পর বছর ধরে। আজ রক্তের সে অবহেলিত দাবি পূরণ করা সুস্থ সমাজের জন্য জরুরি।
و تَحْمِلُ الْكَلَّ (ওওও)
“নিশ্চয় আপনি দুর্বলদের বোঝা বহন করেন।”
হযরত খাদিজা (রা) বলেন, ‘আপনাকে দেখেছি সারাজীবন দুর্বল ও বঞ্চিতদের বোঝা বহন করতে। সমাজের বেশির ভাগ মানুষ দুর্বল ও অবহেলিতদের মধ্যে এরা ন্যূনতম মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারে না। এরাই সমাজের মূল স্রোত। এরা সবসময় স্বল্পসংখ্যক সুবিধাভোগীর হাতে নিপীড়িত। মুহাম্মদ (সা) এদের অন্তর্ভুক্ত। সোনার চামচ মুখে নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি তো স্বল্প অর্থের বিনিময়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত মক্কাবাসীর বকরি চরিয়েছেন। ইমাম বুখারী এমন একটি হাদিসও গ্রহণ করেছেন। আল্লাহতায়ালা এমন কোন নবী পাঠাননি যিনি রাখাল ছিলেন না। আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি বেশির ভাগ নবী শ্রমজিবী। রাসূল (সা) সমগ্র জীবন ইয়াতিম ও বেওয়ারিশ ও মিসকিনদের জন্য জীবনপাত করেছেন। তিনি এতটুকু বলেছেন আমার উম্মতের বেশির ভাগ মানুষ গোলাম, শ্রমজীবী ও ইয়াতিম হবেন। তাদের বোঝা হালকা করার জন্য নিয়োজিতরা জান্নাতি।
قال قال رسول اللهِ (ص) لا يدخل الجنَّةِ سيعئ الملكةِ قالو يا رسول اللهِ اليس اخبَرْتنا هذهِ الاُمَّة اكْثرُ الامَمِ ممْلوْكينَ و يتامى؟ قال نعمْ- فاكرمُوْا هُمْ لَكَرمَةِ اَوْلاَدُكُم وَ اطْعِمُهُمْ مِمَّا تأكُلون
নবীজি (সা) বলেন, জালেম মালিকেরা জাহান্নামি, লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদেরকে বলেননি, এ উম্মতের বেশির ভাগ মানুষ হবে গোলাম ও ইয়াতিম? তিনি বলেন, হ্যাঁ, তোমরা সন্তানের মতো তাদেরকে আদর করবে আর তোমরা যা খাবে তাদেরকে তাই খেতে দেবে।” (ইবনে মাজাহ)
আজকের সমাজে কী দেখি? মানুষ কিভাবে জালেমদের অত্যাচারে নির্বাক ও নিথর, মজলুমেরা আদালতের কাঠগড়ায় ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়ে অশ্রুবিসর্জন করছেন।
(রা) و تَكسِبُ المعْدوم
হযরত খাদিজা বলেন, ‘আপনি তো নিঃস্বদের আহারের ব্যবস্থা করেন, আপনি নিরন্ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেন, আপনি বিবস্ত্রদের কাপড় দেন, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই আপনার কল্যাণ করবেন।
এ দরিদ্র, নিঃস্ব বুভুক্ষুরা আল্লাহর পরিবারের সদস্য। একটি হাদিসে এমন রয়েছে। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন কিয়ামতের দিন আমি বলব “হে বনি আদম! আমি ক্ষুধার্ত হয়ে তোমার নিকট গিয়েছিলাম তোমরা আমাকে খাবার দাওনি, লোকেরা বলবে তুমিতো আহার কর না, কিভাবে তোমায় করাবে? আল্লাহ বলবেন সে ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা হলে আমাকে খাদ্য দেয়া হতো।” সোবহানাল্লাহ্। (মুসলিম)
عنْ بْنِ عبَّاسِ قال سمِعْتُ رسولُ اللهِ يقول ليسَ المومنُ الَّذى يَشْبَعُ و جاَرُهُ جاععُ اِلى جنْبِه
ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, আমি রাসূলের জবানে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “তারা মুমিন নয় যারা প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে আহার করে।” (মিশকাত)
