দারসুল কুরআন-১:সূরা আল মুদ্দাসসির(আয়াত : ১-৭)
এ.কে.এম নাজির আহমদ
اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ .
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْم
১। আয়াত
ياَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ ০ قُمْ فَاَنْذِرْ ০ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ ০ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ ০ وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ ০ وَلاَ تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ ০ وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ ০
২। ভাবানুবাদ
‘ওহে আবৃত ব্যক্তি, উঠ এবং (লোকদেরকে) সাবধান কর। এবং তোমার রবের বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ কর, প্রতিষ্ঠা কর। এবং তোমার পোশাক পবিত্র পরিচ্ছন্ন রাখ। এবং যাবতীয় মলিনতা থেকে দূরে থাক। এবং বেশি পাবে আশায় অনুগ্রহ করো না। এবং তোমার রবের খাতিরে ছবর অবলম্বন কর।’
৩। পরিপ্রেক্ষিইতিহাস বিশ্লেষকরা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবির্ভাব কালকে ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সন্দেহ নেই, সেই যুগের জন্য এই আখ্যাটিই যথার্থ।
সেই যুগটি ছিলো মানব সমাজ ও সভ্যতার অতি অধপতিত একটি অধ্যায়।
দেশে দেশে তখন রাজা আর সম্রাটদের দোর্দন্ড প্রতাপ। তারা মানুষের প্রভু সেজে বসেছিলো।
তাদের খেয়াল-খুশিই ছিলো আইন। আইনের শাসন বলতে যা বুঝায় তখন তা ছিলো এক কল্পনাতীত বিষয়।
রাজা বা সম্রাটকে ঘিরে গড়ে উঠেছিলো একটি অভিজাত শ্রেণী। তাদের আর জনগণের মাঝে ছিলো দুস্তর ব্যবধান। তারা জনসাধারণকে ঘৃণার চোখে দেখতো। কিন্তু তাদের বিলাসী জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ঐ সাধারণ মানুষগুলো থেকেই আদায় করা হতো।
হাতে গোনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রাজা বা সম্রাট এবং তাদের অনুগ্রহভাজন অভিজাত গোষ্ঠী ছিলো মদখোর। মদ খেয়ে মাতলামী করা আর নিত্য নতুন নারী দেহ ভোগ করা ছিলো তাদের জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাদের মনোরঞ্জনের জন্যই বিপুল সংখ্যক নারীকে হতে হয়েছে বেহায়া এবং উলংগ কিংবা অর্ধ-উলংগ।
সেই যুগে মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিলো অসহনীয়। সেটি ছিলো সুদখোরদের স্বর্ণ যুগ। কিছু সংখ্যক পুঁজিপতি সুদের মাধ্যমে অগণিত মানুষের কাছ থেকে টাকা ছেঁকে নিয়ে গড়তো টাকার পাহাড়। পুঁজিপতিরা হতো ‘আংগুল ফুলে কলাগাছ’। ঋণ গ্রহীতারা হতো কংকালসার।
সেই যুগে পৃথিবীর সকল দেশেই গরু, ছাগল, উট, ভেড়ার মতো মানুষ বেচা-কেনার জন্যও হাট বসতো। এক বিত্তবান ব্যক্তির কাছ থেকে আরেক বিত্তবান ব্যক্তি কিনে নিতো দাস-দাসী। এরা রাতভর-দিনভর শ্রম দিতো মনিবের বাড়িতে, বাগানে, খামারে কিংবা কারখানায়। এই দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় ছিলো মৃত্যু।
সেই যুগে নারীদের দুর্ভোগের অন্ত ছিলো না। নারীদের একমাত্র কর্তব্য ছিলো পুরুষদের যৌন ক্ষুধা মেটাতে থাকা। একজন পুরুষ যতো সংখ্যক ইচ্ছা বিয়ে করতে পারতো। আবার বিত্তবান হলে রক্ষিতা হিসাবে রাখতে পারতো অসংখ্য নারী। কোন কোন অঞ্চলে পিতার মৃত্যুর পর পুত্ররা তাদের সৎ-মা’দেরকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতো। কোন কোন অঞ্চলে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তাকে মেরে অথবা জীবিতাবস্থায় গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেয়া হতো।
রাজা বা সম্রাটরা ওঁত পেতে থাকতো পররাজ্য আক্রমণের জন্য। পররাজ্য দখল করে সেখানে তারা তাদের প্রভুত্ব চাপিয়ে দিতো, দুই হাতে লুটে নিতো দখলকৃত দেশের সম্পদ, যুবকদেরকে করতো হত্যা, আর যুবতীদেরকে ধরে নিয়ে যেতো তাদের যৌবন রস আস্বাদনের জন্য।
সেই যুগে সামগ্রিকভাবে মানুষের জান, মাল ও ইয্যাতের কোন নিরাপত্তা ছিলো না। চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবি ইত্যাদি ছিলো নিত্য-দিনের ঘটনা।
তদুপরি এটি ছিলো চরম ধর্মীয় বিকৃতির যুগ। মাক্কায় অবস্থিত তাওহীদের কেন্দ্র কা‘বায় স্থাপিত হয়েছিলো ৩৬০টি দেব-দেবীর মূর্তি। মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য এদের কাছে প্রার্থনা করা হতো। এদের উদ্দেশ্যে উট, ভেড়া, বকরি বলি দেওয়া হতো।
আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত যিয়ারাতকারীরা উলংগ হয়ে কা‘বার তাওয়াফ করতো। আরবের মুশরিকদের ছালাত সম্পর্কে সূরা আল আনফালের ৩৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَا كَانَ صَلاَتُهُمْ عِنْدَ الْبَيْتِ إِلاَّ مُكَاء وَتَصْدِيَةً০
‘তাদের ছালাত ছিলো বাইতুল্লাহর কাছে শিস দেওয়া আর হাত তালি দেওয়া।’
আরবের পূর্ব দিকে ছিলো ইরান সাম্রাজ্য। কল্পিত দেবতা আহুর মাজদা ছিলো ইরানীদের সবচে’ বড়ো উপাস্য। তাদের ধারণায় আহুর মাজদা-র প্রকাশ ঘটতো আগুনের শিখার মাঝে। তাই পুরোহিত কর্তৃক প্রজ্জলিত আগুনের অনির্বাণ শিখার উদ্দেশ্যে তারা সাজদা করতো।
আরবের উত্তরে ছিলো বিশাল রোমান সামাজ্য। রোমান সাম্রাজ্যে তখন সেন্ট পল কর্তৃক উদ্ভাবিত খৃস্টবাদের বেশ প্রসার ঘটে। সেন্ট পল ছিলেন ত্রিত্ববাদের প্রবক্তা। তাঁর প্রচারিত ধর্মমত মারইয়াম (রা) এবং ঈসা ইবনু মারইয়ামকেও (আলাইহিস সালাম) খৃস্টানদের উপাস্যে পরিণত করে।
কালক্রমে খৃস্টানগণ দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি ভাগ বৈরাগ্যবাদকে তাদের জীবনাদর্শ বানিয়ে নেয়। অপর ভাগটি ভোগবাদী হয়ে পড়ে। বৈরাগ্যবাদী খৃস্টানগণ গোসল না করা, ছেঁড়া-ময়লা পোশাক পরা, গোশত-রুটি না খাওয়া ইত্যাদিকে তাদের ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করতো। পক্ষান্তরে, ভোগবাদী খৃস্টানগণ ভুরিভোজ, মদপান ও অবাধ যৌনাচারে মত্ত হয়ে পড়ে। তাদের মদের আসরে উর্ধ্ব-উলংগ নর্তকীরা নাচতো ও গান গাইতো। সুগন্ধি দ্রব্য জ্বালিয়ে গোটা পরিবেশকে উত্তেজক করে তোলা হতো।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ইয়াহুদীরা নিজেদেরকে মূসা ইবনু ইমরান (আলাইহিস সালাম)-এর অনুসারী বলে দাবি করতো। প্রকৃতপক্ষে তারা মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর প্রতি নাযিলকৃত আত্ তাওরাতের অনুসারী ছিলো না। বরং তারা আত্ তাওরাতকে বিকৃত করে ফেলেছিলো এবং বহু হারামকে হালাল বানিয়ে নিয়েছিলো। মুজাদ্দিদ উযাইরকে (রাহ) তারা আল্লাহর পুত্র বলে দাবি করতো।
সামগ্রিকভাবে তখন গোটা পৃথিবী ছিলো জাহিলিয়াতের পদানত।
সেই যুগে দুই চারজন বিবেকবান ব্যক্তি যে ছিলেন না, তা নয়। কিন্তু তাঁরা ছিলেন অসহায়। তদুপরি অধপতিত সমাজ ব্যবস্থাকে ভেংগে নতুন সমাজ বিনির্মাণের কোন নীতিমালা ও কলা-কৌশল তাঁদের জানা ছিলো না।
এই মহা দুর্দিনে পৃথিবীবাসীকে মুক্তির পথ বাতলাবার জন্য আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটান। তিনিই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাক্কা শহরেই জন্মগ্রহণ করেন এবং বর্ধিত হন। তিনি যখন ১৭ বছরের তরুণ, তখন তাঁর চাচা আযযুবাইর ইবনু আবদিল মুত্তালিব কিছু বিবেকবান ব্যক্তিকে নিয়ে একটি মিটিং করেন। আবদুল্লাহ ইবনু জুদআনের ঘরে অনুষ্ঠিত হয় সেই মিটিং। বানু হাশিম, বানু জুহরাহ, বানু তাইম এর বেশ কিছু সদস্য এতে উপস্থিত ছিলেন। আলাপ-আলোচনার পর তাঁরা একটি সংস্থা গঠন করেন। এই সংস্থার নাম রাখা হয় হিলফুল ফুদুল। এর পাঁচ দফা কর্মসূচি ছিলো নিম্নরূপ
আমরা দেশ থেকে অশান্তি দূর করবো।
আমরা মুসাফিরদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো।
আমরা অভাবীদেরকে সাহায্য করবো।
আমরা মাযলুমের সাহায্য করবো।
আমরা কোন যালিম ব্যক্তিকে মাক্কায় আশ্রয় দেবো না।
তরুণ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দারুণ উৎসাহ নিয়ে এই সংস্থার সদস্য হন এবং সমাজে একটি কল্যাণ ধারা সৃষ্টির প্রয়াসে নিয়োজিত থাকেন। ২৩ বছর ধরে চলে এই প্রয়াস। দেখা গেলো ২৩ বছর আগে সমাজ যেই তিমিরে ছিলো ২৩ বছর পর সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাবুক প্রকৃতির হয়ে ওঠেন। তিনি নির্জনতা পছন্দ করতে শুরু করেন। এই সময়টি সম্পর্কে আয়িশা আছ ছিদ্দিকা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘আল্লাহ যখন রাসূলুল্লাহকে সম্মানিত এবং মানব জাতিকে তাঁর দ্বারা অনুগৃহীত করতে চাইলেন তখন রাসূলুল্লাহ নবুওয়াতের অংশ হিসেবে স্বপ্ন দেখতে থাকেন যা সূর্যোদয়ের মতো সত্য হতো। এই সময় আল্লাহ তাঁকে নির্জনে অবস্থানের প্রতি আগ্রহী করে দেন। নির্জনতা তাঁর প্রিয় ওঠে।’
এই নির্জনতা প্রীতি ও নিভৃত অবস্থানেরই নাম ‘তাহান্নুস’।
নিভৃতে একাকীত্বে আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেছে নেন জাবালুন্ নূরের হেরা গুহাটি। তিনি কয়েক দিনের খাদ্য ও পানীয় নিয়ে হেরা গুহায় চলে যেতেন। খাদ্য ও পানীয় শেষ হয়ে গেলে গুহা থেকে নেমে ঘরে এসে আবার কয়েক দিনের খাদ্য ও পানীয় নিয়ে চলে যেতেন।
উল্লেখ্য, জাবালুন্ নূর কা‘বা থেকে প্রায় চার মাইল দূরে অবস্থিত। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে হেরা গুহা পর্যন্ত উঠতে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায়। পাহাড়ের গা ঘেঁষে গুহা পর্যন্ত পৌঁছা সহজ কাজ নয়। নিভৃতে আল্লাহর ইবাদাতে কাটাবার জন্য তিনি এই গুহাটিকেই বেছে নেন।
এই অবস্থাতেই একদিন আল্লাহর দূত জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) হেরা গুহায় এসে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,
‘পড়ুন।’ তিনি বললেন, ‘আমি পড়তে পারি না।’ জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) তাঁকে বুকে চেপে ধরে ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘পড়ুন।’ তিনি বললেন, ‘আমি পড়তে পারি না।’ জিবরাইল (আলাইহিস সালাম) ‘তাঁকে আবার বুকে চেপে ধরে ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘পড়ুন।’ তিনি বললেন, ‘আমি পড়তে পারি না।’
তৃতীয়বার তাঁকে বুকে চেপে ধরে ছেড়ে দিয়ে জিবরাইল (আলাইহিস সালাম) বলেন,
اِقْرَأ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِىْ خَلَقَ০ خَلَقَ الاِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ০ اِقْرَأ وَرَبُّكَ الاَكْرَمُ ০ الَّذِىْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ ০ عَلَّمَ الاِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ০
‘পড় তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ থেকে। পড় এবং তোমার রব বড়োই অনুগ্রহশীল। যিনি কলম দ্বারা জ্ঞান শিখিয়েছেন। মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে জানতো না।’
এবার মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিবরাঈল (আলাইহিস সাল্লাম)-এর সাথে আয়াত গুলো উচ্চারণ করলেন এবং এই গুলো তাঁর অন্তরে গেঁথে গেলো।
অতপর জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) চলে যান। ভীত কম্পিত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হেরা গুহা থেকে নেমে ঘরে ফেরেন এবং স্ত্রী খাদীজা বিনতু খুয়াইলিদকে (রা) ডেকে বলেন, ‘যাম্মিলুনী যাম্মিলুনী।’ (আমাকে কম্বল জড়িয়ে দাও, আমাকে কম্বল জড়িয়ে দাও)।
ভীতি ভাব কেটে গেলে তিনি বললেন, ‘‘খাদীজা, আমার কী হয়ে গেলো। আমার তো জীবনের ভয় ধরে গেছে।’’ খাদীজা (রা) বললেন, ‘‘আপনি আশ্বস্ত হোন। আল্লাহর কসম, আল্লাহ আপনাকে কখনোই লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয় স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করেন, সত্য কথা বলেন, আমানাতের হিফাযাত করেন, অসহায় লোকদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, নিজে উপার্জন করে অভাবীদেরকে দান করেন। আতিথ্য রক্ষা করেন এবং ভালো কাজে সহযোগিতা করেন।’’
সূরা আল ‘আলাকের এই পাঁচটি আয়াত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি নাযিলকৃত প্রথম ওহী।
ঈসায়ী ৬১০ সনের রমাদান মাসে এই আয়াত গুলো নাযিল হয়। এই আয়াতগুলোতে সৃষ্টি জগতের মহান স্রষ্টা আল্লাহ কেন্দ্রিক জ্ঞান চর্চার আহবান জানানো হয়েছে। মাতৃগর্ভে সন্তানের উন্মেষ হওয়ার প্রথম কয়েকটি দিন জরায়ু গাত্রে ঝুলে থাকা অতি ছোট্ট একটি রক্ত পিন্ড থেকে যে মানুষের যাত্রা শুরু, সেই জ্ঞান তাঁকে দেওয়া হয়েছে। তদুপরি নগণ্য অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করে জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মানুষ যে অসামান্য অবস্থায় উন্নীত হয়, সেই সম্পর্কেও তাঁকে অবহিত করা হয়েছে।
এই আয়াত কয়টিতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে নবী বানানো হয়েছে সেই ধারণা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু নবী হিসেবে তাঁর করণীয় কী তা এই আয়াতগুলোতে বলা হয়নি।
প্রথম ওহী নাযিলের পর কেটে যায় কয়েকটি মাস। এই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন মাক্কার একটি পথ ধরে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোথাও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ওপর থেকে একটি আওয়াজ ভেসে আসে। উপরের দিকে তাকিয়ে তিনি জিবরাঈলকে (আলাইহিস সালাম) দেখতে পান এবং দ্রুত কদমে ঘরে ফিরে স্ত্রীকে বলেন, ‘‘যাম্মিলুনী যাম্মিলুনী।’’
গায়ে কম্বল জড়িয়ে তিনি শুয়ে পড়েন। কিন্তু জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সংগ ছাড়লেন না। তিনি সূরা আল মুদ্দাসসিরের এই সাতটি আয়াত আবৃত্তি করলেন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়াত গুলো পড়লেন এবং এই গুলো তাঁর অন্তরে গেঁথে গেলো।
৪। ব্যাখ্যা
ياَيَّهَا الْمُدَّثِّرُ.
এটি এই সূরার প্রথম আয়াত। এই আয়াতের ‘মুদ্দাসসির’ শব্দটি নিয়ে এই সূরার নাম করণ করা হয়েছে।
এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে ‘ওহে আবৃত ব্যক্তি’ অথবা ‘ওহে বস্ত্রাচ্ছাদিত ব্যক্তি।’
এটি একটি প্রীতিপূর্ণ সম্বোধন।
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন ‘ইয়া মুহাম্মাদু’ কিংবা ‘ইয়া আইউহান্নাবীউ’ বলেও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করতে পারতেন। তা না করে তিনি এই প্রীতিপূর্ণ সম্বোধন ব্যবহার করাটাই পছন্দ করেছেন।
قُمْ فَاَنْذِرْ.
এটি এই সূরার দ্বিতীয় আয়াত। এর অর্থ ‘ওঠ, এবং (লোকদেরকে) সাবধান কর।’
এই আয়াতের মাধ্যমে নবী হিসেবে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যতম কর্তব্য নির্দেশ করা হয়েছে।
قُمْ শব্দের অর্থ ‘ওঠ’। আবার এর অর্থ হয় ‘দাঁড়াও’, ‘কর্তব্য কর্মে নেমে পড়’।
فَاَنْذِرْ অর্থ ‘লোকদেরকে সাবধান কর।’
অর্থাৎ লোকেরা স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করে একদিকে দুনিয়ার জীবনে অশান্তি ভোগ করছে, অপর দিকে আখিরাতের অনন্ত জীবনে চিরন্তন শাস্তি ভোগ করা সুনিশ্চিত করছে। অতএব এই বিষয়ে তুমি তাদেরকে সতর্ক কর। তাদেরকে স্বেচ্ছাচারিতা পরিহার করতে বল।
وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ .
অর্থ ‘এবং তোমার রবের বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ কর, প্রতিষ্ঠা কর।’
এটি এই সূরার তৃতীয় আয়াত। এই আয়াতটি অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ। ছোট্ট দুইটি শব্দের মাধ্যমে নবী হিসেবে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রধান কর্তব্য কী তা তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছে। আর সেই সুমহান কর্তব্যটি হচ্ছে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা ও প্রতিষ্ঠা করা।
মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ। মহাবিশ্ব আল্লাহর বিধান মেনে চলে আল্লাহরই বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি প্রদান করছে। মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ। মানুষের কর্তব্য আল্লাহর বিধানগুলো মেনে চলে আল্লাহর বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি প্রদান করা।
কিন্তু মানুষ নবী-রাসূলদের প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে অপর কোন মানুষ কিংবা অপর কোন সৃষ্টিকে বড়ো কিংবা শ্রেষ্ঠ মনে করে তার বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। এটি মানুষের জন্য সমীচীনও নয়, শোভনীয়ও নয়।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবির্ভাবকালে সামগ্রিকভাবে গোটা মানবগোষ্ঠী এই অসমীচীন ও অশোভনীয় কাজটিই করছিলো। এমতাবস্থায় আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন নির্দেশ দিলেন, ‘ওয়া রাববাকা ফা-কাবিবর’ (তোমার রবের বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ কর, প্রতিষ্ঠা কর)। উল্লেখ্য যে বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব শব্দটির সমভাব প্রকাশক আরেকটি শব্দ হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। এই ছোট্ট আয়াতটি দ্বারা আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আদায় করে তাঁরই প্রতি আনুগত্যশীল জীবন যাপনের জন্য মানবগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস চালাবার জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ দেওয়া হয়।
وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ.