মুহাম্মদ (সা) প্রতিবেশীদের খবর নিতে, আসহাবে সুফফার লোকদের আহারের ব্যবস্থা না করে খাবার মুখে দেননি।
বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ দু’বেলা আহার করতে পারছে না, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। আমাদেরকে তাদের মুখে অন্ন ও পরিধানের বস্ত্র ও আর্তের চিকিৎসার জন্য লড়াই করতে হবে। রাসূল (সা) জীবনে কী ছিল? আমরা কোথায়, কোন ইবাদাতের মধ্যে জান্নাত খুঁজছি। আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে মানবতার সেবায়। তিনি আরও বলেন, ‘আপনি অতিথির সেবা করেন।’
কাবা শরীফ মক্কায় অবস্থিত বিধায় হাজার হাজার বছর থেকে কাবাকেন্দ্রিক বিভিন্ন এলাকা ও জনপদ থেকে তীর্থযাত্রীরা ভিড় জমাতো। কোরাইশ পৌত্তলিকেরা বিদেশীদের জীবন সম্পদ লুণ্ঠনের উৎসব করত বিশেষ করে হজ মৌসুমে। যদিও জাতিগতভাবে আরবিরা অতিথিপরায়ণ কিন্তু অসৎদের আর মূল্যবোধের বালাই থাকে না।
মুহাম্মদ (সা) বাল্যকাল হতে অসহায় বিদেশী ও অতিথিদের সহায় সম্পদ লুণ্ঠনের দৃশ্য দেখে আসছিলেন। পরে হিলফুল ফুজুল সংগঠন সৃষ্টির উদ্দেশ্যও ছিল সমাজে শান্তিপ্রতিষ্ঠা, বিদেশীদের নিরাপত্তা প্রদান। চার বছর ধরে ফিজ্জার যুদ্ধ হয়েছিল আরব গোত্রদের মধ্যে। রাসূল (সা) এর বয়স তখন চৌদ্দ। পরের বছর রাসূল তার প্রিয় চাচা যুবায়ের বিন আবদুল মোত্তালিব আবদুল্লাহ বিন জুমআনের ঘরে বনি হাশিম ও বনি যুইবার বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে এক সভা বসে। গঠিত হয় পাঁচ দফার ওপর প্রতিজ্ঞা।
১. দেশ থেকে অশান্তি দূর করব ২. বিদেশী মেহমানদের জানমাল রক্ষা করব ৩. গরিব-দুঃখীকে সাহায্য করব ৪. দুর্বলদেরকে জালেমদের হাত থেকে প্রতিরক্ষা করব, ৫. আমরা বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনে চেষ্টা করব। এ পবিত্র প্রতিজ্ঞাবাণীর নাম ছিল ‘হিলফুল ফুজুল’। নবুওয়তের পর একদিন রাসূল (সা) বলেন, ‘আবদুল্লাহ বিন জুমআনের ঘরে যে প্রতিজ্ঞায় অংশ নিয়েছিলাম, আমাকে রক্তিম বর্ণের উট দান করলেও আমি সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করব না। আজও যদি কেউ আমাকে অত্যাচারিত হয়ে আহ্বান করে বলে হে ফজুল প্রতিজ্ঞার সদস্যগণ আমাকে সাহায্য কর তবে আমি সে ডাকে সাড়া দেবো। ইসলাম ন্যায়প্রতিষ্ঠা ও মজলুমদের সাহায্য করার জন্য এসেছে।
قال قال رسول اللهِ (ص) مَنْ كانَ يومِنُ باِاللهِ و اليَومِ الاخِرِ فليُكْرِمْ ضيْفَةُُ ( بُخارى)
“কেউ যদি আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈামন আনে সে যেন অতিথির সেবা করে।” (বুখারি)
আজকের বিশ্বে বিদেশী ও অতিথিদের কোনো সম্ভ্রম সংরক্ষিত আছে কি? সময় যেন দাবি করছে যুবকদের আবার ‘হিলফুল ফুজুলের’ প্রতিজ্ঞা করে অত্যাচার ও নিপীড়নমুক্ত সমাজ গঠনের শপথ করা। দুর্ভাগ্য আমাদের মুক্ত চেতনার নামে যুবক ও তরুণদেরকে কিভাবে কায়েমি স্বার্থবাদীরা নিজেদের লুণ্ঠনকে বহাল রাখা ও শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার জন্য নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করছে।