অর্থ ‘এবং তোমার পোশাক পবিত্র-পরিচ্ছন্ন রাখ।’
এটি এই সূরার চতুর্থ আয়াত।
طَهِّرْ শব্দটি ‘তুহরুন’ বা ‘তাহারাত’ শব্দ থেকে উৎসারিত। ‘তুহরুন’ বা ‘তাহারাত’ শব্দটি যুগপৎ পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্থ প্রকাশ করে।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বভাবগত ভাবেই পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করতেন। তিনি যেন সচেতনভাবে এবং কর্তব্য মনে করে তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখেন তারই শিক্ষা রয়েছে এই আয়াতে।
নৈতিক দিক দিয়ে পোশাক পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখার অর্থ হচ্ছে, পোশাক এমন হতে হবে যাতে অহংকার প্রকাশ পাবে না, তাতে কুরুচির ছাপও থাকবে না। উল্লেখ্য যে এই আয়াতের শিক্ষা পরিধেয় বস্ত্র পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। মুমিনদের বিছানার চাদর, বালিসের কাভার, দরওয়াজা-জানালার পর্দা, আসবাব পত্র, গৃহের অভ্যন্তর এবং বহিরাংগন পরিচ্ছন্ন রাখাও এই শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।
পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّ اللهَ نَظِيْفٌ يُحِبُّ النَّظَافَةَ….فَنَظِّفُوْا اَفْنِيَتَكُمْ.
[ছালিই ইবনু আবি হাসসান (রহ), জামে আত তিরমিযী, হাদীস নাম্বার-২৭৩৬]
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পরিচ্ছন্ন, তিনি পরিচ্ছন্নতা ভালো বাসেন।… অতএব তোমরা তোমাদের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখ।’’
وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ.
অর্থ ‘এবং যাবতীয় মলিনতা থেকে দূরে থাক।’
এটি এই সূরার পঞ্চম আয়াত। এটিও একটি ব্যাপক অর্থবোধক আয়াত।
চিন্তা-চেতনায়, আচার-আচরণে এবং যাবতীয় কর্মকান্ডে জাহিলিয়াতের মলিনতার সামান্যতম ছোঁয়াও যেন লাগতে না পারে সেই জন্য অতন্দ্র প্রহরীর মতো সতর্ক থাকার জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
وَلاَ تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرُ.
অর্থ ‘এবং বেশি পাবে আশায় অনুগ্রহ করো না।’
এটি এই সূরার ষষ্ঠ আয়াত। আল্লাহর সার্বভৌমতেবর স্বীকৃতি আদায়ের প্রয়াসে নিয়োজিত ব্যক্তির জন্য এটি আবশ্যিকভাবে অনুসরণীয় একটি নীতি।
মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেওয়া, মানুষকে স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করা থেকে মুক্ত করে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল জীবন যাপনের দিকে টেনে আনা, মানুষের প্রতি অতি বড়ো অনুগ্রহ।
এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, এই বিরাট অনুগ্রহের কাজটি করতে হবে শুধু আল্লাহর জন্য, অন্য কারো কাছ থেকে কোন রূপ বিনিময় পাওয়ার জন্য নয়। পরিপূর্ণ নিঃস্বার্থতাসহকারে এই কাজ করতে হবে, কোনরূপ বৈষয়িক স্বার্থ-সুবিধা লাভের আশা মনে পোষণ করা যাবে না।
এই শিক্ষা আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন অন্য সব নবী-রাসূলকেও দিয়েছিলেন। তাই তো আমরা তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে শুনি,
وَمَآ اَسْئَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ اَجْرٍ ج اِنْ اَجْرِىَ اِلاَّ عَلى رَبِّ الْعلَمِيْنَ .
‘আমি তো তোমাদের কাছে এই কাজের কোন বিনিময় চাচ্ছি না। আমার বিনিময় তো রয়েছে রাববুল ‘আলামীনের নিকট।’
নূহ (আলাইহিস সালাম) কুর্দিস্তান-এর অধিবাসীদেরকে (আশ্ শূ‘আরা, ১০৯),
হূদ (আলাইহিস সালাম) ‘আদ জাতিকে (আশ্ শূ‘আরা, ১২৭),
ছালিহ (আলাইহিস সালাম) ছামুদ জাতিকে (আশ্ শূ‘আরা, ১৪৫),
লূত (আলাইহিস সালাম) ট্রান্সজর্ডনের অধিবাসীদেরকে (আশ্ শূ‘আরা, ১৪৬),
এবং শু‘আইব (আলাইহিস সালাম) মাদ্ইয়ানবাসীদেরকে (আশ্ শূ‘আরা, ১৮০),
সম্বোধন করে এ কথাই বলেছিলেন।
وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ.
এটি এই সূরার সপ্তম আয়াত। এটিও একটি তাৎপর্যপূর্ণ আয়াত।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবেমাত্র নবুওয়াতের দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করা হলো। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেওয়ার ডাক তিনি এখনো দেননি। ফলে ময়দানে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এখনো দেখা যায়নি। তথাপিও আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অগ্রিম জানিয়ে দিলেন যে অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য-পালন করতে গেলে তাঁকে বাধা-প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে। চলার পথের বাঁকে বাঁকে কঠিন পরিস্থিতির মুকাবিলা করতে হবে। বাধা যতোই কঠিন হোক না কেন, পরিস্থিতি যতোই ভীতিপ্রদ হোক না কেন তাঁকে কর্তব্য কর্মে দৃঢ়পদ থাকতে হবে।
৫। শিক্ষা
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব তথা সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাদেরকে নিবেদিত হতে হবে।
আমাদের পোশাক হতে হবে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন, রুচিশীল এবং গর্ব অহংকারের ছাপমুক্ত। আমাদের গৃহাংগন ও গৃহের পার্শ্বস্থ অংগনও হতে হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
আমাদের চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ এবং যাবতীয় কর্মকান্ড হতে হবে জাহিলিয়াতের মলিনতার ছোঁয়া মুক্ত।
আমাদেরকে আল্লাহর বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে হবে নিঃস্বার্থভাবে, কোনরূপ বৈষয়িক স্বার্থ সুবিধা লাভের আশা থেকে মনকে সম্পূর্ণ রূপে মুক্ত রেখে।
আমাদেরকে বিরোধিতা, বাধা-বিপত্তি এবং কঠিন পরিস্থিতির মুকাবিলায় আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ছবর অবলম্বন করতে হবে।
দারসুল কুরআন-২: হামীমুস সাজদাহ(আয়াত : ৩০-৩৩)
এ.কে.এম নাজির আহমদ
اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ .
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْم .
১। আয়াত
اِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلئِكَةُ اَلاَّ تَخَافُوْا وَلاَتَحْزَنُوْا وَاَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِىْ كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ ০
نَحْنُ اَوْلِيؤُكُمْ فِى الْحَيوةِ الدُّنْيَا وَفِى الاخِرَةِ ج وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَشْتَهِىْ اَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَدَّعُوْن ০
نُزُلاً مِّنْ غَفُوْرِ رَّحِيْمِ ০
وَمَنْ اَحْسَنُ قَوْلاً مِّمَّنْ دَعَا اِلَى اللهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَّقَالَ اِنَّنِىْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ ০
২। ভাবানুবাদ
৩০. ‘যেইসব লোক বলে : ‘আল্লাহ আমাদের রব’ এবং এই কথার ওপর অটল থাকে, নিশ্চয়ই তাদের প্রতি ফেরেশতা নাযিল হয় যারা বলতে থাকে, ‘ভয় পেয়োনা, চিন্তাক্লিষ্ট হয়ো না, আর সেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে সন্তুষ্ট হও তোমাদের জন্য যার ওয়াদা করা হয়েছে।’
৩১. আমরা এই দুনিয়ার জীবনে তোমাদের সংগী-সাথী, আখিরাতেও। সেখানে তোমরা যা আকাংখা করবে তা তোমাদের হবে, সেখানে তোমরা যা চাইবে তা-ই পাবে।
৩২. এ হচ্ছে ক্ষমাশীল মেহেরবান সত্তার পক্ষ থেকে মেহমানদারীর আয়োজন।
৩৩. ঐ ব্যক্তির কথার চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে যে লোকদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকে, আল-‘আমালুছ ছালিহ করে এবং বলে : ‘‘অবশ্যই আমি মুসলিমদের একজন।’
৩। পরিপ্রেক্ষিত
ঈসায়ী ৬১০ সনে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত লাভ করেন।
প্রথম তিনটি বছর তিনি নিরবে আদ্ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ-র কাজ করেন।
অতপর তিনি সরবে আদ্ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ-র কাজ শুরু করেন।
কিছুসংখ্যক সত্যসন্ধানী এবং সাহসী যুবক-যুবতী তাঁর আহবানে সাড়া দেন।
আবু জাহল আমর ইবনু হিশাম, উতবা ইবনু রাবীয়া, শাইবা ইবনু রাবীয়া, আল ওয়ালিদ ইবনুল মুগীরা, উমাইয়া ইবনু খালাফ, আস ইবনু ওয়াইল প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তাঁর আহবান কবুল করেনি।
ফলে আম-জনতা ইসলাম গ্রহণ করার সাহস পায় নি।
ইসলাম-বিদ্বেষীরা বিরোধিতা শুরু করে।
প্রথমে ঠাট্টা-বিদ্রূপ,
অতপর গালমন্দ,
অতপর হুমকি-ধমকি,
অতপর অপপ্রচার এবং
শেষাবধি দৈহিক নির্যাতন করে ইসলামের আলো নিভিয়ে দিতে চায় দুশমনেরা।
মুমিনগণ কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন।
[উসমান ইবনু আফফান (রা), তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রা), বিলাল ইবনু রাবাহ (রা), আবু ফাকীহা (রা), ইয়াসির (রা), সুমাইয়া বিনতু খুববাত (রা), উম্মু শুরাইক (রা), লুবাইনা (রা), খাববাব ইবনুল আরাত (রা) প্রমুখ দৈহিকভাবে নির্যাতিত হন।]
ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য ঘরদোর, বাগ-বাগিচা, পশু-পাল, ব্যবসা-বাণিজ্য-ইত্যাদি পেছনে ফেলে একদল মুমিন হাবশায় হিজরাত করেন।
উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) তখনো ইসলাম গ্রহণ করেন নি। হামজা ইবনু আবদিল মুত্তালিব (রা) তখন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
উতবা ইবনু রাবীয়ার অবান্তর প্রস্তাব-
একদিন কা‘বার চত্বরে একদিকে বসা ছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), অপর দিকে বসা ছিলো মুশরিক নেতাগণ।
অন্যতম মুশরিক নেতা উতবা ইবনু রাবীয়া বললো, ‘তোমরা একমত হলে আমি মুহাম্মাদের কাছে কতগুলো প্রস্তাব রাখতে চাই। তারা তার সাথে একমত হলে উতবা ইবনু রাবীয়া মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে এসে বসলো এবং ইসলাম প্রচার ত্যাগের শর্তে নিম্নের প্রস্তাবগুলো পেশ করলো :
‘‘ভাতিজা, তুমি যেই কাজ শুরু করেছো তার উদ্দেশ্য যদি হয় অর্থ-সম্পদ লাভ, তাহলে আমরা তোমাকে এতো অর্থ-সম্পদ দেবো যে তুমি হবে সবার চেয়ে বেশি ধনী। তুমি যদি শ্রেষ্ঠত্ব চাও, আমরা তোমাকে আমাদের নেতা বানিয়ে নেবো। তুমি যদি রাজা হতে চাও, আমরা তোমাকে আমাদের রাজা বানাবো। কিন্তু….।’’ উতবা ইবনু রাবীয়ার অবান্তর বক্তব্যের জওয়াবে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূরা হামীমুস সাজদাহ পড়া শুরু করেন এবং ৩৮ নাম্বার আয়াত পর্যন্ত পড়ে সাজদা করেন।
এই ঘটনাটি ঘটেছিল নবুওয়াতের পঞ্চম সনে।
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে নবুওয়াতের পঞ্চম সনের কোন এক সময় এই সূরাটি নাযিল হয়।
এই সূরাতে-
(১) ইসলাম-বিরোধীদের বিভিন্ন অযৌক্তিক প্রচারণার জওয়াব দেওয়া হয়েছে।
(২) মুমিনদের ওপর যুলম নির্যাতন চালানোর কারণে ইসলামবিরোধীদেরকে আযাবের ভয় দেখানো হয়েছে।
[হূদ (আ) এর কাউম বানু আদ এবং ছালিহ (আ)-এর কাউম বানু সামূদের ওপর নাযিলকৃত আযাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।]
(৩) নির্যাতিত মুমিনদেরকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে।
(৪) আর মুমিনদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ তো তারা যারা সর্বাবস্থায় আল ‘আমালুছ ছালিহ করে, লোকদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকে এবং দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করে : অবশ্যই আমি মুসলিমদের একজন।
৪। ব্যাখ্যা
قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ.
অর্থ : ‘তারা বলে : আল্লাহ আমাদের রব।’
‘রব’ মানে প্রভু, মুনীব, প্রতিপালক, তত্ত্বাবধায়ক, ক্ষমতাশালী-প্রতাপশালী-কর্তৃত্বশীল সত্তা ইত্যাদি।
‘‘আল্লাহ আমাদের রব’’- এই ঘোষণা দেওয়ার মানে হচ্ছে আল্লাহকে ‘‘প্রভু’’ বলে মেনে নেওয়া এবং নিজেরা তাঁর ‘‘আবদ’’ রূপে তাঁর প্রতি আনুগত্যশীল জীবন যাপনের সংকল্প ব্যক্ত করা।
‘‘আল্লাহ আমাদের রব’’- এই ঘোষণা দেওয়ার মানে হচ্ছে আল্লাহকে ‘‘মুনীব’’ বলে মেনে নেওয়া এবং নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে আল্লাহমুখী করা ও কর্মধারাকে আল্লাহমুখী করা।
‘‘আল্লাহ আমাদের রব’’- এই ঘোষণা দেওয়ার মানে হচ্ছে আল্লাহকে ‘‘প্রতিপালক’’ বলে বিশ্বাস করা এবং তাঁর প্রতিপালন ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল হওয়া।
‘‘আল্লাহ আমাদের রব’’- এই ঘোষণা দেওয়ার মানে হচ্ছে আল্লাহকে ‘‘তত্ত্বাবধায়ক’’ বলে মানা এবং তাঁর তত্ত্বাবধান ব্যবস্থার অধীনে আছি বলে বিশ্বাস রাখা।
‘‘আল্লাহ আমাদের রব’’- এই ঘোষণা দেওয়ার মানে হচ্ছে একমাত্র আল্লাহকে ‘‘ক্ষমতাশালী-প্রতাপশালী- কর্তৃত্বশীল’’ সত্তা রূপে গ্রহণ করে তাঁর প্রতি আত্মসমর্পী হওয়া।
‘‘আল্লাহ আমাদের রব’’- এই ঘোষণা দেওয়ার মানে হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর বড়ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব (সার্বভৌমত্ব) প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করা। কারণ, তাঁর নির্দেশ হচ্ছে- ‘‘ওয়া রাববাকা ফাকাবিবর।’’
ثُمَّ اسْتَقَامُوْا.
অর্থ : ‘অতপর ইসতিকামাত করে।’
[অর্থাৎ দৃঢ়তা-অটলতা-অবিচলতা অবলম্বন করে।]
(১) আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘‘বহু মানুষ আল্লাহকে তাদের রব বলে ঘোষণা করে, কিন্তু অধিকাংশ আবার কাফির হয়ে যায়। দৃঢ়পদ সেই ব্যক্তি যে মৃত্যু পর্যন্ত এই আকীদা অাঁকড়ে ধরে থাকে।’’
[আনাস ইবনু মালিক (রা), সুনানু আন-নাসায়ী, ইবনু আবী হাতিম, ইবনু জারীর।]
(২) আবু বাকর আছ্ ছিদ্দিক (রা) বলেছেন, ‘‘[দৃঢ়পদ ওই ব্যক্তিরা যারা ঈমান আনার পর] আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করে নি, তাঁকে ছাড়া আর কোন উপাস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় নি।’’ [ইবনু জারীর]
(৩) উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেন, ‘‘আল্লাহর শপথ, নিজ আকীদায় দৃঢ় ও স্থির তারাই যারা দৃঢ়ভাবে আল্লাহর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, শিয়ালের মতো এই দিক থেকে ঐ দিক, ঐ দিক থেকে এই দিকে ছুটে বেড়ায় না।’’ [ইবনু জারীর]
(৪) উসমান ইবনু আফফান (রা) বলেছেন, ‘‘(দৃঢ়পদ তারা) যারা নিজের আমলকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে।’’ [কাশ্ শাফ]
(৫) আলী ইবনু আবী তালিব (রা) বলেছেন, ‘‘(দৃঢ়পদ তারা যারা) আল্লাহর নির্ধারিত ফারযগুলো একনিষ্ঠভাবে আদায় করছে। [কাশ্ শাফ]
(৬) দৃঢ়পদ ব্যক্তিদের সম্পর্কে এই যুগের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ) বলেছেন, ‘‘অর্থাৎ হঠাৎ কখনো রব বলে ঘোষণা করে থেমে যায় নি এবং এমন ভ্রান্তিতেও লিপ্ত হয় নি যে আল্লাহকে তো রব বলে ঘোষণা করেছে, আবার তার সাথে অন্যদেরকেও রব বলে মেনে নিয়েছে। বরং একবার এই আকীদা গ্রহণ করার পর সারা জীবন এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকেছে। এর পরিপন্থী কোন আকীদা গ্রহণ করে নি কিংবা এর সাথে কোন বাতিল আকীদার সংমিশ্রণও ঘটায় নি এবং নিজের কর্মজীবনে তাওহীদী আকীদার দাবিগুলো পূরণ করেছে।’’
দ্রষ্টব্য : তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী, সূরা হামীমুস সাজদাহর তাফসীরের ৩৩ নাম্বার টীকা।
تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلئِكَةُ.
অর্থ : ‘তাদের প্রতি ফেরেশতা নাযিল হয়।’
ফেরেশতাগণ আল্লাহর সাম্রাজ্যের বিশ্বস্ত কর্মচারী। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাঁদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রেখেছেন।
(১) একদল ফেরেশতা আল্লাহর আরশ বহন করেন।
(২) একদল ফেরেশতা পাহাড়-পর্বত তত্ত্বাবধান করেন।
(৩) একদল ফেরেশতা নদী-সাগর-মহাসাগর তত্ত্বাবধান করেন।
(৪) একদল ফেরেশতা বাতাস প্রবাহিত করেন।
(৫) একদল ফেরেশতা মেঘ পরিচালনা করেন।
(৬) একদল ফেরেশতা মানুষের তাকদীর লিপিবদ্ধ করেন।
(৭) একদল ফেরেশতা মানুষের রিযকের ব্যবস্থা করেন।
(৮) একদল ফেরেশতা মানুষের আমলনামা লিপিবদ্ধ করেন।
(৯) একদল ফেরেশতা অবাধ্য জাতিকে শাস্তি দেন।
(১০) আজরাঈলের (আ) নেতৃত্বে একদল ফেরেশতা মানুষের রূহ কবজ করেন।
(১১) একদল ফেরেশতা মানুষকে কবরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
(১২) একদল ফেরেশতা জাহান্নামের তত্ত্বাবধান করেন।
(১৩) একদল ফেরেশতা জান্নাতের তত্ত্বাবধান করেন।
(১৪) অন্যতম ফেরেশতা ইসরাফিল (আ) বিউগল হাতে নিয়ে ফুঁ দেওয়ার জন্য আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন।
(১৫) জিবরাঈল (আ) নবী রাসূলদের নিকট আল্লাহর ওহী নিয়ে আসতেন। এখন তিনি লাইলাতুল কাদরে বহু সংখ্যক ফেরেশতা নিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসেন।
এখানে বিশেষ এক শ্রেণীর ফেরেশতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এই ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশে মাযলুম মুমিনদের মনে হিম্মাত, নিশ্চিন্ততা এবং প্রশান্তি সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করেন। আর মুমিনদেরকে অনাগত সফলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
نُزُلاً مِّنْ غَفُوْرِ رَّحِيْمٍ.
অর্থ : ‘ক্ষমাশীল মেহেরবান সত্তার পক্ষ থেকে মেহমানদারীর আয়োজন।’
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন দৃঢ়পদ মুমিনদের মেহমানদারীর জন্য জান্নাত প্রস্ত্তত করে রেখেছেন।
(১) জান্নাত মহাবিস্তৃত আরামদায়ক স্থান।
وَسَارِعُوْا اِلى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّموتُ وَالاَرْضُ ০
সূরা আলে ইমরান \ ১৩৩
‘এবং দ্রুত এগিয়ে চল তোমাদের রবের মাগফিরাত এবং জান্নাতের দিকে যার প্রশস্ততা আসমান ও পৃথিবীর প্রশস্ততার সমান।’
سَابِقُوْا اِلى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ والاَرْضِ ০
সূরা আল হাদীদ \ ২১
‘তোমরা প্রতিযোগিতা করে দ্রুত এগিয়ে চল তোমাদের রবের মাগফিরাত এবং জান্নাতের দিকে যার প্রশস্ততা আসমান ও পৃথিবীর প্রশস্ততার সমান।’
একজন কম মর্যাদাবান জান্নাতীও পাবেন বর্তমান পৃথিবীর দশ গুণ বড়ো স্থান।
(২) জান্নাত অগণিত অফুরন্ত নিয়ামতে পরিপূর্ণ স্থান।
لَهُمْ مَا يَشَائُوْنَ فِيْهَا وَلَدَيْنَا مَزِيْدٌ ০
সূরা কা-ফ \ ৩৫
‘সেখানে তারা যা চাইবে তা-ই পাবে। আর আমার কাছে আরো বহু কিছু রয়েছে তাদের জন্যে।’
اَعَدَدْتُ لِعِبَادِىَ الصَّالِحِيْنَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ وَلاَ اُذُنٌ سَمِعَتْ وَلاَ خَطَرَ عَلى قَلْبِ بَشَرٍ ০
ছহীহ আলবুখারী।
আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার ছালিহ বান্দাদের জন্য এমন সব নিয়ামত মওজুদ করে রেখেছি যা কোন চোখ কখনো দেখে নি, যার কথা কোন কান কখনো শুনে নি এবং যার ধারণা কোন হৃদয়ে কখনো উদিত হয় নি।’
(৩) জান্নাতের জীবন অনন্ত জীবন।
পৃথিবীর জীবন রোগ-শোকযুক্ত জীবন।
পৃথিবীর জীবন অভাব-অনটনযুক্ত জীবন।
পৃথিবীর জীবন ক্ষয়যুক্ত জীবন।
পৃথিবীর জীবন মৃত্যুযুক্ত জীবন।
পক্ষান্তরে-
জান্নাতের জীবন রোগ-শোক মুক্ত জীবন।
জান্নাতের জীবন অভাব-অনটন মুক্ত জীবন।
জান্নাতের জীবন ক্ষয় মুক্ত জীবন।
জান্নাতের জীবন মৃত্যু মুক্ত জীবন।
উল্লেখ্য যে-
অনন্ত জীবন এবং অক্ষয় সাম্রাজ্য লাভের আকাংখা মানুষের মনের গভীরে প্রোথিত দুইটি প্রধান আকাংখা।
এই দুইটি আকাংখাকে উসকে দিয়ে ইবলীস আদম (আ)কে ধোঁকা দিয়েছিলো।
সে বলেছিলো-
‘‘ইয়া আদামু হাল আদুল্লুকা ‘আলা শাজারাতিল খুলদি ওয়া মুলকিন লা ইয়াবলা।’’ [সূরা তা-হা \ ১২০]
‘হে আদম, আমি কি তোমাকে এমন গাছের সন্ধান দেবো যার ফল খেলে তুমি অনন্ত জীবন ও অক্ষয় সাম্রাজ্য লাভ করবে।’
কিন্তু পৃথিবীর জীবনে মানুষের এই দুইটি আকাংখা পূর্ণ হবার নয়। এই দুইটি আকাংখা পূর্ণ হবার স্থান জান্নাত।
وَمَنْ اَحْسَنَ قَوْلاً مِّمَّنْ دَعَا اِلَى اللهِ.
অর্থ : ‘ঐ ব্যক্তির কথার চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে যে লোকদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকে।’
প্রতিদিন আমরা অসংখ্য কথা বলে থাকি। যেই কথাগুলো বলে আমরা লোকদেরকে আল্লাহর পথে ডাকি সেই কথাগুলোকেই সর্বোত্তম কথা বলে আল্লাহ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। অর্থাৎ এই কথা বলাতেই যেন আমরা ব্যস্ত থাকি সেই ব্যাপারে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করছেন।
আবার আদ্-দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ-র (ক) কর্ম-কৌশল, (খ) দা‘ওয়াত প্রদানের কাংখিত মান এবং (গ) পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন আল কুরআনে নিম্নরূপ ধারণা ব্যক্ত করেছেন :
اُدْعُ اِلى سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِىْ هِىَ اَحْسَنُ ط اِنَّ رَبَّكَ هُوَ اَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيْلِه وَهُوَ اَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ ০
আন-নাহল \ ১২৫
‘তোমার রবের পথে লোকদেরকে ডাক বিজ্ঞতা সহকারে, সুন্দর বক্তব্যের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে যুক্তি-তর্ক কর অতীব উন্নত মানে। অবশ্যই তোমার রব ভালো করেই জানেন কে তাঁর পথ থেকে সরে গেছে এবং তিনি জানেন কে সঠিক পথ প্রাপ্ত।’
وَمَا عَلَى الرَّ سُوْلِ اِلاَّ الْبَلغُ الْمُبِيْنُ ০
সূরা আন্ নূর \ ৫৪, আল ‘আনকাবূত \ ১৮
‘আর সুস্পষ্টভাবে আমার পয়গাম (লোকদের কাছে) পৌঁছিয়ে দেওয়াই রাসূলের কর্তব্য।’
اِنَّكَ لاَ تَهْدِىْ مَنْ اَحْبَبْتَ وَلكِنَّ اللهَ يَهْدِىْ مَنْ يَّشَاءُ ج وَهُوَ اَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ ০
সূরা আল কাসাস \ ৫৬
‘তুমি যাকে চাও তাকেই হিদায়াত করতে পার না। আল্লাহ যাকে চান তাকেই হিদায়াত করেন। আর তিনি হিদায়াত প্রাপ্তদেরকে ভালো করেই জানেন।’
اِنْ تَحْرِصْ عَلى هُدهُمْ فَاِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِىْ مَنْ يُّضِلُّ وَمَا لَهُمْ مِّنْ نّصِرِيْنَ ০
সূরা আন্ নাহল \ ৩৭
‘তুমি তাদের হিদায়াতের জন্য যতোই লালায়িত হওনা কেন আল্লাহ যাদেরকে গুমরাহ করে দিয়েছেন তাদেরকে হিদায়াত দেন না। আর এই ধরনের লোকদেরকে কেউ সাহায্য করতে পারে না।’
وَعَمِلَ صَالِحًا.
অর্থ : ‘এবং আল ‘আমালুছ ছালিহ করে।’
এই কথাটির মাধ্যমে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন সূক্ষ্মভাবে আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, দা‘য়ী ইলাল্লাহর মুখের কথা ও কাজে বৈপরীত্য থাকতে পারে না।
প্রশ্নবিদ্ধ চরিত্র, প্রশ্নবিদ্ধ লেনদেন এবং প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ মুখে উচ্চারিত সুন্দর কথাগুলোর প্রভাব বিনষ্ট করে দেয়।
وَقَالَ اِنَّنِىْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ.
অর্থ : ‘এবং বলে : অবশ্যই আমি মুসলিমদের একজন।’
এই কথাটির মাধ্যমে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বুঝাতে চাচ্ছেন যে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূল হোক, কিংবা প্রতিকূল, প্রকৃত মুমিনকে সর্বাবস্থায় তার মুসলিম আইডেনটিটি নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে।
৫। শিক্ষা
আল্লাহকে নিজেদের রব বলে ঘোষণা দিয়ে যারা নিজেদের চিন্তা ও কর্মে তার প্রতিফলন ঘটায়, বিশেষ করে ‘আদ্ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহর-র’ কাজে আত্মনিয়োগ করে এবং প্রতিকূলতাসত্বেও মুসলিম আইডেনটিটি নিয়ে মাথা উচুঁ করে দাঁড়ায়, সম্মানিত ফেরেশতাগণ হন তাদের বন্ধু এবং আখিরাতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাদেরকে বিপুলভাবে পুরস্কৃত করবেন।
দারসুল কুরআন-৩:সূরা আশ্ শূরা(আয়াত-১৩)
এ.কে.এম.নাজির আহমদ
اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ .
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْم .
১। আয়াত
شَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّيْنِ مَا وَصّى بِه نُوْحًا وَالَّذِي اَوْحَيْنَا اِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ اِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسى وَعِيسى اَنْ اَقِيْمُوْا الدِّيْنَ وَلاَ تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ ط كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِيْنَ مَا تَدْعُوْهُمْ اِلَيْهِ ط اللهُ يَجْتَبِىْ اِلَيْهِ مَن ْيَشَاءُ وَيَهْدِىْ اِلَيْهِ مَنْ يُّنِيْبُ ০
২। ভাবানুবাদ
‘তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য দীনের সেই বিধান নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং যা এখন আমি তোমার নিকট ওহীর মাধ্যমে পাঠাচ্ছি এবং যার নির্দেশ আমি দিয়েছিলাম ইবরাহীমকে, মূসাকে এবং ঈসাকে, (আর তা হচ্ছে 🙂 ‘‘এই দীন কায়েম কর এবং এতে বিভেদ-বিভক্তি-বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করো না।’’ তুমি মুশরিকদেরকে যেই দিকে আহবান জানাচ্ছো তা তাদের নিকট খুবই অপছন্দনীয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা আপন করে নেন এবং যেই ব্যক্তি তাঁর দিকে আসতে চায় তিনি তাকে পথ দেখান।’
৩। পরিপ্রেক্ষিত
ঈসায়ী ৬১০ সনে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত লাভ করেন।
প্রথম তিনটি বছর তিনি নিরবে আদ্দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহর কাজ করতে থাকেন।
তিন বছর পর আল্লাহ রাববূল ‘আলামীন তাঁকে সরবে আদ্ দা‘ওয়াত দেওয়ার নির্দেশ দেন।
নির্দেশ পেয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আছ্ ছাফা পাহাড়ে উঠে ‘ইয়া সাবাহাহ’, ‘ইয়া সাবাহাহ’ ধ্বনি দেন।
সেই ধ্বনি শুনে লোকেরা পাহাড়ের পাদদেশে জড়ো হলে তিনি একটি দা‘ওয়াতী বক্তব্য পেশ করেন।
অতপর শুরু হয় বিরোধিতা। গালমন্দ, হুমকি-ধমকি, অপ-প্রচার এবং শেষাবধি শুরু হয় দৈহিক নির্যাতন।
নবুওয়াতের পঞ্চম সনে নির্যাতিত মুসলিমরা গোপনে হাবশায় হিজরাত করে যেতে থাকেন।
এই কঠিন সময়ে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন নাযিল করেন সূরা হামীমুস্ সাজদাহ। এর পরই নাযিল করেন সূরা আশ্ শূরা।
এই সূরাতে ইসলাম বিদ্বেষীদের অবান্তর অভিযোগের জওয়াব দেওয়া হয়েছে।
কল্যাণকামী নবীর পজিশন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহই যে একমাত্র সার্বভৌম সত্তা সেই কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
সকল নবী যে একই দীন নিয়ে এসেছিলেন এবং ইকামাতুদ দীনই যে ছিলো তাঁদের জীবন মিশন সেই সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। দুনিয়ায় স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করলে আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে- সেই সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে।
৪। ব্যাখ্যা
شَرَعَ لَكُمْ.
অর্থ : ‘তোমাদের জন্য তিনি (আল্লাহ) নির্ধারিত করেছেন।’
এখানে ‘‘তোমাদের জন্য’’ বাক্যাংশ দ্বারা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর অনুসারীদেরকে বুঝানো হয়েছে।
আমরা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসারী। অতএব আমরা এই সম্বোধিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত।
اَلدِّيْنُ.
অর্থ : ‘আদ্ দীন’ শব্দের বহু ক’টি অর্থ রয়েছে।’
এই শব্দটির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ হচ্ছে : আইন-কানুন, বিধি-বিধান, আনুগত্য-বিধান এবং জীবন বিধান।
اِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الاِسْلاَمُ ০
সূরা আলে ইমরান \ ১৯
‘‘আল্লাহর নিকট আল-ইসলামই এক মাত্র দীন।’’
আল-ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন কর্তৃক তাঁর সৃষ্টির জন্য নির্ধারিত বিধান। গোটা বিশ্বময় প্রতিষ্ঠিত, প্রাকৃতিক আইন বলে পরিচিত, বিধানগুলো আসলে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিধান।
বিশেষ অর্থে আল-ইসলাম হচ্ছে মানুষের জন্য আল্লাহ-প্রদত্ত জীবন বিধান।
আল্লাহ-প্রদত্ত জীবন বিধান নির্ভুল, ভারসাম্যপূর্ণ এবং কল্যাণকর।
আল্লাহ চান, মানুষ শুধু আল-ইসলামকেই তাদের জীবন বিধানরূপে গ্রহণ করুক।
অপর কারো রচিত জীবন বিধান পরিহার করে চলুক।
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الاِسْلاَمِِ دِيْنًا فَلَنْ يُّقْبَلَ مِِنْهُ ج وَهُوَ فِي الآخِرَةِ مِنَ الْخسِرِيْنَ ০
সূলা আলে ইমরান \ ৮৫
‘এবং কোন ব্যক্তি যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন বিধান তালাশ করে তা কখনো কবুল করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’
اَقِيْمُوْا الدِّيْنَ.
অর্থ- ‘দীন কায়েম কর।’
অর্থাৎ আল-ইসলাম কায়েম কর। (কায়েম হয়ে গিয়ে থাকলে তা কায়েম রাখ।]
আলোচ্য আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে নূহ (আ), ইবরাহীম (আ), মূসা (আ) এবং ঈসা (আ)-এর প্রতিও একই নির্দেশ ছিলো।
মানব ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ের কয়েকজন নবীর নাম এই আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আসলে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বুঝাতে চাচ্ছেন যে সকল নবীরই জীবন মিশন ছিলো ইকামাতুদ্ দীন।
নবীর উম্মাতের জীবন মিশনও ইকামাতুদ্ দীন।
আমরা সর্বশেষ নবীর উম্মাত।
আমাদের জীবন মিশনও ইকামাতুদ্ দীন।
যেই আল্লাহ ‘‘আকীমুছ্ ছালাত’’ নির্দেশ দেওয়ার কারণে ছালাত কায়েম করা ফারয হয়েছে, সেই আল্লাহই নির্দেশ দিয়েছেন ‘‘আকীমুদ্ দীন’’, অতএব দীন কায়েম করাও ফারয।
‘‘আকীমুছ ছালাত’’ বাক্যাংশে রয়েছে দীনের একটি অংশ কায়েম করার নির্দেশ।
‘‘আকীমুদ দীন’’ বাক্যাংশে রয়েছে গোটা দীন কায়েম করার নির্দেশ।
নবীগণ তাঁদের নিজ নিজ উম্মাতকে ছালাত কায়েমের পদ্ধতি শিখিয়েছেন।
আবার, তাঁরা নিজ নিজ উম্মাতকে দীন কায়েমের পদ্ধতিও শিখিয়েছেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উম্মাতকে ছালাত কায়েমের পদ্ধতি শিখিয়েছেন।
আবার, তিনি দীন কায়েমের পদ্ধতিও শিখিয়েছেন।
তিনি যেইভাবে ছালাত কায়েম করেছেন, আমরা যদি সেইভাবে ছালাত কায়েম করি তবেই তা আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে।
আবার, তিনি যেইভাবে দীন কায়েম করেছেন, আমরা যদি সেইভাবে দীন কায়েমের প্রচেষ্টা চালাই তবেই তা আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে।
তবে, অটোমেটিক দীন কায়েম হয় না।
জোর জবরদস্তি করে দীন কায়েম করা যায় না।
لاَ اِكْرَاهَ فِى الدِّيْنِ ০
সূরা আল বাকারা \ ২৫৬
‘দীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই।’
অতএব কোন ভূ-খন্ডে দীন কায়েম করতে হলে প্রথমে দীনের মৌলিক শিক্ষাগুলোর সাথে সেই ভূ-খন্ডের আম-জনতার পরিচয় ঘটাতে হবে।
নিম্নোক্ত কথাগুলো অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে :
আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, অতুলনীয়, সর্বজ্ঞানী, সর্বদ্রষ্টা, সর্বশ্রোতা, সর্বশক্তিমান, অমুখাপেক্ষী, চিরঞ্জীব সত্তা।
আল্লাহ মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। এই মহাবিশ্বের মালিকানায় এবং পরিচালনায় তাঁর কোন অংশীদার নেই।
এই পৃথিবী মহাবিশ্বের অংশ। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এই পৃথিবীতে তাঁর আবদ্ এবং খালীফারূপে কর্তব্য পালনের জন্য।
মানুষের সুন্দর জীবন, সুন্দর সমাজ-সভ্যতা বিনির্মাণের জন্য তিনি নবীদের মাধ্যমে জীবন বিধান পাঠিয়েছেন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ নবী এবং আল কুরআন আল্লাহ প্রদত্ত সর্বশেষ কিতাব।
মানুষের কর্তব্য হচ্ছে নবীর নির্দেশনা মতো আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান নিজেদের জীবন ও সমাজ জীবনে কায়েম করা।
আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং কর্ম প্রচেষ্টার স্বাধীনতা দিয়েছেন। মানুষ এই স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করে, না অপ-ব্যবহার করে তারই পরীক্ষা চলছে।
আল্লাহ সরাসরি মানুষের সকল কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করছেন। তদুপরি মানুষের কর্মকান্ডের বিবরণ তৈরির জন্য তিনি প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে দুইজন ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন।
মানুষের পৃথিবীর জীবন মৃত্যু-যুক্ত জীবন। কোনভাবেই মৃত্যুকে এড়ানো যাবে না।
আল্লাহ কোন এক সময় বর্তমান মহাবিশ্ব ভেংগে দেবেন এবং নতুন বিন্যাসে আসমান ও পৃথিবী তৈরি করবেন।
নতুনভাবে গড়া পৃথিবীর বিশাল প্রান্তরে সকল মানুষকে জীবিত করে ওঠানো হবে। সকলেই উপস্থিত হবে আল্লাহর আদালতে। প্রত্যেক ব্যক্তির সম্মুখে ফেরেশতাদের তৈরি করা আমলনামা বা কর্মকান্ডের বিবরণ পেশ করা হবে। চলবে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ। জওয়াবদিহিতা।
যারা আল্লাহর আবদ্ ও খালীফারূপে তাদের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করে যাবে তাদেরকে অফুরন্ত নিয়ামতে ভরপুর জান্নাতে পাঠানো হবে।
পক্ষান্তরে যারা স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করে যাবে তাদেরকে কঠিন শাস্তির স্থান জাহান্নামে ঢুকানো হবে।
আখিরাতের জীবন মৃত্যুহীন জীবন, অনন্ত জীবন। সেই জীবনের ব্যর্থতাই প্রকৃত ব্যর্থতা। আর সেই জীবনের সফলতাই প্রকৃত সফলতা।
এই মৌলিক কথাগুলোকে যারা মনে-প্রাণে গ্রহণ করেন তাঁরাই হতে পারেন দীন কায়েমের কর্মী।
আবার কোন ভূ-খন্ডের আম-জনতা যখন এই কথাগুলো মনে-প্রাণে গ্রহণ করেন তখনই তৈরি হয় দীন কায়েমের জন্য অত্যাবশ্যক গণ-ভিত্তি।
وَلاَ تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ.