-> و تُعينُ على نَوَائبِ الحَقّ “সত্যের পথে নির্যাতিতদের আপনি সাহায্য করেন।”
খাদিজার এ উক্তিটিও তাৎপর্যপূর্ণ। হকের পথে, ন্যায়ের পথে যারা যে যুগেই চলতে চেয়েছে নিষ্ঠুর সমাজ তাদের চলার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে, তাদেরকে জুলুম-নিপীড়ন নির্যাতনের বিষাক্ত কাঁটা মাড়িয়ে চলতে হয়েছে। কারাগারের নির্যাতন, সেল ও ফাঁসির রজ্জু তাদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে যেন। এটি একটি কঠিন বিষয় যা মেনে নিতে মন চায় না। সত্যপথের পথিকদের জন্য জীবনকে কঠিন হতে কঠিনতর করা হয়েছে পরীক্ষার পর পরীক্ষার নির্মমতা লাজেম করা হয়েছে।
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنْ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنْ الأَمْوَالِ وَالأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرْ الصَّابِرِينَ – الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
“আমি তোমাদেরকে (মুমিনদের) ভয়ভীতি, ক্ষুধা, ধনসম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব, তুমি ধৈর্যশীলদেরকে সুভসংবাদ দাও, যারা যেকোনো বিপদ-মুসিবতে বলে আমরা আল্লাহর কাছ হতে এসেছি এবং তারই নিকট ফিরে যাব।” (সূরা বাকারা : ১৫৫)
আর আল্লাহ তায়ালা জালেমদের শুধু অবকাশ দেন ও ঢিল দিতে থাকেন। তবে তা অনাদিকালের জন্য নহে, একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হলে রশি টান দেন।
اللَّهُ يَسْتَهْزِئُ بِهِمْ وَيَمُدُّهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ
“আল্লাহ তাদের সাথে উপহাস করে পাপাচারে ঢিল দেন আর তারা অন্ধ হয়ে ছুটে চলে।” (সূরা বাকারা : ১৫)
সত্যের জন্য ন্যায়ের পথে চলতে গিয়ে যারা নির্যাতিত হয়েছেন নবুওয়তের আগে ও পরে মুহাম্মদ (সা) ছিলেন তাদের আশ্রয়ে। তিনি তাদের সান্তনা, আর নবীজি (সা) ছিলেন সকলের প্রিয়জন। হেদায়াতের দাওয়াত তাকে করেছে সবচেয়ে মজলুম। নবুওয়তের প্রথম দিন খাদিজা (রা) মুহাম্মদ (সা)-কে ওরাকার কাছে নিয়ে গেলে তিনি বলেন, ‘তোমার নিকট জিবরাইল এসেছে যিনি নবীদের নিকট আসেন। মূসা (আ)-এর নিকটও এসেছিলেন। আহা! আমি যদি বেঁচে থাকি তোমাকে যেদিন মক্কা হতে বের করে দেয়া হবে সেদিন আমি তোমার সাহায্যে পাশে দাঁড়াবো। নবীজি জিজ্ঞাসা করেন আমাকে কেন বের করবে? ওরাকা বলেন,
رجُل قطُّ بمثْلِ ما جِئتُ الَّا عُودِىَ بهياتِ لمْ যারা তোমার পূর্বে অহি বহন করেছিলেন সত্যের দাওয়াত দিয়েছিলেন জাতি তাদের সকলের সাথে শত্রুতা করেছে। (বুখারি)
হাদিসের শিক্ষা
মুহাম্মদ (সা)-এর সামাজিক ও মানবীয় চরিত্র যা খাদিজা (রা) বর্ণনা করেছেন সেগুলোই শিক্ষা যা উম্মতের জন্য গ্রহণীয়।
১. সে উত্তম ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর বিবেচনায় উত্তম, খাদিজা কসম করে বলেন মুহাম্মদের চেয়ে উত্তম মানব ত্রিভুবনে নেই।
২. সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত মজলুমদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে।
৩. দরিদ্র্য সীমার নিচে রয়েছে কোটি কোটি বনি আদম, চেষ্টা করে যেতে হবে নিরন্নদের মুখে অন্ন তুলে দিতে তা-ই সর্বোচ্চ বন্দেগি ও ইবাদত বুঝতে হবে।