‘এবং দীনের মধ্যে বিভেদ-বিভক্তি-বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করো না।’
উল্লেখ্য যে গোড়াতে সকল মানুষ ছিলো একই দীনের অনুসারী, একই উম্মাত। পরবর্তী সময়ে লোকেরা দীনকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে এবং নিজেরা বহু সংখ্যক উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে।
সকল মানুষকে নতুন করে একই দীনের অনুসারী এবং একই উম্মাতে পরিণত করার প্রয়াস চালিয়েছেন নবী-রাসূলগণ। পৃথিবীতে যতো নবী এসেছেন তাঁদের সকলেই একই দীন নিয়ে এসেছেন।
সূরা আল মু’মিনূন \ ৫২-৫৩
‘তোমাদের এই উম্মাত একই উম্মাত। আমি তোমাদের রব, অতএব আমাকে ভয় করে চল। কিন্তু পরে লোকেরা দীনকে নিজেদের মধ্যে টুকরো টুকরো করে নিয়েছে। প্রত্যেক দলের কাছে যা কিছু আছে তা নিয়েই তারা সন্তুষ্ট।’
اِنَّ هذِه اُمَّتُكُمْ اُمَّةً وَّاحِدَةً ز وَّ اَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوْنِ وَتَقَطَّعُوْا اَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ ط كُلُّ اِلَيْنَا رجَعُوْنَ ০
সূরা আল আম্বিয়া \ ৯২-৯৩
‘নিশ্চয়ই তোমাদের এই উম্মাত একই উম্মাত। আমি তোমাদের রব, অতএব আমারই ইবাদাত কর। কিন্তু লোকেরা দীনকে নিজেদের মধ্যে টুকরো টুকরো করে ফেললো। সবাই আমার দিকেই প্রত্যাবর্তনশীল।’
فَوَيْلٌ لِّلَّذِيْنَ يَكْتُبُوْنَ الْكِتبَ بِاَيْدِيْهِمْ ق ثُمَّ يَقُوْلُوْنَ هـذَا مِنْ عِنْدِ اللّهِ لِيَشْتَرُوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيْلاً ط فَوَيْلٌ لَّهُمْ مِّمَّا كَتَبَتْ اَيْدِيْهِمْ وَوَيْلٌ لَّهُمْ مِّمَّا يَكْسِبُوْنَ ০
সূরা আল বাকারা \ ৭৯
‘অতএব তাদের জন্য ধ্বংস অবধারিত যারা নিজের হাতে লিখন লিখে লোকদেরকে বলে ‘এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে।’ এইভাবে তারা সামান্য স্বার্থ হাছিল করে থাকে। তাদের হাতের এই লিখন তাদের ধ্বংসের কারণ এবং তাদের এই উপার্জনও তাদের ধ্বংসের উপকরণ।’’
…وَقَدْ كَانَ فَرِيْقٌ مِّنْهُمْ يَسْمَعُوْنَ كَلمَ اللّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُوْنَه مِنْم بَعْدِ مَا عَقَلُوْهُ وَهُمْ يَعْلَمُوْنَ.
সূরা আল বাকারা \ ৭৫
‘এবং তাদের একটি দলের চিরাচরিত রীতি এই যে তারা আল্লাহর বাণী শুনার পর জেনে শুনে তাতে তাহরীফ বা বিকৃতি সাধন করে।’
….وَمَا اخْتَلَفَ فِيْهِ اِلاَّ الَّذِينَ اُوتُوهُ مِنْم بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيّنتُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ ج
সূরা আল বাকারা \ ২১৩
‘‘এবং মতভেদ তারাই করেছে যাদেরকে সত্যের জ্ঞান দেয়া হয়েছিলো। তারা সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ লাভ করার পরও কেবল পরস্পরের ওপর বাড়াবাড়ি করতে চাচ্ছিলো বলেই সত্য পরিহার করে বিভিন্ন পথ উদ্ভাবন করে নিয়েছে।’
اِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الاِسْلاَمُ قف وَمَاخْتَلَفَ الَّذِيْنَ اُوْتُوا الْكِتبَ اِلاَّ مِنْ بَعْدِ مَاجَاءَ هُمُ الْعِلْمُ بَغْيًام بَيْنَهُمْ ط
সূরা আলে ইমরান \ ১৯
‘আল্লাহর কাছে ইসলামই একমাত্র দীন। যাদেরকে এই কিতাব দেওয়া হয়েছিলো তারা প্রকৃত জ্ঞান এসে যাওয়ার পরও পরস্পরের ওপর বাড়াবাড়ি করার জন্যই বিভিন্ন পথ উদ্ভাবন করে নিয়েছে।’
‘‘দুনিয়ার যেই কোন জাতির ওপর যেই কিতাবই নাযিল হয়েছে তা ইসলামেরই শিক্ষা দান করেছে। এই আসল দীনকে বিকৃত করে এবং তার মধ্যে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে যেই সব ধর্ম মানুষের মধ্যে প্রচলিত হয়েছে, সেইগুলোর উদ্ভবের কারণ এই ছাড়া আর কিছুই ছিলো না যে লোকেরা নিজেদের বৈধ সীমা অতিক্রম করে অধিকার, স্বার্থ ও বিশিষ্টতা অর্জন করতে চেয়েছে। আর এইগুলো অর্জন করতে গিয়ে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো আসল দীনের আকীদা-বিশ্বাস, মূলনীতি এবং বিস্তারিত বিধান পরিবর্তন করে ফেলেছে।’ [তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ), সূরা আলে ইমরানের তাফসীরের ১৭ নাম্বার টীকা।]
اِنَّ الَّذِيْنَ فَرّّقُوْا دِيْنَهُمْ وَكَانُوْا شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِىْ شَيئٍ ط
সূরা আল আন‘আম \ ১৫৯
‘যারা নিজেদের দীনকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে, নিঃসন্দেহে তাদের সাথে তোমাদের কোন সম্পর্ক নেই।’
‘এখানে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাধ্যমে আল্লাহর দীনের সকল অনুসারীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। এই প্রসংগে আল্লাহর বক্তব্যের সার নির্যাস হচ্ছে : এক আল্লাহকে রব ও ইলাহ বলে মেনে নাও। আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা এবং অধিকারে কাউকে শরীক করো না। আল্লাহর সামনে জওয়াবদিহি করতে হবে মনে করে আখিরাতের প্রতি ঈমান আন। আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং কিতাবগুলোর মাধ্যমে যেই ব্যাপক মূলনীতি ও মৌল বিষয়ের শিক্ষা দিয়েছেন সেই অনুযায়ী জীবন যাপন কর। এইগুলো চিরকাল আসল দীন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে এবং এখনো যথার্থ দীন বলতে এইগুলোকেই বুঝায়। শুরু থেকে প্রত্যেক মানুষকে এই দীনই দেওয়া হয়েছিলো। পরবর্তীকালে বিভিন্ন যুগের লোকেরা তাদের নিজস্ব চিন্তা ও মানসিকতার ভ্রান্ত উদ্ভাবনী ক্ষমতার সাহায্যে অথবা নিজেদের প্রবৃত্তি ও লালসার মাত্রাতিরিক্ত প্রভাবে অথবা ভক্তির আতিশয্যে এই আসল দীনকে বিকৃত করে বিভিন্ন প্রকার ধর্মের সৃষ্টি করেছে। এই দীনের মধ্যে তারা নতুন নতুন কথা মিশিয়ে নিয়েছে। নিজেদের কু-সংস্কার, কল্পনা-বিলাস, আন্দাজ-অনুমান এবং নিজেদের দার্শনিক চিন্তাভাবনার ছাঁচে ফেলে তার আকীদা-বিশ্বাসে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে এবং কাটাই-ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে তাকে পুরোপুরি বিকৃত করে দিয়েছে। অনেক নতুন বিষয় উদ্ভাবন করে তার বিধানসমূহের সাথে জুড়ে দিয়েছে। মনগড়া আইন রচনা করে নিয়েছে। আইনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে অযথা চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। ছোটখাট বিষয়গুলো নিয়ে মত বিরোধ করার ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করেছে। গুরুত্বপূর্ণকে গুরুত্বহীন এবং গুরুত্বহীনকে গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে দিয়েছে।
যেইসব নবী-রাসূল এই দীন প্রচার করেছেন এবং যেইসব বুযর্গ ব্যক্তি এই দীনের প্রতিষ্ঠায় জীবনপাত করে গেছেন তাদের কারো কারো প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশের ক্ষেত্রে অত্যধিক বাড়াবাড়ি করেছে। আবার কারো কারো প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটিয়েছে এবং তাদের বিরোধিতা করেছে। এইভাবে অসংখ্য ধর্ম ও ধর্মীয়-সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে। এইসব ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব মানব সমাজকে কলহ-বিবাদ ও পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত করেছে। এইভাবে মানব সমাজ দ্বন্দ্বমুখর দল উপদলে বিভক্ত হয়ে চলেছে। কাজেই বর্তমানে যেই ব্যক্তিই আসল দিনের অনুসারী হবে, তার জন্য এইসব বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় ও দলাদলি থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া এবং তাদের থেকে নিজেদের পথকে আলাদা করে নেওয়াই হবে অপরিহার্য।’’
[তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ), সূরা আল আন‘আমের তাফসীরের ১৪১ নাম্বার টীকা।]
আসল দীনের অনুসারীদের ওপর এই কর্তব্য বর্তায় যে তারা সত্য দীনের ভেতর পুরোপুরি প্রবেশ করবে।
ياَيُّهَا الَّذِينَ امَنُوْا ادْخُلُوْا فِي السِّلْمِ كَافَّةً ص وَلاَ تَتَّبِعُوْا خُطُوتِ الشَّيْطَنِ ط اِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ ০
সূরা আল বাকারা \ ২০৮
‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ কর। শাইতানের পদাংক অনুসরণ করো না। অবশ্যই সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন।’
এটাও তাদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য যে তারা দীনকে টুকরো টুকরো করার অপরাধে অপরাধী হবে না বরং গোটা দীনকে সংঘবদ্ধভাবে মজবুতভাবে অাঁকড়ে ধরবে।
وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللّهِ جَمِيعًا وَلاَ تَفَرَّقُواْ ص
সূরা আলে ইমরান \ ১০৩
‘এবং তোমরা সবাই সংঘবদ্ধ হয়ে দৃঢ়ভাবে আল্লাহর রজ্জুকে (ইসলামকে) অাঁকড়ে ধর এবং দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ো না।’
তদুপরি এটাও তাদের অন্যতম অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য যে অপরাপর মানুষের সামনে দীনকে পরিচিত করে তোলা কালে তারা দ্বিধাহীন চিত্তে, কোন অংশ গোপন না করে, গোটা দীনকেই উপস্থাপন করবে।
اِنَّ الَّذِيْنَ يَكْتُمُوْنَ مَا اَنْزَلَ اللّهُ مِنَ الْكِتبِ وَيَشْتَرُوْنَ بِهِ ثَمَنًا قَلِيْلاً لا اُولَـئِكَ مَا يَأْكُلُوْنَ فِيْ بُطُوْنِهِمْ اِلاَّ النَّارَ وَلاَ يُكَلِّمُهُمُ اللّهُ يَوْمَ الْقِيمَةِ وَلاَ يُزَكِّيْهِمْ ج وَلَهُمْ عَذَابٌ اَلِيْمٌ ০
সূরা আল বাকারা \ ১৭৪
‘অবশ্যই আল্লাহ তাঁর কিতাবে যেইসব বিধান নাযিল করেছেন যারা সেইগুলো গোপন করে এবং সামান্য পার্থিব স্বার্থে সেইগুলো বিসর্জন দেয়, তারা আসলে আগুন দিয়ে নিজের পেট ভরতি করছে। কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথাই বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’
اِنَّ الَّذِيْنَ يَكْتُمُوْنَ مَا اَنزَلْنَا مِنَ الْبَيّنتِ وَالْهُدى مِنم بَعْدِ مَا بَيَّنّهُ لِلنَّاسِ فِى الْكِتبِ لا اُولَـئِكَ يَلعَنُهُمُ اللّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّعِنُوْنَ ০
সূরা আল বাকারা \ ১৫৯
‘যারা আমার অবতীর্ণ শিক্ষাগুলো ও বিধানগুলো গোপন করে, অথচ গোটা মানব জাতিকে পথের সন্ধান দেবার জন্য আমি সেইগুলো আমার কিতাবে বর্ণনা করে দিয়েছি, অবশ্যই আল্লাহ তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করেন এবং সকল অভিশাপ বর্ষণকারীরা তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করে।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
فَلَعَلَّكَ تَارِكٌم بَعْضَ مَا يُوْحَى اِلَيْكَ وَضَآئِقٌم بِه صَدْرُكَ اَنْ يَقُوْلُوْا لَوْلاَ اُنْزِلَ عَلَيْهِ كَنْزٌ اَوْ جَاءَ مَعَه مَلَكٌ ط اِِنَّمَا اَنْتَ نَذِيْرٌ ط وَاللّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَّكِيْلٌ ০
সূরা হূদ \ ১২
‘এমন যেন না হয় যে তোমার প্রতি যা ওহী করা হচ্ছে এর মধ্য থেকে তুমি কিছু কথা (প্রকাশ করা থেকে) বাদ দেবে এবং এতে তোমার মন ছোট হয়ে যাবে যে ওরা বলে : এই লোকটির ওপর ধন-ভান্ডার নাযিল হয়নি কেন অথবা তাঁর সাথে কোন ফেরেশতা আসেনি কেন? তুমি তো শুধু সতর্ককারী। আর আল্লাহই সকল বিষয়ে দায়িত্বশীল।’
كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِيْنَ مَا تَدْعُوْ هُمْ اِلَيْهِ.
অর্থ : ‘তুমি মুশরিকদেরকে যেই দিকে আহবান জানাচ্ছো তা তাদের নিকট খুবই অপছন্দনীয়।’
যেই ব্যক্তি আল্লাহর ‘যাত’ (সত্তা), আল্লাহর ‘ছিফাত’ (গুণাবলী), আল্লাহর ‘কুদরাত’ (শক্তি-সামর্থ, যোগ্যতা-ক্ষমতা) কিংবা আল্লাহর ‘হুকুকে’ (অধিকারে) শিরক করে সে মুশরিক।
আল্লাহর ‘যাত’ বা সত্তায় শিরক করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, আত্মীয় কিংবা সমকক্ষ কেউ আছে বলে বিশ্বাস করা।
আল্লাহর ‘ছিফাত’ বা গুণবালীতে শিরক করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর কোন গুণ তাঁর সত্তায় যেইভাবে আছে সেইভাবে অন্য কারো মাঝে আছে বলে বিশ্বাস করা। যেমন- জানা, দেখা, শুনা ইত্যাদি।
আল্লাহর ‘কুদরাত’ বা শক্তি-সামর্থ, যোগ্যতা-ক্ষমতায় শিরক করার অর্থ হচ্ছে সর্বশক্তিমান সত্তা হিসেবে যেইসব গুণ একমাত্র আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত তা অন্য কারো আছে বলে বিশ্বাস করা। যেমন- কাউকে জীবন দেওয়া, কাউকে মৃত্যু দেওয়া, কাউকে রিযক দেওয়া, কারো ভাগ্য গড়া বা ভাংগা, কারো মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করা ইত্যাদি।
আল্লাহর ‘হুকুক’ বা অধিকারে শিরক করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর অধিকারগুলোতে অন্য কারো অধিকার আছে বলে মনে করা। যেমন- সাজদা পাওয়ার অধিকার, কুরবানী ও নযরানা লাভ করার অধিকার, জীবন বিধান প্রণয়নের অধিকার, হারাম-হালাল নির্ধারণের অধিকার, আনুগত্য লাভের অধিকার, ভরশাস্থল হওয়ার অধিকার।
শিরক যেই প্রকারের হোক না কেন তা মস্ত বড়ো গুনাহর কাজ।
اِنَّ الشّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ ০
সূরা লোকমান \ ১৩
‘অবশ্যই শিরক অতি বড়ো যুলম।’
এক শ্রেণীর মানুষের অবান্তর কল্পনা-বিলাসই শিরকের উৎপত্তি স্থল।
আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুশরিকদেরকে দীনের আলোকিত রাজপথে এগিয়ে আসার আহবান জানালেও নির্বোধরা এই নিয়ামতকে মূল্য না দিয়ে তাঁর প্রতি অসন্তুষ্টিই প্রকাশ করতে থাকে।
اللهُ يَجْتَبِىْ اِلَيْهِ مَنْ يَّشَاءُ وَيَهْدِِىْ اِلَيْهِ مَنْ يُّنِيْبُ.
অর্থ : ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা আপন করে নেন এবং যেই ব্যক্তি তাঁর দিকে আসতে চায় তিনি তাকে পথ দেখান।’
পথহারা মানুষদের মধ্য থেকেই আল্লাহ যাদেরকে চান তাদেরকে বেছে বেছে তাঁর দিকে নিয়ে আসেন। অবশ্য আল্লাহ অন্ধভাবে তাঁর নিয়ামত বণ্টন করেন না। যেই ব্যক্তি তাঁর দিকে আসতেই চায় না তার পেছনে দৌড়ানো আল্লাহর কাজ নয়। কিন্তু যেই ব্যক্তি তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে চায় আল্লাহ তাকে কাছে টেনে নেন।
৫। শিক্ষা
১। আল্লাহর রাসূলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পদাংক অনুসরণ করে গোটা দীন কায়েম করার লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো মুমিনদের অবশ্য কর্তব্য।
২। দীনের কিছু অংশ প্রকাশ করা, কিছু অংশ গোপন করা, দীনের মধ্যে নতুন কিছু সংযোজন করা, দীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে গুরুত্বহীন করে ফেলা এবং দীনের সুস্পষ্ট বক্তব্যগুলোকে মন-গড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিকৃত করে ফেলা থেকে বিরত থাকা মুমিনদের অবশ্য কর্তব্য।
৩। হিদায়াত প্রাপ্তি ব্যক্তির আগ্রহ এবং আল্লাহর রাহমাতের ওপর নির্ভরশীল। দীন কায়েম প্রত্যাশীদের কর্তব্য হচ্ছে নিরবচ্ছিন্নভাবে আদ্ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ-র কাজ চালিয়ে যেতে থাকা।
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন আমাদেরকে এই শিক্ষাগুলোর আলোকে সঠিকভাবে কর্তব্য পালন করার তাওফীক দান করুন!
দারসুল কোরআন-৪(সূরা আল-আনকাবুত-আয়াত:১-৬)
এ.কে.এম নাজির আহমদ
اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ .
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْم .
১। আয়াত
الـمّ ০ اَحَسِبَ النَّاسُ اَنْ يُّتْرَكُوْا اَنْ يَّقُوْلُوْا امَنَّا وَهُمْ لاَ يُفْتَنُوْنَ ০ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ ০ اَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ السَّيِّاتِ اَنْ يَّسْبِقُوْنَا ط سَاءَ مَا يَحْكُمُوْنَ ০ مَنْ كَانَ يَرْجُوْا لِقَاءَ اللهِ فَاِنَّ اَجَلَ اللهِ لاتٍ ط وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ০ وَمَنْ جهَدَ فَاِنَّمَا يُجَاهِدُ لِنَفْسِه ط اِنَّ اللهَ لَغَنِىٌّ عَنِ الْعلَمِينَ ০
২। ভাবানুবাদ
‘আলিফ লা-ম-ম্মি-ম। লোকেরা কি মনে করেছে যে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এই কথা বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? অথচ তাদের পূর্ববর্তীদেরকে আমি পরীক্ষা করেছি। কারণ আল্লাহকে তো অবশ্যই জানতে হবে- ঈমানের দাবিতে কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী। যারা অন্যায় কাজ করছে তারা কি ভাবছে যে তারা আমাকে অতিক্রম করে যেতে পারবে? তারা যা ফায়সালা করছে তা খুবই মন্দ। আর যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আশা পোষণ করে, সাক্ষাতের নির্দিষ্ট ক্ষণটি অবশ্যই আসবে। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী। আর যেই ব্যক্তি জিহাদ করে সে তার নিজের জন্যই জিহাদ করে। অবশ্যই আল্লাহ গোটা সৃষ্টি জগত থেকে অমুখাপেক্ষী।’
৩। পরিপ্রেক্ষিত
ঈসায়ী ৬১০ সনে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত লাভ করেন। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের নির্দেশেই তিনি প্রথম তিনটি বছর নিরবে আদ্ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহর কাজ করতে থাকেন। অতপর নির্দেশ আসে সরবে দা‘ওয়াতী কাজ করার।
সংগে সংগে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আছ্ছাফা পাহাড়ের ওপর ওঠে ‘‘ইয়া সাবাহাহ’’ ‘‘ইয়া সাবাহাহ’’ ধ্বনি দিতে শুরু করেন।
লোকদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে সমবেত করে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবহিত করার জন্য কোন উচ্চস্থানে উঠে ‘ইয়া সাবাহাহ’ ধ্বনি দেওয়া ছিলো আরব সমাজের একটি নিয়ম।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কণ্ঠে উক্ত ধ্বনি উচ্চারিত হলে মাক্কার লোকেরা ছুটে এসে আছ্ছাফা পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হয়।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লোকদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি যদি বলি তোমাদের ওপর হামলা চালাবার জন্য একদল অশ্বারোহী সৈন্য আবু কুবাইস পাহাড়ের ওদিকে অপেক্ষমান, তোমরা কি বিশ্বাস করবে?’ লোকেরা বললো, ‘অবশ্যই বিশ্বাস করবো। কারণ তুমি তো কখনো মিথ্যা কথা বল না।’ তখন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আখিরাতের সমূহ বিপদ এবং তা থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ ভাষণ দেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাষণ শেষ হলে আবু লাহাব এক খন্ড পাথর নবীর দিকে ছুঁড়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে তার হাতে তুলে নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে সে বলে, ‘তোমার সর্বনাশ হোক, এই জন্য তুমি আমাদেরকে ডেকে এনেছো?’ অতপর সে লোকদেরকে হাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায়।
তখন থেকে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সরবে আদ্ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহর কাজ চালাতে থাকেন। সত্য সন্ধানী যুবক যুবতীরা একে একে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হতে থাকে। অন্য দিকে মারমুখো হতে থাকে মুশরিক শক্তি। নবুওয়াতের পঞ্চম সনে এসে অবস্থা খুবই নাজুক আকার ধারণ করে। বড়ো রকম পরীক্ষার সম্মুখীন হন মুমিনগণ। হাবশায় হিজরাত তখনো শুরু হয়নি। এই সময়টিতে নাযিল হয় সূরা আল ‘আনকাবূত।
৪। ব্যাখ্যা
প্রথম আয়াতটিতে রয়েছে কয়েকটি হরফ।
এই গুলোকে হুরুফে মুকাত্তা‘আত বলে। হুরুফে মুকাত্তা‘আত অর্থ হচ্ছে কর্তিত, খন্ডিত বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর গুচ্ছ। এই গুলোর কোন তাৎপর্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তুলে ধরেন নি। অতএব এই গুলো সম্পর্কে নিরব থাকাই আমাদের কর্তব্য।
দ্বিতীয় আয়াতে বলা হচ্ছে-
اَحَسِبَ النَّاسُ اَنْ يُّتْرَكُوْا اَنْ يَّقُوْلُوْا امَنَّا وَهُمْ لاَ يُفْتَنُوْنَ ০
‘লোকেরা কি মনে করছে যে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এই কথা বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না?’
এই আয়াতাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাঁর একটি শাশ্বত বিধানের কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আর সেটি হচ্ছে : যারা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ ঈমান আনয়নের ঘোষণা দেবে তাদেরকে অবশ্যই পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে।
يُفْتَنُوْنَ শব্দটি ফিতনা শব্দ থেকে উৎসারিত। ফিতনা শব্দের অর্থ পরীক্ষা।
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন আল কুরআনে ফিতনা শব্দটির সমার্থক আরো কয়েকটি শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন : আব্লা ও ইবতিলা।
তৃতীয় আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ ০
‘অবশ্যই আমি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে পরীক্ষার সম্মুখীন করেছি।’
আম্বিয়া (আলাইহিমুস সালাম)-এর জীবন কথা এই বক্তব্যেরই সাক্ষ্য বহন করে।
একবার পূর্ববর্তীকালের কোন এক মুমিন ব্যক্তির পরীক্ষা সম্পর্কে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
قَدْ كَانَ مِنْ قَبْلِكُمْ يُؤْخَذُ الرَّجُلَ فَيُحْفَرُلَهُ فِىْ الاَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيْهَا ثُمَّ يُؤْتى بِالْمِنْشَارِ فَيُؤْضعُ عَلى رَاْئِسِهِ فَيُجْعَلُ نِصْفَيْنِ وَ يُمْشَطِ بِاَمْشَاطِ الْحَدِيْدِ مَا دُوْنَ لَحْمِه وَعَظْمِه مَا يَصُدَّهُ ذلِكَ عَنْ دِيْنِه ০
(খাববাব ইবনুল আরাত (রা), ছাহীহ আল বুখারী)
‘তোমাদের পূর্ববর্তীকালে কোন এক ব্যক্তিকে ধরে এনে মাটিতে গর্ত করে তাতে তার শরীরের নিম্ন ভাগ পোঁতা হয়। তারপর করাত এনে তার মাথার ওপর চালিয়ে তাকে দুই টুকরা করে ফেলা হয়। অতপর লোহার চিরুনি দিয়ে তার শরীরের গোশত ও হাড় ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলা হয়। কিন্তু কোন কিছুই ওই ব্যক্তিকে তার দীন ত্যাগ করাতে পারেনি।’
ঈসা (আলাইহিস্ সালাম)-এর একনিষ্ঠ অনুসারী একদল মুমিন দক্ষিণ আরবের নাজরানে বসবাস করতেন। ইয়ামানের ইয়াহুদী রাজা যু-নাওয়াস নাজরান আক্রমণ করে এবং অধিবাসীদেরকে ইয়াহুদী বনে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু তাঁরা ভ্রান্ত ধর্ম গ্রহণ করতে সম্মত হননি। ফলে কতগুলো বড়ো বড়ো গর্ত খনন করে, ওই গুলোতে কাঠ-খড়ি ফেলে আগুন জ্বালিয়ে ওই মুমিনদেরকে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়। মাত্র একজন মুমিন ব্যক্তি বেঁচে যান। বাকিরা সবাই আগুনে পুড়ে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁদের সংখ্যা ছিলো বিশ হাজার। ঈমানের এমন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েও তাঁরা তাঁদের দীন ত্যাগ করেননি।
পরীক্ষা চাওয়া মুমিনদের কাজ নয়। পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে, বিচলিত হয়ে পড়ে, আল্লাহর বিরুদ্ধে অনুযোগ করাও মুমিনদের কাজ নয়। বরং আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর সন্তুষ্ট থেকে দৃঢ়তা অবলম্বন করা মুমিনদের কাজ।
সূরা আল বাকারা-র ১৫৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَىْءٍ مِّنَ الْخَوفِ وَالْجُوْعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الاَمْوَالِ وَالاَنْفُسِ وَالثَّمَرتِ ط وَبَشِّرِ الصّبِرِيْنَ ০
‘আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি, ক্ষুধা এবং জান-মাল-আয়ের নোকসান ঘটিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে যারা ছবর অবলম্বন করবে, তাদেরকে সুসংবাদ দাও।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّ عِظَمَ الْجَزَاءِ مَعَ عِظَمَ الْبَلاَءِ وَ اِنَّ اللهَ تَعَالى اِذَا اَحَبَّ قَوْمًا اِبْتِلاَهُمْ فَمَنْ رَضِىَ فَلَهُ الرِّضَا وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السُّخْط .
(আনাস (রা), জামে আত তিরমিযী)
‘কষ্ট বেশি হলে প্রতিদানও বেশি। আল্লাহ যখন কোন জনগোষ্ঠীকে ভালোবাসেন তখন তাকে পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। যেই ব্যক্তি এই পরীক্ষায় পড়ে আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর যেই ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য রয়েছে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।’
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন কখনো কখনো মুমিনদেরকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করে শাহাদাতের মর্যাদা দিয়ে নিজের সান্নিধ্যে ডেকে নেন। আবার কখনো কখনো কঠিন পরীক্ষার পর মুমিনদেরকে দুনিয়ার জীবনে সাহায্য ও বিজয় দান করেন।
সূরা আল বাকারা-র ২১৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,
اَمْ حَسِبْتُمْ اَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَاْتِكُمْ مَّثَلُ الَّذِيْنَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ ط مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوْا حَتّى يَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِيْنَ امَنُوْا مَعَهُ مَتى نَصْرُ اللهِ ط اَلا اِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِيبٌ ০
‘তোমরা কি ভেবেছো এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ এখনো তোমাদের ওপর তোমাদের পূর্ববর্তীদের মতো পরিস্থিতি আপতিত হয়নি? তাদের ওপর কঠিন পরিস্থিতি, কঠিন বিপদ এসেছে এবং তাদেরকে কাঁপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন কি শেষ পর্যন্ত রাসূল ও তার সাথী মুমিনগণ বলে উঠেছে, ‘কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য!’ (তখন বলা হয়েছে), ‘ওহে, আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটেই।’
তৃতীয় আয়াতের দ্বিতীয়াংশে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,
فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكذِبِيْنَ ০
‘আল্লাহকে তো অবশ্যই জানতে হবে ঈমানের দাবিতে কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী।’
মনে রাখা প্রয়োজন, আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন এমন সত্তা নন যে ঈমানের দাবিতে কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী তা জানার জন্য তাঁকে পরীক্ষার রিজাল্টের ওপর নির্ভর করতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তির কর্মকান্ড তাঁর দৃষ্টির অধীন। আবার, প্রত্যেক ব্যক্তির মনের অবস্থা তাঁর জ্ঞানের অধীন।
আসলে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন চান খাঁটি মুমিনদের ঈমানের খাঁটিত্বের উদ্ভাসন। তিনি চান, শত বাধার সম্মুখীন হয়েও মুমিনগণ দীনের ওপর অটল থেকে অনন্য উদাহরণ স্থাপন করুক।
চতুর্থ আয়াতে ইসলাম বিদ্বেষীদের অন্যায় কর্মকান্ড যে শেষাবধি তাদের নিজেদের জন্যই মহা ক্ষতির কারণ হবে তা বুঝাতে গিয়ে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ السَّيِّاتِ اَنْ يَّسْبِقُوْنَا ط سَاءَ مَا يَحْكُمُوْنَ ০
‘যারা অন্যায় কাজ করছে তারা কি ভাবছে তারা আমাকে অতিক্রম করে যেতে পারবে? তারা যা ফায়সালা করছে তা খুবই মন্দ।’
অর্থাৎ আল্লাহকে ছাড়িয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন কিছু দিনের জন্য ঢিল দিলেও এক সময় তাদেরকে পাকড়াও করবেন এবং তাদেরকে কঠিন শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবেন।
পঞ্চম আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
مَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ اللهِ فَاِنَّ اَجَلَ اللهِ لاتٍ ط وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ
‘যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আশা পোষণ করে, সাক্ষাতের নির্দিষ্ট ক্ষণটি অবশ্যই আসবে। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।’
মুমিন ব্যক্তি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে আল্লাহ তার প্রতিটি কথা শুনেন, প্রতিটি বিষয় জানেন এবং তাকে অবশ্যই আল্লাহর নিকট হাজির হতে হবে। সে দুনিয়ায় এমন ভাবে জীবন যাপন করতে চায় যাতে সে আখিরাতে আল্লাহর শাস্তি থেকে নাজাত পায়, সেখানে সে সম্মানিত হয়, সমাদৃত ব্যক্তি রূপে জান্নাতে স্থান পায় এবং আল্লাহর দর্শন লাভ করে ধন্য হয়।
পক্ষান্তরে আল্লাহদ্রোহী একজন ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করে থাকে। আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করার কোন আগ্রহ তার মনে স্থান পায় না।
এই প্রসংগে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
مَنْ اَحَبَّ لِقَاءَ اللهِ اَحَبَّ اللهُ لِقَائَهُ وَ مَنْ كَرِهَ لِقَاءَ اللهِ كَرِهَ اللهُ لِقَائَهُ .
[আয়িশা আছ ছিদ্দিকা (রা), ছাহীহ মুসলিম।]
‘‘যেই ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাত লাভ করা পছন্দ করে আল্লাহও তার সাক্ষাত লাভ পছন্দ করেন। আর যেই ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাত লাভ পছন্দ করে না, আল্লাহও তার সাক্ষাত লাভ পছন্দ করেন না।’’
ষষ্ঠ আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَنْ جهَدَ فَاِنَّمَا يُجَاهِدُ لِنَفْسِه ط اِنَّ اللهَ لَغَنِىٌّ عَنِ الْعلَمِيْنَ ০
‘আর যেই ব্যক্তি জিহাদ করে, সে তার নিজের জন্যই জিহাদ করে। অবশ্যই আল্লাহ গোটা বিশ্ব জগত থেকে অমুখাপেক্ষী।’
‘আল জিহাদ’ একটি ব্যাপক অর্থবোধক পরিভাষা।
চিন্তা-চেতনায় কোনভাবেই জাহিলিয়াতের অনুপ্রবেশ ঘটতে না দেওয়ার প্রচেষ্টা জারি রাখা আল জিহাদ।
পার্থিব ভোগ-বিলাসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হওয়ার হাতছানিকে রুখে দেওয়ার প্রচেষ্টা আল জিহাদ।
কু-প্রবৃত্তির তাড়নার বিরুদ্ধে লড়তে থাকা আল জিহাদ।
সমাজে প্রচলিত কু-প্রথা ও কু-সংস্কারের প্রভাব মুক্ত থাকার প্রচেষ্টা আল জিহাদ।
সর্বোপরি আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন কায়েম করার জন্য অর্থাৎ ইকামাতুদ্ দীন-এর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো আল জিহাদ।
ইকামাতুদ দীনের জন্য পরিচালিত আল জিহাদের দুইটি অধ্যায় রয়েছে।
কোন ভূখন্ডে ইসলামী রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আল জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর সর্ব প্রধান কাজ হচ্ছে আদ-দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ।
আবার কোন ভূখন্ডে ইসলামী রাষ্ট্র গঠিত হয়ে যাওয়ার পর আদ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ-র সাথে সমর শক্তিও যুক্ত হয়।
ঈমানের খাঁটিত্ব প্রমাণের উপায় আল জিহাদে আত্মনিয়োগ করা। খাঁটি মুমিনদের পরিচয় বর্ণনা করতে গিয়ে সূরা আল হুজুরাতের ১৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ امَنُوْا بِاللهِ وَرَسُولِه ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوْا وَجَاهَدُوْا بِاَمْوَالِهِمْ وَاَنْفُسِهِمْ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ ط اُولَئِكَ هُمُ الصّدِقُوْنَ ০
‘নিশ্চয়ই মুমিন তো তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, অতপর কখনো সংশয় সন্দেহে নিপতিত হয় না এবং জিহাদ করে তাদের অর্থ সম্পদ ও জান দিয়ে, আল্লাহর পথে। (ঈমানের দাবিতে) এরাই তো সত্যবাদী।’
সূরা আলে ইমরানের ১৪২ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اَمْ حَسِبْتُمْ اَنْ تَدْخُلُوْا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللهُ الَّذِيْنَ جهَدُوْا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصّبِرِيْنَ ০
‘তোমরা কি ভেবেছো যে এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ আল্লাহ এখনো দেখেন নি যে তোমাদের মধ্য থেকে কারা তাঁর পথে জিহাদ করে এবং দেখেন নি যে কারা (জিহাদে) দৃঢ়তা অবলম্বন করে।’
সূরা মুহাম্মাদ-এর ৩১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِيْنَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِيْنَ
‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো যাতে তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদ এবং কারা দৃঢ়তা অবলম্বনকারী তা জেনে নিতে পারি।’
সূরা আত্ তাওবার-র ১৬ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اَمْ حَسِبْتُمْ أَن تُتْرَكُوْا وَلَمَّا يَعْلَمِ اللهُ الَّذِيْنَ جهَدُوْا مِنْكُمْ وَلَمْ يَتَّخِذُوْا مِنْ دُوْنِ اللهِ وَلاَ رَسُوْلِه وَلاَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَلِيْجَةً ج وَاللهُ خَبِيرٌم بِمَا تَعْمَلُوْنَ ০
‘তোমরা কি ভেবেছো যে তোমাদেরকে এমনিতেই ছেড়ে দেওয়া হবে অথচ আল্লাহ এখনো দেখেন নি যে তোমাদের মধ্য থেকে কারা জিহাদে নিবেদিত হয় এবং আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদেরকে ছাড়া আর কাউকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করে না। আর তোমরা যা কিছু কর সেই সম্পর্কে আল্লাহ খবর রাখেন।’
যষ্ঠ আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন এটাও সুস্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত করছেন যে একজন মুমিন আল জিহাদে আত্ম নিয়োগ করে তার নিজের কল্যাণই নিশ্চিত করে থাকে। এই কথারই প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই সূরা আছ ছাফ-এর ১০-১২ নাম্বার আয়াতে। এই আয়াত গুলোতে মুমিনদেরকে সম্বোধন করে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
ياَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا هَلْ اَدُلُّكُمْ عَلى تِجَارَةٍ تُنْجِيْكُمْ مِّنْ عَذَابٍ اَلِيْمٍ ০ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَرَسُولِه وَتُجَاهِدُونَ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ بِاَمْوَالِكُمْ وَاَنْفُسِكُمْ ط ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ০ يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنّتٍ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا الاَنْهرُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِى جَنّتِ عَدْنٍ ط ذلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ ০
‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আমি কি তোমাদেরকে এমন ব্যবসার কথা জানিয়ে দেবো যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাব থেকে বাঁচাবে? (তা হচ্ছে : ) তোমরা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান রাখবে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করবে তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও জান দিয়ে। এটি তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জান। আল্লাহ তোমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে ঝর্ণা প্রবাহিত । এটি চিরস্থায়ী অবস্থানের উত্তম বাসস্থান। আর এটি অতি বড়ো সাফল্য।’
اِنَّ اللهَ لَغَنِىٌّ عَنِ الْعلَمِيْنَ ০
এই ঘোষণার মাধ্যমে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন এই মহাসত্য প্রকাশ করলেন যে আল জিহাদে আত্মনিয়োগ করা মুমিনদের নিজেদের জন্যই কল্যাণকর। এতে আল্লাহর কোন স্বার্থ নেই।
সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করলে আল্লাহর কিছুই যায় আসে না। পক্ষান্তরে সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর আনুগত্য করলেও আল্লাহর শানে কোন বৃদ্ধি ঘটে না। আল্লাহ স্বয়ং সম্পূর্ণ, স্ব-প্রশংসিত, নিরংকুশ অ-মুখাপেক্ষী সত্তা।
উল্লেখ্য যে ঈমানের খাঁটিত্বের প্রমাণ আল জিহাদে আত্মনিয়োগ করেই দিতে হয়।
আল জিহাদে আত্মনিয়োগ করলে পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
পরীক্ষার সম্মুখীন হলে দৃঢ়তা অবলম্বন ঈমানের দাবি।
তবে এই দৃঢ়তা অবলম্বন আল্লাহর অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। সেই জন্য দয়াবান, মেহেরবান আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন অন্যান্য বিষয়ের মতো এই বিষয়েও তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করার জন্য আমাদেরকে সূরা আল বাকারা-র শেষ আয়াতে দু‘আ শিখিয়েছেন,
رَبَّنَا لاَ تُؤَاخِذْنَا اِنْ نَّسِينَا اَوْ اَخْطَاْنَا ج رَبَّنَا وَلاَ تَحْمِلْ عَلَيْنَا اِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِنَاج رَبَّنَا وَلاَ تُحَمِّلْنَا مَا لاَ طَاقَةَ لَنَا بِهِ ج وَاعْفُ عَنَّا وقفه وَاغْفِرْ لَنَا وقفه وَارْحَمْنَا وقفه اَنتَ مَوْلاَنَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكفِرِيْنَ ০
‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে আমাদের ভুল-ত্রুটির জন্য পাকড়াও করবেন না, হে আমাদের রব, পূর্ববর্তীদের বোঝার মতো (পরীক্ষা) বোঝা (পরীক্ষা) আমাদের ওপর চাপাবেন না। হে আমাদের রব, বহন করার ক্ষমতা নেই এমন বোঝা আমাদের ওপর চাপাবেন না। আমাদের গুনাহগুলো মিটিয়ে দিন, আমাদেরকে ক্ষমা করুন; আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। আপনি আমাদের পৃষ্ঠপোষক, অতএব আপনি আমাদেরকে কাফির গোষ্ঠীর মুকাবিলায় সাহায্য করুন।’
৫। শিক্ষা
• প্রকৃত মুমিনদেরকে অবশ্যই নানাভাবে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়।
• পরীক্ষার সম্মুখীন হলে তাদের কর্তব্য চিন্তায় ও কর্মে দীনের ওপর অটল অবিচল থাকা।
• ইসলাম-বিদ্বেষীরা শেষাবধি-আল্লাহর হাতে বন্দী হয়। আর মুমিনগণ স-সম্মানে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে যায়।
• আল্লাহর পথে জিহাদ আখিরাতের সফলতা নিশ্চিত করে।
আর আখিরাতের সফলতাই তো প্রকৃত সফলতা।
দারসুল কোরআন-৫(সূরা আল-আনআম-আয়াত:৩৩-৩৬)
এ.কে.এম নাজির আহমদ
اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ .
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْم .
১। আয়াত
قَدْ نَعْلَمُ اِنَّه لَيَحْزُنُكَ الَّذِىْ يَقُوْلُوْنَ فَاِِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُوْنَكَ وَلٰكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِايتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ০ وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِّنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوْا عَلٰى مَا كُذِّبُوْا وَاُوذُوْا حَتّٰى اَتـهُمْ نَصْرُنَاۚۚ وَلاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمتِ اللهِۚۚ وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَّبَإِ الْمُرْسَلِيْنَ ০ وَاِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكَ اِعْرَاضُهُمْ فَاِنِ اسْتَطَعْتَ اَنْ تَبْتَغِىَ نَفَقًا فِى الْأَرْضِ اَوْ سُلَّمًا فِى السَّمَاءِ فَتَأْتِيَهُمْ بِايَةٍ ط وَلَوْ شَاءَ اللهُ لَجَمَعَهُمْ عَلَى الْهُدى فَلاَ تَكُوْنَنَّ مِنَ الْجهِلِيْنَ ০ اِنَّمَا يَسْتَجِيْبُ الَّذِيْنَ يَسْمَعُوْنَ ط وَالْمَوْتٰى يَبْعَثُهُمُ اللهُ ثُمَّ الَيْهِ يُرْجَعُوْنَ ০
২। ভাবানুবাদ
৩৩. ‘আমি অবশ্যই জানি তারা যেইসব কথা বলে বেড়াচ্ছে তা তোমাকে মানসিকভাবে দারুণ কষ্ট দেয়, কিন্তু তারা তো আসলে তোমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করছে না, বরং এই যালিমরা আল্লাহর আয়াতগুলোকেই অস্বীকার করছে।
৩৪. এবং তোমার পূর্বে বহু রাসূলের প্রতি মিথ্যা আরোপ করা হয়েছে, কিন্তু এই মিথ্যা আরোপ করে তাদেরকে যেই কষ্ট দেওয়া হয়েছে এর মুকাবিলায় তারা ছবর অবলম্বন করেছে, যেই পর্যন্ত না আমার সাহায্য তাদের কাছে এসেছে। আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মগুলো পরিবর্তন করতে পারে এমন কেউ নেই। আর পূর্বেকার রাসূলদের কথা তো তোমার নিকট পৌঁছেছে।
৩৫. এবং তাদের এই উপেক্ষা যদি তোমার কাছে অসহনীয় হয়, তাহলে সাধ্য থাকলে তুমি মাটির গভীরে কোন সুড়ংগ খোঁজ কিংবা আসমানের দিকে সিঁড়ি লাগাও এবং তাদের জন্য কোন নিদর্শন নিয়ে আস। আল্লাহ যদি চাইতেন যে তিনি সকলকে হিদায়াতের ওপর একত্রিত করবেনই, তা তো তিনি করতেই পারতেন। অতএব তুমি জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
৩৬. আহবানে তো তারাই সাড়া দেয়, যারা শুনতে পায়। আর মৃতদেরকে আল্লাহ পুনর্জীবিত করবেন এবং তারা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তিত হবে।
৩। পরিপ্রেক্ষিত
নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ৪০ বছর মাক্কায় বসবাস করেন। তাঁর বিশ্বস্ততা ও আমানাতদারীতে মুগ্ধ হয়ে লোকেরা তাঁকে ‘আলআমীন’ বলে ডাকতো। অপর দিকে তিনি ছিলেন সত্যবাদিতার বিমূর্ত রূপ। জীবনে তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন নি। তাঁর সত্যবাদিতায় মুগ্ধ হয়ে লোকেরা তাঁকে ডাকতো ‘আছ ছাদিক’ বলে। তিনি ছিলেন সকলেরই প্রিয়জন।
নবুওয়াত প্রাপ্তির পর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিরবে ‘আদ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ’-র কাজ করছিলেন। তিন বছর পর আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের নির্দেশেই সরবে দা‘ওয়াত প্রদানের কাজ শুরু করেন।
অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ ধারণ করে।
জাহিলিয়াতে আকষ্ঠ নিমজ্জিত মানুষেরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করে।
বেশ কিছু সত্য-সন্ধানী ব্যক্তি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হন। ইসলাম বিদ্বেষীরা এই নব গঠিত শক্তিকে ‘অংকুরে বিনাশ করতে চায়। সমাজ অংগনে ইসলাম ও জাহিলিয়াতের দ্বন্দ্ব আত্মপ্রকাশ করে।
ইসলাম বিদ্বেষীরা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার ঝড় সৃষ্টি করে। পাশাপাশি তারা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর অনুসারীদের ওপর যুলম-নির্যাতন চালাতে থাকে।
ইসলাম বিদ্বেষীদের মিথ্যা প্রচারণার কতগুলো কথা ছিলো নিম্নরূপঃ
০ মুহাম্মাদ একজন গণক।
০ মুহাম্মাদ একজন পাগল।
০ মুহাম্মাদ একজন কবি।
০ মুহাম্মাদ একজন যাদুকর।
০ মুহাম্মাদ নিজেই কালাম রচনা করে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিচ্ছে।
০ মুহাম্মাদ তো একজন মানুষ। মানুষ নবী হবে কেন?
০ মুহাম্মাদ নবী হলে তো তার সাথে বিশাল ধন ভান্ডার এবং ফেরেশতাদের একটি বাহিনী থাকতো।
০ মুহাম্মাদ আল্লাহর কালাম বলে যা পেশ করছে সেই গুলো অতীতকালের কিস্সা কাহিনী ছাড়া আর কিছু নয়। ইত্যাদি।
উল্লেখ্য যে তিনজন কবি আবু সুফইয়ান ইবনুল হারিস, আমর ইবনুল আস এবং আবদুল্লাহ ইবনুল জিবয়ারী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাব মর্যাদা বিনষ্ট করার লক্ষ্যে বানোয়াট কথা সম্বলিত কবিতা রচনা করে জন সমক্ষে আবৃত্তি করে বেড়াতো।
ইসলাম-বিদ্বেষীদের হাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দৈহিকভাবেও নিপীড়িত হন।
০ একদিন কা‘বার চত্বরে দাঁড়িয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বুলন্দ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’। ইসলামের দুশমনেরা চারদিক থেকে ছুটে এসে তার ওপর হামলে পড়ে। তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন হারিস ইবনু আবি হালাহ (রা)। এক দুশমনের তলোয়ারের আঘাতে হারিস (রা) নিহত হন। তিনিই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসারীদের মধ্যে প্রথম শহীদ।
০ একদিন কা‘বার চত্বরে মুসলিমগণ একটি জনসভার আয়োজন করেন। বক্তা হিসেবে নিদিষ্টি ছিলেন আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা)। বক্তৃতা শুরু করার সাথে সাথেই ইসলামের দুশমনেরা হামলা চালায়। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)সহ অনেকেই আহত হন। লাঠির আঘাতে আহত আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা) গভীর রাত পর্যন্ত সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলেন।
০ একদিন কা‘বার চত্বরে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায়কালে উকবা ইবনু আবি মুয়াইত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গলায় একখন্ড কাপড় পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করে। আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা) দৌঁড়িয়ে এসে তাঁকে উদ্ধার করেন।
০ একদিন পথিমধ্যে আবু জাহল বেশ কিছু ধূলাবালি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাথায় ছড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ‘ওহে লোক সকল, তোমরা এর কথায় বিশ্বাস স্থাপন করো না। এ চায় তোমরা লাত ও উয্যার উপাসনা ছেড়ে দাও।’
০ একদিন কা‘বার চত্বরে ছালাত আদায় কালে সাজদায় গেলে উকবা ইবনু আবি মুয়াইত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাঁধে, পিঠে, মাথায় একটি উটের নাড়িভুড়ি তুলে দেয়।
০ আবু লাহাব ও উকবা ছিলো মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিবেশী। তারা তাদের বাড়ির আবর্জনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরের সামনে ছুঁড়ে মারতো।
০ ইসলামের দুশমনেরা রাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রান্নাঘরে ঢুকে হাড়ি পাতিলের ভেতর উটের নাড়িভুড়ি রেখে আসতো।
০ ইসলামের দুশমনেরা রাতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরের দরওয়াজায় কাঁটা পুঁতে ও ছড়িয়ে রাখতো।
০ একদিন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কা‘বার নিকটে বসা ছিলেন। দুর্বৃত্ত উকবা সেখানে এসে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চেহারায় থুথু নিক্ষেপ করে।
০ নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ সন থেকে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর অনুসারীগণ এবং বানু হাশিমের সদস্যগণ শিয়াবে আবু তালিবে তিনটি বছর কষ্টকর অবরুদ্ধ জীবন যাপন করেন।
০ নবুওয়াতের নবম সনে ‘আদ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ’র কাজ করার জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তায়েফ পৌঁছেন। সেখানকার তিন সরদার আবদ ইয়ালিল ইবনু আমর, মাসউদ ইবনু আমর ও হাবীব ইবনু আমর তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করে। তারা তাঁর পেছনে একদল গুন্ডাকে লেলিয়ে দেয়। দুর্বৃত্তরা পাথর খন্ড নিক্ষেপ করে করে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। ক্লান্ত ও রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি কয়েকবার রাস্তার ওপর পড়ে যান। এইভাবে দুই তিন মাইল পথ চলেন। এই সময় কয়েকজন প্রবীণ লোক এগিয়ে এসে তাঁকে শহরের বাইরে পৌঁছে দিয়ে যায়। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি একটি আংগুরের বাগানে ঢুকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়েন। অশ্রুভরা চোখে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাতে থাকেন।
০ তায়েফ থেকে মক্কার পথ ধরে এগুচ্ছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। পথিমধ্যে তিনি খবর পান যে মুশরিক নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁকে আর মাক্কায় ঢুকতে দেওয়া হবে না।
এ ছিলো যেন নাগরিকত্ব বাতিলের ঘোষণা।
এক ব্যক্তিকে পাঠিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আখনাস ইবনু শুরাইকের সহযোগিতা চান। আখনাস রাজি হলেন না। এবার তিনি সুহাইল ইবনু আমরের সহযোগিতা চান। সুহাইল রাজি হলেন না। অতপর তিনি মুতয়িম ইবনু আদীর সহযোগিতা চান। মুতয়িম রাজি হন এবং তাঁর ছেলেরা সহ অস্ত্র সজ্জিত হয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাক্কায় এনে কা‘বার চত্বরে পৌঁছে দেন। কা‘বার তাওয়াফ করে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপন ঘরে ফেরেন।
উল্লেখ্য যে এই কয়টি বছরে ইসলাম বিদ্বেষীদের হামলা ও নির্যাতনে প্রাণ হারান কয়েকজন মুসলিম। আহতদের সংখ্যা ছিলো আরো বেশি। অত্যাচার-নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে শতাধিক মুসলিম হাবশায় হিজরাত করেন।
পরিস্থিতির প্রতিকূলতার কারণে মাক্কা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লোকদের ইসলাম গ্রহণের হার কমে যায়।
সামগ্রিকভাবে জনগোষ্ঠীর অবস্থান ছিলো ইসলামী আন্দোলনের বিপক্ষে। নিদারুণ মানসিক কষ্ট অনুভব করছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
এই প্রেক্ষাপটে, মাক্কী জীবনের শেষভাগে, অবতীর্ণ হয় সূরা আল আন‘আম। পুরো সূরাটি একই সংগে অবতীর্ণ হয়।
৪। ব্যাখ্যা
৩৩ নাম্বার আয়াত
قَدْ نَعْلَمُ اِنَّه لَيَحْزُنُكَ الَّذِىْ يَقُوْلُوْنَ فَاِِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُوْنَكَ وَلٰكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِايتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ০
قَدْ نَعْلَمُ আয়াতাংশ দ্বারা আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বুঝাচ্ছেন যে ইসলাম বিদ্বেষীরা যেই সব কথা এবং যেইসব কাজ করে নবীকে কষ্ট দিচ্ছে সেই সম্পর্কে তিনি অবহিত আছেন। বস্ত্ততঃ বিশ্বজাহানের কোন কিছুই আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে, আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে, থাকতে পারে না।
لاَ يُكَذِّبُوْنَكَ আয়াতাংশ দ্বারা তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন যে ব্যক্তি মুহাম্মাদকে তারা অস্বীকার করছে না। বরং ব্যক্তি মুহাম্মাদকে তো তারা ‘আলআমীন ও ‘আছ-ছাদিক’ বলে ডেকে তৃপ্তিবোধ করতো। মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল্লাহকে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বলে মেনে নিতেই ছিলো তাদের আপত্তি।
وَلٰكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِايتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ০
আয়াতাংশ দ্বারা আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বুঝাতে চাচ্ছেন যে ইসলাম বিদ্বেষীদের বিরোধিতার আসল লক্ষ্য বস্ত্ত হচ্ছে আল্লাহর আয়াতসমূহ, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান।
আল্লাহর আয়াতসমূহ তাদের চক্ষুশূল। আল্লাহর বিধান তাদের বড্ড অপছন্দনীয়। এই বিধান যাতে সমাজ-সভ্যতার অংগনে শিকড় গাড়তে না পারে সেই লক্ষ্যেই নিয়োজিত ছিলো তাদের সকল তৎপরতা।
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের অবতীর্ণ আয়াতসমূহের, তার অবতীর্ণ বিধানের, বিরোধিতা করা মস্ত বড়ো যুলম, মস্ত বড়ো অন্যায়। এই যালিমরা সেই অন্যায় কাজেই লিপ্ত রয়েছে।
৩৪ নাম্বার আয়াত
وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِّنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوْا عَلٰى مَا كُذِّبُوْا وَاُوذُوْا حَتّٰى اَتـهُمْ نَصْرُنَا ج وَلاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمتِ اللهِ ج وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَّبَإِ الْمُرْسَلِيْنَ ০
এই আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে অতীত কালেও ইসলাম অস্বীকারকারীগণ বহু নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছে এবং তাদেরকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন আরো জানাচ্ছেন যে সেই নবীগণ নানা ধরনের কষ্টের সম্মুখীন হয়েও ছবর অবলম্বন করেছেন, কর্তব্য পালনে দৃঢ়পদ থেকেছেন, আপোসহীন ভাবে সত্যের উদ্ভাসনের জন্য নিরলস প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে তাঁরা আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের সাহায্য লাভ করেছেন।
এই আয়াতের দ্বিতীয়াংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন, وَلاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمتِ اللهِ ج
অর্থাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামী ও ইসলাম বিদ্বেষীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-প্রতিদ্বন্দ্বের যেই বিধান আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন নির্ধারিত করেছেন তা বদলে দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। এই বিধান চিরদিন অপরিবর্তিত থাকবে।
এই আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন, وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَّبَإِ الْمُرْسَلِيْنَ
অর্থাৎ অতীতকালে বিভিন্ন নবী কর্তৃক ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিচালনা এবং তাদের প্রতি ইসলাম বিদ্বেষীদের আচরণের কথা তো তোমাকে জানানো হয়েছে। ইসলাম-বিদ্বেষীগণ কর্তৃক ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানো এবং নানাভাবে তাদেরকে কষ্ট দেওয়ার বিষয়টি কোন নতুন বিষয় নয়।
উল্লেখ্য যে নূহ (আলাইহিস সালাম), ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম), হুদ (আলাইহিস সালাম), ছালিহ (আলাইহিস সালাম), শুয়াইব (আলাইহিস সালাম), মূসা (আলাইহিস সালাম), ঈসা (আলাইহিস সালাম) প্রমুখ একই রূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন।
৩৫ নাম্বার আয়াত
وَاِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكَ اِعْرَاضُهُمْ فَاِنِ اسْتَطَعْتَ اَنْ تَبْتَغِىَ نَفَقًا فِى الْأَرْضِ اَوْ سُلَّمًا فِى السَّمَاءِ فَتَأْتِيَهُمْ بِآيَةٍ ط وَلَوْ شَاءَ اللهُ لَجَمَعَهُمْ عَلَى الْهُدى فَلاَ تَكُوْنَنَّ مِنَ الْجهِلِيْنَ ০
এই আয়াতের প্রথমাংশে এই ইংগিত রয়েছে যে কোন কোন সময় মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মনের গভীরে এই ধরনের বাসনা জন্ম নিতো যে ‘আহ্, যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কোন নিদর্শন প্রকাশিত হতো যা দেখে ইসলাম প্রত্যাখ্যানকারীরা দা‘ওয়াত কবুল করতে বাধ্য হতো।’
এই প্রসংগেই আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন যে ইসলাম বিদ্বেষীদের দা‘ওয়াত গ্রহণে অস্বীকৃতিতে তুমি যদি ছবর অবলম্বন করতে না পার, তবে মাটির গভীরে সুড়ংগ করে কিংবা আসমানে সিঁড়ি লাগিয়ে কোন নিদর্শন এনে অলৌকিকভাবে কিছু ঘটাবার চেষ্টা কর। কিন্তু ভেবো না আমি তোমার এই ধরনের বাসনা পূর্ণ করবো। কারণ আমার পরিকল্পনায় এই ধরনের নিয়ম-পদ্ধতি নির্ধারিত নেই।
এই আয়াতের দ্বিতীয়াংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন যে যদি কোন না কোনভাবে সকল মানুষকে আল্লাহর বিধানের অনুসারী বানানোই লক্ষ্য হতো তাহলে কিতাব নাযিল করা, মুমিনদেরকে ইসলাম বিদ্বেষীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া এবং মানযিলের পর মানযিল ইসলামী আন্দোলনকে পথ চলতে দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিলো! আল্লাহর একটি ইশারাই তো এই কাজের জন্য যথেষ্ট হতো। প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন এই পদ্ধতিতে মানুষকে ইসলামের অনুসারী বানাতে চান না। এটাকে তিনি বিজ্ঞতাপূর্ণ কাজ মনে করেন না।
তিনি চান ইসলামকে বিজ্ঞতাসহকারে মানুষের সামনে তুলে ধরা হবে এবং মানুষকে তাদের আকল ব্যবহার করে স্বাধীনভাবে সত্যের পথে এগিয়ে আসার সুযোগ দেওয়া হবে।
৩৬ নাম্বার আয়াত
اِنَّمَا يَسْتَجِيْبُ الَّذِيْنَ يَسْمَعُوْنَ ط وَالْمَوْتٰى يَبْعَثُهُمُ اللهُ ثُمَّ الَيْهِ يُرْجَعُوْنَ ০
এই আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন এই মহাসত্যটি তুলে ধরেছেন যে, ‘যারা শুনে তারাই তো দা‘ওয়াত কবুল করে।’ ‘যারা শুনে’ বলে এখানে ওই ব্যক্তিদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা বিবেককে জাগ্রত রাখে, যারা মনের দুয়ারে তালা ঝুলিয়ে দেয় না।
এই আয়াতের দ্বিতীয়াংশে ‘মৃত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাদেরকে যারা গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে চলে, অন্ধের মতো সামনের দিকে এগিয়ে যায়, অন্য কোন পথ আছে কিনা তা ভেবেও দেখে না।
৫। শিক্ষা
(1) আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন হক ও বাতিলের কিংবা ইসলাম ও জাহিলিয়াতের মধ্যে দ্বন্দ্ব-প্রতিদ্বন্দ্বের যেই বিধান নির্ধারিত করেছেন, তা কখনো পরিবর্তিত হবে না।
(2) ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামীদেরকে অবশ্যই দীর্ঘকাল পরীক্ষার আগুনে পোড় খেতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত মিথ্যা প্রচারণা এবং তাদের ওপর চাপানো যুলম নির্যাতনকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
তবে মনে রাখতে হবে যে যারা জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সামনে এগুতে বদ্ধপরিকর, আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাদেরকে পথ প্রদর্শন করেন এবং এই পথে চলতে চলতে তারা তাদের জীবনে উৎকৃষ্ট গুণাবলীর বিকাশ ঘটিয়ে যেই ধরনের সাহায্য লাভের উপযুক্ত বলে প্রমাণ পেশ করেন, আল্লাহ রাববুল আলামীন তাদেরকে সেই ধরনের সাহায্যও দিয়ে থাকেন।
(3) সর্বাবস্থায় দৃঢ়তা অবলম্বন করে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
দারসুল কোরআন-৬(সূরা আলে-ইমরান-আয়াত : ১৫৯)
اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ .
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْم .
১। আয়াত
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللّهِ لِنْتَ لَهُمْ ط وَلَوْكُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لاَنْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ ص فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِى الاَمْرِ ج فَاِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللّهِ ط اِنَّ اللّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِيْنَ ০
২। ভাবানুবাদ
‘এটা আল্লাহর বড়োই অনুগ্রহ যে তুমি তাদের (তোমার অনুগামীদের) প্রতি নম্ন হয়েছো। যদি তুমি রুক্ষভাষী ও কঠোর চিত্ত হতে তারা তোমার চারদিক থেকে সরে যেতো। অতএব তুমি তাদেরকে ক্ষমা করে দাও, তাদের জন্য ইসতিগফার কর এবং সামষ্টিক বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতপর যখন তুমি সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবে, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল করে।’
৩। পরিপ্রেক্ষিত
নবুওয়াত লাভের পর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাক্কাতে আদ্ দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ-র কাজ করতে থাকেন।
সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিলো তাঁর প্রয়াস। কিন্তু ইসলাম-বিদ্বেষীরা এই শান্তিপূর্ণ প্রয়াসকেও বরদাশত করতে পারেনি। নানা ধরণের বানোয়াট কথা প্রচার করে তারা লোকদের মনে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর প্রচারিত দীন সম্পর্কে ভুল ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু সত্য সন্ধানী যুবক যুবতীরা এই অপ প্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে একে একে ইসলামের পথে এগিয়ে আসে। এতে ইসলাম-বিদ্বেষীরা মারমুখো হয়ে ওঠে এবং মুসলিমদের ওপর দৈহিক নির্যাতন চালাতে শুরু করে। মুশরিক নেতাদের বৈরিতার কারণে মাক্কার যমিন মুসলিমদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
পক্ষান্তরে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের অনুগ্রহে ইয়াসরিবে ইসলামের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠে। সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ইসলাম গ্রহণ করায় সাধারণ মানুষের পক্ষে ইসলাম গ্রহণ করা সহজ হয়ে যায়। অচিরেই ইয়াসরিবে গড়ে ওঠে ইসলামের অনুকূল গণ-ভিত্তি। আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইয়াসরিবে হিজরাত করেন। গড়ে তোলেন ছোট্ট একটি রাষ্ট্র ‘আল মাদীনা আল মুনাওয়ারা। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের আলোকে তিনি সমাজের সকল দিক ও বিভাগে আমূল পরিবর্তন সাধনে হাত দেন।
সবেমাত্র একটি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। মাক্কার মুশরিক নেতারা আল মাদীনায় নতুন এক রাষ্ট্র শক্তির বিকাশে শংকিত হয়ে ওঠে। তারা এই রাষ্ট্রশক্তিকে অংকুরেই ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এক হাজার সুসজ্জিত সৈন্য নিয়ে আল-মাদীনার দিকে অগ্রসর হয়।
মাত্র ৩১৩ জন মুজাহিদ নিয়ে আল মাদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বদর প্রান্তরে তাদের মুকাবিলা করেন। এই যুদ্ধে ১৪ জন মুসলিম শহীদ হন। কেউ বন্দী হননি। পক্ষান্তরে মুশরিক বাহিনীর ৭০ জন যোদ্ধা নিহত হয়। বন্দী হয় ৭০ জন।
এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে হিজরী তৃতীয় সনে আল মাদীনার উহুদ প্রান্তরে এসে পৌঁছে মাক্কার তিন হাজার মুশরিক যোদ্ধা। এদের মুকাবিলা করার জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক হাজার যোদ্ধা নিয়ে উহুদের দিকে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই তার অনুগত তিনশত যোদ্ধা নিয়ে সরে পড়ে।
মাত্র ৭০০ জন মুজাহিদ নিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুশরিক বাহিনীর সম্মুখীন হন। আল্লাহর অনুগ্রহে মুসলিম বাহিনী যুদ্ধে জয় লাভ করে। উল্লসিত হয়ে মুজাহিদদের একটি অংশ গানীমাতের মাল সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রুমাত পাহাড়ে পাহারায় নিয়োজিত ৫০ জন তীরন্দাজের বেশির ভাগই তাদের অবস্থান স্থল ত্যাগ করে গানীমাতের মাল সংগ্রহের জন্য এগিয়ে আসে। অথচ তাদের প্রতি আল্লাহর রাসূলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ ছিলো ‘কোন অবস্থাতেই স্থান ত্যাগ করা যাবে না।’
খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ তখনো মুশরিক। পাহারাদার মুসলিমদের অবস্থান স্থল ত্যাগ করার বিষয়টি তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। একদল অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে তিনি হঠাৎ মুসলিমদের ওপর চড়াও হন। এই আকস্মিক আক্রমণে মুসলিমগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। ৭০ জন মুসলিম শহীদ হন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আহত হন। আহত হন শত শত মুজাহিদ।
এই যুদ্ধের পর মুসলিমদেরকে নছীহাত করে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন এক দীর্ঘ ভাষণ নাযিল করেন। সূরা আলে ইমরানের ১২১ থেকে ২০০ নাম্বার আয়াত পর্যন্ত এই ভাষণ বিস্তৃত। এই ভাষণের একাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَلاَ تَهِنُوْا وَلاَ تَحْزَنُوْا وَاَنْتُمُ الاَعْلَوْنَ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِيْنَ ০
(আয়াত : ১৩৯)
‘তোমরা মন-ভাংগা হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা সত্যিকারের মুমিন হও।’
যুদ্ধের ময়দানে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শহীদ হয়েছেন এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে বহুসংখ্যক মুজাহিদ হতোদ্যম হয়ে পড়ে। তাদের এই ভূমিকার নিন্দা করে এই ভাষণে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,
وَمَا مُحَمَّدٌ اِلاَّ رَسُوْلٌ ج قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ ط اَفَاْئِنْ مَّاتَ اَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلى اَعْقَابِكُمْ ط وَمَنْ يَّنقَلِبْ عَلى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَّضُرَّ اللّهَ شَيْئًا ط وَسَيَجْزِِى اللّهُ الشّكِرِيْنَ ০
(আয়াত : ১৪৪)
‘মুহাম্মাদ তো একজন রাসূল বৈ কিছু নয়। তার আগে আরো অনেক রাসূল চলে গেছে। সে যদি মারা যায় তোমরা কি পেছনের দিকে ফিরে যাবে? যেই ব্যক্তি পেছনের দিকে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ শিগগিরই তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাদেরকে পুরস্কৃত করবেন।’
এই ভাষণের একাংশে অতীতের কিছু আল্লাহ ওয়ালা লোকের যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়তা অবলম্বনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَكَاَيِّنْ مِّنْ نَّبِىٍّ قتَلَ لا مَعَه رِبِّيُّوْنَ كَثِيرٌ ج فَمَا وَهَنُوْا لِمَا اَصَابَهُمْ فِىْ سَبِيلِ اللّهِ وَمَا ضَعُفُوْا وَمَا اسْتَكَانُوْا ط وَاللّهُ يُحِبُّ الصّبِرِيْنَ০ وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ اِلاَّ اَنْ قَالُوْا ربَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَاِسْرَافَنَا فِىْ اَمْرِنَا وَثَبِّتْ اَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكفِرِيْنَ ০
(আয়াত : ১৪৬-১৪৭)
‘এর আগে এমন নবী চলে গেছে যার সাথে মিলে বহু আল্লাহ ওয়ালা লোক লড়াই করেছে। আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে বিপদের সম্মুখীন হয়ে তারা মনভাংগা হয়নি, দুর্বলতা দেখায়নি এবং বাতিলের সামনে মাথা নত করেনি। এই ধরনের ছবর অবলম্বনকারীদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন। তাদের দু‘আ এই ছিলো-
‘হে আমাদের রব, আমাদের গুনাহ মাফ করে দিন, আমাদের সীমা লংঘন মাফ করে দিন, আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখুন এবং কাফিরদের মুকাবিলায় আমাদেরকে সাহায্য করুন।’
অতপর এই ভাষণে উহুদ প্রান্তরে মুমিনদের প্রদর্শিত দুর্বলতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَلَقَدْ صَدَقَكُمُ اللّهُ وَعْدَهَ اِذْ تَحُسُّوْنَهُمْ بِاِذْنِه جِ حَتّى اِذَا فَشِلْتُمْ وَتَنَازَعْتُمْ فِى الاَمْرِ وَعَصَيْتُمْ مِّنْم بَعْدِ مَا اَرـكُمْ مَّا تُحِبُّوْنَ ০
(আয়াত : ১৫২)
‘আল্লাহ তোমাদেরকে যে সাহায্যের ওয়াদা করেছিলেন তা পূর্ণ করেছেন। শুরুতে তোমরা তাদেরকে হত্যা করছিলে। কিন্তু যখন তোমরা দুর্বলতা দেখালে, তোমাদের কর্তব্য-কর্ম সম্পর্কে মতবিরোধে লিপ্ত হলে এবং যখন আল্লাহ তোমরা যা ভালোবাস (পার্থিব সম্পদ) তা তোমাদেরকে দেখালেন তোমরা নেতার হুকুম অমান্য করে বসলে।’
এই ভাষণের একাংশে মৃত্যু সম্পর্কে কাফিরদের বিভ্রান্তিকর উক্তিতে প্রভাবিত না হওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
ياَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لاَ تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا وَقَالُوْا لاِخْوَانِهِمْ اِذَا ضَرَبُوْا فِى الاَرْضِ اَوْ كَانُوْا غُزًّى لَّوْ كَانُوْا عِنْدَنَا مَا مَاتُوْا وَمَا قُتِلُوْا ج لِيَجْعَلَ اللّهُ ذلِكَ حَسْرَةً فِى قُلُوْبِهِمْ ط وَاللّهُ يُحْى وَيُمِيتُ ط وَاللّهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ ০ وَلَئِن قُتِلْتُمْ فِىْ سَبِيْلِ اللّهِ اَوْ مُتُّمْ لَمَغْفِرَةٌ مِّنَ اللّهِ وَرَحْمَةٌ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُوْنَ ০
(আয়াত : ১৫৬-১৫৭)
‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, কাফিরদের মতো কথা বলো না। তাদের আত্মীয়দের কেউ সফরে বের হলে কিংবা যুদ্ধে অংশ নিলে (কোন দুর্ঘটনা আপতিত হলে) বলে, ওরা যদি আমাদের কাছে থাকতো, তাহলে মারা পড়তো না কিংবা নিহত হতো না। তাদের কথাকে আল্লাহ তাদের মনের খেদ ও আক্ষেপের কারণ বানিয়ে দেন। অথচ আল্লাহই জীবন দেন এবং মৃত্যু দেন। তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ দেখেন। তোমরা যদি আল্লাহর পথে নিহত হও কিংবা মারা যাও, অবশ্যই তোমরা আল্লাহর মাগরিফাত ও রাহমাত পাবে যা উত্তম ওরা যা কিছু জমা করছে তা থেকে।’
অতপর আলোচ্য আয়াতে (১৫৯ নাম্বার আয়াতে) এসে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন অনুগামীদের প্রতি নেতৃত্বের কাঙ্ক্ষিত আচরণ সম্পর্কে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন এবং সর্বাবস্থায় তাঁরই ওপর তাওয়াক্কুল করার নির্দেশ প্রদান করেন।
৪। ব্যাখ্যা
আলোচ্য আয়াতের শুরুতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুসলিম উম্মাহর মূল নেতৃত্ব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ .
‘এটা আল্লাহর বড়োই অনুগ্রহ যে তুমি তাদের (তোমার অনুগামীদের) প্রতি বিনম্র হয়েছো।’
لِيْنٌ অর্থ নম্রতা, কোমলতা। لِنْتَ শব্দটি لِيْنٌ শব্দ থেকে উৎসারিত।
এই আয়াতাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন অনুগামীদের প্রতি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নম্র বা কোমল আচরণকে সপ্রশংস ভংগিতে প্রকাশ করেছেন। এটাও তিনি উল্লেখ করেছেন যে আল্লাহর অনুগ্রহেই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমনটি করতে পেরেছেন। তার অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহর অনুগ্রহ সিক্ত বা অনুগ্রহ প্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষেই অনুগামীদের প্রতি নম্র বা কোমল আচরণ করা সম্ভব।
অনুগামীদের প্রতি নম্র আচরণ করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন সূরা আশ্ শূ‘আরা-র ২১৫ নাম্বার আয়াতে বলেন,
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُوْمِنِيْنَ .
‘তোমার অনুগামী মুমিনদের প্রতি তোমার ডানা নুইয়ে দাও।’ অর্থাৎ তাদের সাথে নম্র আচরণ কর।
নম্র আচরণের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّ اللهَ رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ فِى الاَمْرِ كُلِّهِ .
(আয়িশা (রা), ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আল বুখারী)
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোমল। তিনি সকল কাজেই কোমলতা পছন্দ করেন।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّ اللهَ اَوْحى اِلَىَّ اَنْ تَوَاضَعُوْا حَتّى لاَ يَفْخَرَ اَحَدٌ عَلى اَحَدٍ وَلاَ يَبْغِىْ اَحَدٌ عَلى اَحَدٍ.
(ইয়াদ ইবনুল হিমার (রা), ছাহীহ মুসলিম)
‘আল্লাহ আমার নিকট ওয়াহী পাঠিয়েছেন যে তোমরা পরস্পর নম্র আচরণ কর, কেউ কারো ওপর গৌরব করো না, কেউ কারো ওপর বাড়াবাড়ি করো না।’
تَوَاضُعٌ অর্থ বিনয়, নম্রতা। تَوَاضَعُوْا শব্দটি تَوَاضُعٌ শব্দ থেকে উৎসারিত।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِّنْ مَالٍ وَمَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِِعَفْوٍ اِلاَّ عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ اَحَدٌ لِلّهِ اِلاَّ رَفَعَهُ اللّـهُ .
(আবু হুরাইরা (রা), ছাহীহ মুসলিম)
‘দান দ্বারা সম্পদ কমে না। ক্ষমাশীলতা দ্বারা আল্লাহ বান্দার ইযযাত বৃদ্ধি করেন এবং কেউ আল্লাহর ওয়াস্তে বিনম্র আচরণ করলে তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اَلاَ اَخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَّحْرُمُ عَلَى النَّارِ اَوْ بِمَنْ تَحْرُمُ عَلَيْهِ النَّارُ تَحْرُمُ عَلى كُلِّ قَرِيْبٍ هَيِّنٍ لََيِّنٍ سَهْلٍ .
(আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা), জামে আততিরমিযী।)
‘আমি কি তোমাদেরকে অবহিত করবো না কোন্ ব্যক্তি জাহান্নামের আগুনের জন্য হারাম অথবা কার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম। জাহান্নামের আগুন এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য হারাম যে লোকদের সান্নিধ্যে থাকে, যে কোমলমতি, বিনম্র ও নরম মেজাজের অধিকারী।’
একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে নছীহাত করতে গিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّ شَرَّ الرِّعَاءِ الحُطَمَةُ فَِايَّكَ اَنْ تَكُوْنَ مِنْهُمْ .
(আয়িয ইবনু আমর (রা), ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আল বুখারী।)
‘অবশ্যই নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল ঐ ব্যক্তিরা যারা অনুগামীদের প্রতি কঠোর। সাবধান, তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِنَّمَا الاِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ َيُتَّقَى بِهِ فَاِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَ عَدَلَ كَانَ لَهُ بِذلِكَ أَجْرٌ وَاِنْ يَأمُرُ بِغَيْرِهِ كَانَ عَلَيْهِ مِنْهُ .
(আবু হুরাইরা (রা,) ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আল বুখারী।)
‘নেতা ঢালের মতো। তার অধীনে থেকে লড়াই করা হয়। এর মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সে যদি তার অনুগামীদেরকে তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দেয় এবং তাদের মাঝে আদল প্রতিষ্ঠা করে তাহলে সে পুরস্কার পাবে, যদি এর বিপরীত কাজ করে তাহলে পাবে শাস্তি।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর আদালতে নেতৃত্বের জওয়াবদিহি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বলেন,
اَلاِمَامُ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُوْلٌ عَنْ رَّعِيَّتِهِ .
(আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা), ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আল বুখারী।)
‘নেতা একজন তত্ত্বাবধায়ক। তাকে তার নেতৃত্বাধীন ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধান সম্পর্কে জওয়াবদিহি করতে হবে।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
مَامِنْ اَمِيْرِ عَشَرَةٍ يُؤْتَى بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَغْلُولاً حَتَّى يُفَكَّ عَنْهُ الْعَدْلُ اَوْ يُوْبِقَهُ الْجُوْرِ.
(আবু হুরাইরা (রা), সুনানু আদ্ দারেমী।)
‘কোন ব্যক্তি যদি দশজন লোকেরও নেতা হয়, কিয়ামাতের দিন তাকে বেড়ি লাগানো অবস্থায় হাজির করা হবে। (লোকদের পরিচালনাকালে) তার অনুসৃত ন্যায়নিষ্ঠতা এই অবস্থা থেকে তার মুক্তির কারণ হবে অথবা তার কৃত অন্যায় তার ধ্বংসের কারণ হবে।’
অতপর আলোচ্য আয়াতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لاَنْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ .
‘তুমি যদি রুক্ষভাষী ও কঠোর চিত্ত হতে লোকেরা তোমার চার দিক থেকে সরে যেতো।’
নম্র আচরণ মানুষকে আকর্ষণ করে। পক্ষান্তরে রূঢ় আচরণ মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। বস্ত্তত রুক্ষভাষা বা রূঢ় আচরণের উৎস হচ্ছে কঠোর চিত্ত।
এখানে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন কঠোর চিত্ততা ও রুক্ষভাষার পরিণতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
নেতৃত্ব বা দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি কঠোর চিত্ত ও রুক্ষভাষী হন, অনুগামীগণ তাঁকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তারা পারত পক্ষে তাঁর নিকটে ঘেঁষতে চায় না।
ইসলামী সংগঠনে, ইসলামী সমাজে এমন পরিবেশ অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত।
এরপর আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
فَاعْفُ عَنْهُمْ .
‘তুমি তাদেরকে ক্ষমা করে দাও।’
اَلْعَفْوَ বা ক্ষমাশীলতা অতি উচ্চমানের একটি গুণ। আল্লাহ চান, নেতৃত্বের আসনে আসীন প্রত্যেক ব্যক্তি এই গুণে গুণান্বিত হোক।
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর অনুগামীদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। অনুরূপ নির্দেশ আমরা দেখতে পাই সূরা আল আ‘রাফের ১৯৯ নাম্বার আয়াতে। আল্লাহ বলেন,
خُذِ الْعَفْوَ وَاْمُرْ بِالْعُرْفِ وَاعَرِضْ عَنِ الْجَاهِلِيْنَ .
‘ক্ষমাশীলতা অবলম্বন কর, মা‘রূফ কাজের নির্দেশ দাও’ এবং জাহিলদেরকে এড়িয়ে চল।’
সূরা আল হিজরের ৮৫ নাম্বার আয়াতে তিনি বলেন,
فَاصْفَحِ الصَّفْحَ الْجَمِيْلَ .
‘অতএব তুমি অতি সুন্দরভাবে তাদেরকে ক্ষমা করে দাও।’
যদিও এইসব আয়াতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করা হয়েছে, প্রকৃত পক্ষে ইসলামী সমাজের সকল দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্যই এই নির্দেশ।
যিনি মহান আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
اَللّهُمَّ اِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّىْ .
(হে আল্লাহ, নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাকারী। আপনি ক্ষমা ভালোবাসেন। অতএব আমাকে ক্ষমা করুন।)
তিনি তাঁর অনুগামী বা সহকর্মীদের প্রতি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করবেন না, তা তো হতে পারে না।
এরপর আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ .
‘এবং তাদের জন্য (আল্লাহর নিকট) ক্ষমা প্রার্থনা কর।’
اَلاِسْتِغْفَارُ অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা।
এটিও মুমিন জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
সূরা মুহাম্মাদ-এর ১৯ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ .
‘এবং তুমি তোমার নিজের এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।’
ইসতিগফার-এর কল্যাণময়তা বুঝাতে গিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللهُ لَهُ مِنَ كُلِّ ضِيْقٍ مَخْرَجًا وَّ مِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَّ رَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ .
(আবদুল্লাহ ইবনুল আববাস (রা), সুনানু আবী দাউদ।)
‘যেই ব্যক্তি সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে আল্লাহ তাকে প্রতিটি সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ করে দেন, প্রতিটি দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেন এবং তার ধারণার অতীত উৎস থেকে তাকে রিযক দেন।’
অনুপস্থিত ব্যক্তির জন্য দু‘আ করার ফযিলত সম্পর্কে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
دَعْوَةُ الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ لاَخِيْهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ مَسْتَجَابَةٌ عِنْدَ رَأْسِهِ مَلَكٌ مُوَكَّلٌ كُلَّمَا دَعَا لاَخِيْهِ بِخَيْرٍٍ قَالَ الْمَلَكُ الْمُوَكَّلُ بِهِ امِيْنَ وَلَكَ بِمِثْلٍ .
(আবু দারদা (রা), ছাহীহ মুসলিম)
‘ভাইয়ের অসাক্ষাতে কোন মুসলিম ব্যক্তির দু‘আ তার জন্য কবুল হয়। তার মাথার কাছে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকে। যখন এ ব্যক্তি তার ভাইয়ের কল্যাণের জন্য দু‘আ করে তখন ঐ ফেরেশতা বলে, ‘আমীন, তোমার জন্যও অনুরূপ।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
خِيَارُ اَئِمَّتِِكُمُ الَّذِيْنَ تُحِبُّوْنَهُمْ وَيُحِبُّوْنَكُمْ وَتُصَلُّوْنَ عَلَيْهِمْ وَيُصَلُّوْنَ عَلَيْكُمْ وَشِرَارُ اَئِمَّتِكُمُ الَّذِيْنَ تُبْغِضُوْنَهُمْ وَ يُبْغِضُوْنَكُمْ وَتَلْعَنُوْنهُمْ وَيَلْعَنُوْنَكُمْ .