৪. অতিথি দেশী, বিদেশী, পরিচিত-অপরিচিত সকলের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে-এটা মানবতার শিক্ষা।
৫. সমগ্র পৃথিবীর প্রতিটি জনপদে দ্বীনের দায়ীরা মজলুম। তাদের রক্ত বয়ে চলছে পিচঢালা কালো পথে, কারার অন্ধ প্রকোষ্ঠে তাদের ওপর চলছে রিমান্ডের নামে লোমহর্ষক জুলুমের ইতিকথা, ফাঁসির রজ্জু তাদের গলদেশে ‘যারা বলছেন আল্লাহ ছাড়া কারো আইন মানব না।’ তাদের সাহায্য করার জন্য যা আছে সব নিয়ে নামতে হবে।
উপসংহার
কোন আদর্শকে পৃথিবীর মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করা একটি সহজ বিষয় নয়। এ অসাধ্যকে সাধন করতে হলে দু’টি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো গতিশীল নেতৃত্ব আর দ্বিতীয়টি হলো কর্মীদের গুণাবলি। যেকোনো আদর্শের নেতাকর্মীদের নৈতিক কিছু অপরিহার্য গুণাবলির সাথে প্রয়োজন সামাজিক চরিত্র। এ সামাজিক চরিত্র এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তা ছাড়া ঐ আদর্শকে মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য করা কঠিন। আদর্শ কতটুকু মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ ও সঠিক এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আদর্শকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত কর্মীদের গুণাবলি ও যোগ্যতা। বিশ্বব্যাপী ইসলামী পুনর্জাগরণের সূচনা আজ মানবতার জন্য একটি শুভসংবাদ হলেও কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠিত ফেরাউনি শক্তি কখনও তাকে মেনে নেবে না। ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে চলমান ভূ-রাজনৈতিক আস্থা ও ইসলামের শত্রুদের কর্মকৌশল ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকলে বিপ্লব যে শুধু বিজয় বন্দরে নোঙর করতে পারবে না তা নয়, লাখ লাখ কর্মীর জানমাল বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। ইসলামকে বিজয়ী করার সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছে তাদের মধ্যে নৈতিক যে গুণাবলি প্রয়োজন তা হলো,
১. ইসলামের সঠিক জ্ঞান যার উৎস আল্লাহর কিতাব ও হাদিসে রাসূল।
২. চরিত্র হবে নিষ্কলুষ ফরজ, ওয়াজিব পালন ও কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
৩. ইসলামকে জীবন উদ্দেশ্য বানাতে হবে-জীবন ও মরণ ইসলামের জন্য নিবেদন করা।
৪. সর্বোচ্চ কোরাবানির জন্য প্রস্তুত থাকা- শাহাদাতে তামান্না সৃষ্টি করা।
৫. আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক-তাহাজ্জদ গুজার হওয়া।
আমি উল্লিখিত গুণাবলিকে নৈতিক বিবেচনা করে বলতে চাই এর মাধ্যমে আল্লাহর বান্দা জান্নাতে হয়তো যাবে কিন্তু বিপ্লব বিজয় করার জন্য তা যথেষ্ট হবে না। আরও কিছু সামাজিক চরিত্র প্রয়োজন হবে- যা করার জন্য মুহাম্মদী আখলাক বর্ণনা করতে গিয়ে খাদিজা বর্ণনা করেছেন। ১. মানবতার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ২. দুস্থ ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকা। ৩. মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা। ৪. আত্মীয় ও প্রতিবেশীর সেবায় সর্বদা ব্যস্ত থাকা ৫. সত্যের পথে নির্যাতিতদের জন্য সর্বস্ব কোরবানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। বিপ্লবের কর্মীদেরকে নৈতিক ও সামাজিক গুণাবলির সমন্বয় সাধন করা আজ সময়ের অপরিহার্য দাবি। এরপর আমি শত্রুদের কৌশল সম্পর্কে সাবধান করতে চাই :
১. মুসলিম যুবকদের চরিত্র ধ্বংস করতে তারা বদ্ধপরিকর। এ ব্যাপারে তারা তিনটি হাতিয়ার প্রয়োগ করছে এক, নারীদেরকে ব্যবহার করা নৈতিকভাবে দেউলিয়া করতে হলে এর আক্রমণ অব্যর্থ। এ জন্য আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহ যা প্রযুক্তির বদৌলতে প্রত্যেকের মোবাইলে ঢুকে পড়েছে। এই ভয়াল ছোবল থেকে কিছুই রেহাই পাবে না। দুই, নেশাকে সহজলভ্য করে, নেশায় আসক্ত করা, আমাদের ছাত্রদের প্রায় ৩০ লাখের ওপর আসক্তদের সংখ্যা পৌঁছে গেছে। সত্যিকথা বলতে কী এর চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু নেই। তিন, আমাদের যুবকদের হৃদয়ে তারা অর্থবিত্ত, আরাম-আয়েশ, গাড়ি, বাড়ির স্বপ্ন এঁকে দিয়েছে, মুছে দিয়েছে শাহাদাতের তামান্না। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, আল্লাহর শপথ, আমার হৃদয় হাহাকার করছে। আমি জিহাদ করি শহীদ হই, আবার জীবিত হই আবার শহীদ হই। (বুখারি)
২. ‘সন্ত্রাস’-কে তারা মুসলিম দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে, আমাদের যুবকদের হাতে এর গোলাবারুদ তুলে দেবে আর কেড়ে নেবে-আল কুরআন।
৩. মিডিয়ার মাধ্যমে অপপ্রচার। এর ক্ষমতা পরমাণুর চেয়েও বেশি। শত্রুরা দিনকে রাত, সাদাকে কালো, মুসলমানদেরকে তাদের হক জিহাদকে জঙ্গিবাদ বলে প্রচার করছে ও আর্থিকভাবে সফল হয়েছে। আফসোস, মুসলমান রাষ্ট্রনায়কদ ও তথ্যমন্ত্রীদের বক্তব্য ও মিথ্যাচার শুনলে মনে হয় শত্রু আজ দূরে নয়, তাদের অমবহঃ-রা শত্রুদের চেয়েও সার্থক ও ভয়ানক শত্রু এ মিল্লাতের জন্য। এত ষড়যন্ত্র ও প্রতিরোধের পরও আশ্চর্য যে ১. ইসলামের অগ্রযাত্রা কোনো বাধা ও প্রতিবন্ধকতা মানছে না। খোদ ইউরোপ, আমেরিকায়ও ইসলাম আজ এক অদম্য শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ২. এত রক্ত, শাহাদাত ও ফাঁসির আতঙ্ক খুন গুমকে পা দিয়ে মাড়িয়ে যুবকেরা সংগঠিত হচ্ছে বিপ্লব বিজয়ের উন্মাদনায়। এদের রক্তে আগুন ধরেছে, কার সাধ্য এ অনল নেভাবে। তাদের প্রতি আমার সবিনয়ে পরামর্শ :
এক, তোমাদেরকে কৌশলী হতে হবে। রাসূল (সা) বলেছেন, ‘যুদ্ধ হচ্ছে শত্রুকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানোর নাম।” চ্যালেঞ্জ নয়। তাদেরকে ঘুমন্ত রেখে অতি সন্তর্পণে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
দুই, সার্বক্ষণিক দায়ী হওয়া। এ দাওয়াতই ইসলামকে পৌঁছে দেবে সর্বত্র। তা শত্রুর হৃদয়েও অনুভূতি জাগাবে।
তিন, দাঁড়ানো, বসা ও চলন্ত অবস্থায় কুরআন পড়া-এর মধ্যে পৃথিবীকে বশীভূত করার জাদু আছে।
চার, আরাম নয়, বিলাস নয়, কঠোর সংগ্রামী জীবনকে বরণ করে নিতে হবে।
পাঁচ, দল নয়, জাতি নয়, মানবতাবাদী হও। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ইসলামের মূলমন্ত্র হতে হবে।
প্রভু! আমাদের যুবকদের যোগ্যতা দিয়ে দয়া কর। আমিন।
লেখক-অধ্যাপক মফিজুর রহমান