(আওফ ইবনু মালিক (রা), ছাহীহ মুসলিম।)
‘তোমাদের উত্তম নেতা তারা যাদেরকে তোমরা ভালোবাস, তারাও তোমাদেরকে ভালোবাসে। তোমরা তাদের জন্য দু‘আ কর, তারাও তোমাদের জন্য দু‘আ করে।
তোমাদের মন্দ নেতা তারা যাদেরকে তোমরা ঘৃণা কর, তারাও তোমাদেরকে ঘৃণা করে। তোমরা তাদেরকে অভিশাপ দাও, আর তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়।’
ইসতিগফার-এর ফযিলত বুঝাতে গিয়ে সূরা আল আনফালের ৩৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ .
‘এটা আল্লাহর নিয়ম নয় যে লোকেরা তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকবে আর তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন।’
আলোচ্য আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
وَشَاوِرْ هُمْ فِى الاَمْرُ .
‘এবং তাদের সাথে সামষ্টিক বিষয়ে পরামর্শ কর।’
اَلشُّوْرى অর্থ পরামর্শ।
হাফিয ইবনু হাজার আল আসকালানী (রহ) বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ করা শারীয়ার অন্যতম বিধান।’
আল হাসান ইবনু আবিল হাসান (রহ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম, যেই জনগোষ্ঠী পরামর্শ করে কাজ করে তারা সর্বোত্তম পন্থার সন্ধান পেয়ে যায়।’
নবুওয়াতের পঞ্চম সনে নাযিলকৃত সূরা আশ্ শূরার ৩৮ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে الشُوْرى শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন,
وَاَمْرُهُمْ شُوْرى بَيْنَهُمْ .
‘তাদের সামষ্টিক বিষয় পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নিষ্পন্ন হয়।’
আর এই আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামষ্টিক বিষয়ে অনুগামীদের সাথে পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি খুবই সূক্ষ্মদর্শী ও দূরদর্শী নেতা ছিলেন। তথাপিও তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্নভাবে তাঁর সহকর্মীদের সাথে পরামর্শ করতেন।
আবু হুরাইরা (রা) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহর চেয়ে বেশি পরামর্শ করতে আর কাউকে দেখিনি।’
(জামে আত্ তিরমিযী, ৩য় খন্ড, হাদীস নাম্বার ১৬৫৯)
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি রাতে ছালাতুল ইশার পর আবু বাকর আছ ছিদ্দিক (রা) ও উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) সাথে পরামর্শ করতেন।
আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে, তিনি ‘আশইয়াখে বাদরিন’ (বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রবীণ ছাহাবী)দেরকে ডাকতেন এবং তাঁদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন।
উহুদ যুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি যোদ্ধাদেরকে মাসজিদে নববীতে সমবেত করে যুদ্ধস্থল নির্ধারণ বিষয়ে পরামর্শ করেন।
পরামর্শ সম্পর্কে একটি সূক্ষ্ম কথা হচ্ছে, যতোক্ষণ পর্যন্ত চেয়ারের পক্ষ থেকে রুলিং দেওয়া না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত পরামর্শ একটি অভিমত, সিদ্ধান্ত নয়।
অভিমতের পক্ষে রুলিং দিলে তবেই তা সিদ্ধান্তে পরিণত হয়।
অতপর আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্বোধন করে বলেন,
فَاِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ ط
‘যখন তুমি সংকল্প গ্রহণ কর বা সিদ্ধান্তে উপনীত হও, তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল কর।’
عَزْمَةٌ অর্থ সংকল্প, সিদ্ধান্ত, করণীয় সম্পর্কে মনস্থির করে ফেলা।
নেতৃত্বকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে হতে হবে প্রশস্ত চিত্ত। অর্থাৎ তাকে উদার চিত্তে যতো বেশি সম্ভব লোকের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
আবার, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নেতৃত্বকে হতে হবে দৃঢ় চিত্ত।
সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যাওয়ার পর মন পুরোপুরি দোদুল্যমানতা মুক্ত করতে হবে।
একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করে পরিপূর্ণ মানসিক বলিষ্ঠতা সহকারে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে হবে।
আলোচ্য আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِيْنَ .
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদেরকে ভালোবাসেন।’
সূরা ইবরাহীম এর ১১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ .
‘এবং আল্লাহর ওপরই মুমিনদের তাওয়াক্কুল করা উচিত।’
সুলা আল ফুরকান-এর ৫৮ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَتَوَكَّلْ عَلىَ الْحَىِّ الَّذِىْ لاَ يَمُوْتُ .
‘সেই চিরঞ্জীব আল্লাহর ওপরই তাওয়াককুল কর যিনি মরেন না।’
সূরা আত্ তালাক-এর ৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ .
‘যেই ব্যক্তি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে তিনি তার জন্য যথেষ্ট।’
تَوَكُّلْ অর্থ ভরসা, নির্ভরতা, নির্ভরশীলতা।
ইকামাতুদ্ দীনের জন্য মুমিনদেরকে যতো বেশি সম্ভব মানবসম্পদ এবং বস্ত্ত সম্পদ জড়ো করতে হবে। কিন্তু মুমিনদেরকে ইয়াকীন রাখতে হবে যে বিজয়ের চাবিকাঠি সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের হাতে।
এই কথাটি মুমিনদের হৃদয়ে বদ্ধমূল করার জন্য আলোচ্য আয়াতের পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اِنْ يَّنْصُرْكُمُ اللّـهُ فَلاَ غَالِبَ لِكُمْ ج وَاِنْ يَّخْذُلْكُمْ فَمَنْ ذَالَّذِىْ يَنْصُرُكُمْ مِّنْ مبَعْدِه ط وَ عَلىَ اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ .
‘আল্লাহ যদি তোমাদেরকে সাহায্য করেন, এমন কোন শক্তি নেই তোমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে। আর তিনি যদি তোমাদেরকে পরিত্যাগ করেন, আর কে আছে তোমাদেরকে সাহায্য করার মতো! এবং মুমিনদের তো আল্লাহর ওপরই তাওয়াক্কুল করা উচিত।’
অন্যত্র আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَا النَّصْرُ اِلاَّ مِنْ عِنْدِ اللهِ الْعَزِيْزِ الْحَكِيْمِ . (আলে ইমরান ১২৬)
‘বিজ্ঞতাময় মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর নিকট থেকে ছাড়া অন্য কোথাও থেকে বিজয় আসে না।’
৫। শিক্ষা
১। অনুগামীদের ব্যাপারে কঠোর চিত্ততা পরিহার করতে হবে।
২। অনুগামীদের প্রতি রুক্ষভাষী হওয়া যাবে না।
৩। অনুগামীদের সাথে নম্র আচরণ করতে হবে।
৪। অনুগামীদের প্রতি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করতে হবে।
৫। অনুগামীদের জন্য সর্বদা মাগফিরাতের দু‘আ করতে হবে।
৬। অনুগামীদের সাথে পরামর্শ আদান-প্রদান করতে হবে।
৭। পরামর্শের পর সিদ্ধান্তে উপনীত হলে দৃঢ় চিত্ততা নিয়ে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে।
৮। যতো বেশি সম্ভব মানব সম্পদ ও বস্ত্ত সম্পদ জড়ো করতে হবে, কিন্তু তাওয়াক্কুল করতে হবে একমাত্র আল্লাহর ওপর। কেননা সাহায্য ও বিজয় একমাত্র আল্লাহর নিকট থেকেই এসে থাকে।
দারসুল কোরআন-৭(সূরা মায়েদা:আয়াত-৫৪,৫৫,৫৬)
يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ- يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (৫৪) إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ (৫৫) وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ (৫৬)
সরল অনুবাদ : “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি দ্বীন থেকে ফিরে যায় (তাহলে ফিরে যাক, আল্লাহ এমনিতর বহু লোক সৃষ্টি করে দেবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন এবং তারা আল্লাহকে ভালোবাসবে, যারা মুমিনদের ব্যাপারে কোমল ও কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর হবে, যারা আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা ও সাধনা করে যাবে এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে চান তাকে দান করেন। আল্লাহ ব্যাপক উপায় উপকরণের অধিকারী এবং তিনি সবকিছু জানেন। আসলে তোমাদের বন্ধু হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সেই ঈমানদাররা, যারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় অথচ তারা রুকু অবস্থায় থাকে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে, তাঁর রাসূলকে ও মুমিনদেরকে নিজের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তার জেনে রাখা দরকার, আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।” (সূরা মায়েদাহ, আয়াত : ৫৪-৫৬)
নামকরণ: এ সূরার ১১২ ও ১১৪ নম্বর আয়াতে উল্লিখিত ‘মায়েদাহ’ শব্দ থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। মায়েদা শব্দের অর্থ খাবারপূর্ণ পাত্র।
সূরা নাজিলের প্রেক্ষাপট: সর্বসম্মতভাবে এটি মাদানি সূরা। মদিনায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের মধ্যে এটি শেষের দিকের সূরা। আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. ও আসমা বিনতে ইয়াযিদ (রা) থেকে বর্ণিত আছে, সূরা মায়েদাহ নাজিলের সময় রাসূল (সা.) সফরে ‘আদবা’ নামীয় উটের পিঠে সাওয়ার ছিলেন। সাধারণত ওহি অবতরণের সময় যেরূপ অসাধারণ চাপ ও বোঝা অনুভূত হতো, তখনও তা যথারীতি অনুভূত হয়েছিল। এমনকি ওজনের চাপে উষ্ট্রী অক্ষম হয়ে পড়লে রাসূল (সা.) নিচে নেমে আসেন। (মুসনাদে আহমাদ-৬/৪৫৫) কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায় এটি ছিল বিদায় হজের সময়। আবু হাইয়ান বলেন, সূরা মায়েদার কিয়দংশ হোদাইবিয়ার সফরে, কিয়দংশ মক্কা বিজয়ের সফরে এবং কিছু অংশ বিদায়হজের সফরে নাজিল হয়। এতে বোঝা যায় সূরাটি সর্বশেষ সূরা না হলেও শেষ পর্যায়ে নাজিল হয়। (বাহরে মুহিত) যুবায়ের ইবনে নুফায়ের (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি একবার হজের পর আয়েশা (রা)-এর নিকট উপস্থিত হলে, তিনি বললেন, যুবায়ের তুমি কি সূরা মায়েদা পাঠ কর? তিনি বললেন, জি হ্যাঁ, পাঠ করি। আয়েশা (রা) বলেন, এটি কুরআনুল কারীমের শেষ সূরা। এতে হালাল ও হারামের যেসব বিধি-বিধান বর্ণিত আছে, তা অটল। এগুলো রহিত হওয়ার নয়। কাজেই এগুলোর প্রতি বিশেষ যতœবান থেকো। (মুস্তাদরেকে হাকেম ২/৩১১)
إِذْ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ هَلْ يَسْتَطِيعُ رَبُّكَ أَنْ يُنَزِّلَ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ قَالَ اتَّقُوا اللَّهَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (১১২)قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا وَآيَةً مِنْكَ وَارْزُقْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ (১১৪)
আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা:
{ ياأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِ }
মদিনা ও শ্যামবাসী পড়েন (يَرْتَدِدْ) । এ আয়াতে ঐ সমস্ত লোকদের কথা আলোচনা করা হয়েছে যারা ঈমানের ওপর টিকে থাকতে পারে না। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন তারা হলো, বনু আসাদ, গাতফান ও কিন্দা গোত্রের কিছু লোক। রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পরে আবু বকর (রা)-এর খিলাফতের সময় তারা মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী হয়।
মুরতাদদের মধ্যে বনু হানিফা গোত্রের নেতা মুসাইলামাতুল কায্যাব রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশায় দশম হিজরির শেষ দিকে নবুয়ত দাবি করে এবং চিঠি নিয়ে তার দুইজন অনুসারী নাহশাল ও হাকাম ইবনে তুফাইলকে রাসূল (সা.)-এর নিকট প্রেরণ করে। চিঠির ভাষা ছিল নি¤œরূপ :
” مِنْ مُسَيْلَمَةَ رَسُولِ اللهِ إلَى مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللهِ ؛ أمَّا بَعْدُ : فَإنَّ الأَرْضَ نَصْفُهَا لِي وَنِصْفُهَا لَكَ!
“আল্লাহর রাসূল মুসাইলামার পক্ষ থেকে মুহাম্মাদুর রাসূল (সা.)-এর প্রতি। অতঃপর কথা হলো, জমিনের অর্ধেক আমার এবং অর্ধেক আপনার।”
পত্র পড়ে রাসূল (সা.) দূতদ্বয়কে জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা কি সাক্ষ্য দিচ্ছ মুসাইলামা আল্লাহর রাসূল? তখন তারা বলল হ্যাঁ। রাসূল (সা.) বললেন, দূত হত্যা যদি অবৈধ না হতো তাহলে আমি তোমাদের ঘাড় বিচ্ছিন্ন করে দিতাম। এরপর রাসূল (সা.) মুসাইলামাতুল কায্যাবের নিকট পত্র লিখে বলেন,
” مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللهِ إلَى مُسَيْلَمَةَ الْكَذاب ؛ أمَّا بَعْدُ : فَإنَّ الأَرْضَ للهِ يُورثُهَا مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ ، وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ “.
“আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-এর পক্ষ থেকে মুসাইলামাতুল কায্যাবের প্রতি: জমিনের মালিকানা আল্লাহর তিনি যাকে ইচ্ছা তার বান্দাদের থেকে এর উত্তরাধিকার বানান। আর শেষ পরিণতি মুত্তাকিদের পক্ষে।”
পত্র লেখার পরপর রাসূল (সা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কিছুদিন পরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফলে মুসাইলামাতুল কায্যাব দিন দিন তার কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে থাকে। আবু বকর (রা.) খিলাফত লাভের পর খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-এর নেতৃত্বে তিনি বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। বাহিনী তাদেরকে পরাজিত করে এবং রাসূল (সা.)-এর চাচা হামজা (রা)-এর হত্যাকারী ওয়াহশি (রা) মুসাইলামাতুল কায্যাবকে হত্যা করেন এবং এভাবে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন:
(قَتَلْتُ خَيْرَ النَّاسِ فِي الْجَاهِلِيَّةِ ، وَقَتَلْتُ شَرَّ النَّاسِ فِي الإسْلاَمِ).
“আমি জাহেলি যুগে সবচেয়ে ভালো মানুষকে হত্যা করেছি, আর ইসলাম গ্রহণ করে সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোককে হত্যা করেছি।”
মিথ্যা নবুওয়াত দাবিদারদের মধ্যে আর একজন ছিলো বনু আসওয়াদ গোত্রের তালহা ইবনে খুওয়াইলিদ। সেও রাসূল (সা.) এর সময় মিথ্যা নবুওয়াত দাবি করে। আবু বকর (রা) খিলাফত লাভের পর খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) এর নেতৃত্বে তিনি বাহিনী প্রেরণ করেন। বাহিনী তাদেরকে পরাজিত করে এবং তালহা ইবনে খুওয়াইলিদ শ্যামদেশে পলায়ন করে বনু হানিফা গোত্রে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে নিষ্ঠাবান মুসলমানে পরিণত হন।
রাসূল (সা.)-এর ওয়াফাতের পর আরব গোত্রগুলোর মধ্যে ইসলাম ত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। বনু ফাজারা গোত্র উয়ায়না ইবনে হাসিনের নেতৃত্বে, বনু সুলাইম, বনু ইয়ারবু’ এবং বনু তামিমের একটি গ্রুপ একজন নারী সাজ্জাহ বিনতে মুনজিরের নেতৃত্বে ধর্মত্যাগ করেছিল এবং সে মিথ্যা নবুওয়াত দাবি করেছিল। সাজ্জাহ পরবর্তীতে মুসাইলামাতুল কায্যাবকে বিবাহ করে। বনু কিনদাহ গোত্র আসওয়াস ইবনে কায়েসের নেতৃত্বে ধর্মত্যাগ করেছিল। বনু বকর ইবনে ওয়ায়েল বাহরাইনে ধর্মত্যাগ করেছিল। আল্লাহ রব্বুল আলামিন স্বীয় অনুগ্রহে আবু বকর (রা)এর হাতে সকল ভ-, মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার এবং ইসলামত্যাগীদের পরাজিত করেন। ইবনে ইসহাক বলেন: রাসূল (সা.) এর ওয়াফাতের পর তিনটি মসজিদ ব্যতীত সর্বত্রই ইসলাম ত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়, প্রথমটি মদিনার মসজিদ, দ্বিতীয়টি মসজিদে মক্কা, তৃতীয়টি বাহরাইনের মসজিদে জাওয়াসি। উল্লেখ্য, মদিনার মসজিদের পর প্রথম জুমার নামাজ এখানেই হয়। ঐতিহাসিক হুসাইন হায়কল তাঁর রচিত বই ‘মহানবী (সা.)-এর জীবন-চরিতে’ বলেন: রাসূল (সা.)-এর ওফাতের পর মক্কার বাসিন্দারাও ধর্মত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এমনকি রাসূল (সা.) কর্তৃক নিযুক্ত মক্কার প্রশাসক আত্তাব ইবনে উসাইদ ধর্মত্যাগীদের ভয়ে আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। এরূপ নাজুক পরিস্থিতিতে হযরত সুহাইল ইবনে আমর (রা) অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন এবং যুগান্তকারী এক ভাষণ প্রদান করেন। তিনি বলেন, “এই হৃদয়বিদারক অবস্থায় ইসলামের শক্তি বাড়বে বৈ কমবে না। যে ব্যক্তি ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব প্রকাশ করবে, আমরা তার শির উড়িয়ে দিব।” এর পর তিনি বলেন, “হে মক্কাবাসী! তোমরা সবার শেষে ইসলাম গ্রহণ করেছো, আবার সবার আগে ধর্মত্যাগী হয়ো না। আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অবশ্যই ইসলামের বিজয় নিশ্চিত করবেন।” হযরত সুহাইল ইবনে আমর (রা.) এর তেজোদীপ্ত ভাষণের পর মক্কাবাসীদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয়ে যায় এবং তারা ঈমানের ওপর অটল থাকেন।
রাসূল (সা.) এর ওফাতের পর আরব গোত্রগুলোর ধর্মত্যাগ দুই ধরনের ছিল, এক: শরিয়াতের সকল বিধানকে অস্বীকার করে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া, দুই: শরিয়াতের সকল বিধান মেনে শুধুমাত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করা। আবু বকর (রা) দুই শ্রেণীর বিরুদ্ধেই জিহাদ ঘোষণা করেন এবং তাদেরকে দমন করেন। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, “কেউ যদি যাকাত প্রদানের জন্য নির্ধারিত পশুর রশিটিও দিতে অস্বীকার করে তাহলে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব।”
ধর্মত্যাগীদের ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্য : সূরা মায়েদাহ
يَا قَوْمِ ادْخُلُوا الْأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ الَّتِي كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ وَلَا تَرْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِكُمْ فَتَنْقَلِبُوا خَاسِرِينَ (২১)
(মূসা আ. বলেন) হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি লিখে দিয়েছেন তাতে তোমরা প্রবেশ কর। এবং পশ্চাদপসরণ করো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে।
সূরা আলে-ইমরান
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تُطِيعُوا الَّذِينَ كَفَرُوا يَرُدُّوكُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ فَتَنْقَلِبُوا خَاسِرِينَ (১৪৯)
হে মুমিণগণ! যদি তোমরা কাফেরদের আনুগত্য কর তবে তারা তোমাদেরকে বিপরীত দিকে ফিরিয়ে দেবে ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে। (১৪৯ নং আয়াত)
. ا أَيُّهَا الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ آمِنُوا بِمَا نَزَّلْنَا مُصَدِّقًا لِمَا مَعَكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَطْمِسَ وُجُوهًا فَنَرُدَّهَا عَلَى أَدْبَارِهَا أَوْ نَلْعَنَهُمْ كَمَا لَعَنَّا أَصْحَابَ السَّبْتِ وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ مَفْعُولًا
“হে কিতাবপ্রাপ্তগণ! তোমাদের কাছে যা আছে তার সমার্থকরূপে আমরা যা নাযিল করেছি তাতে তোমরা ঈমান আন, আমরা মুখম-লগুলোকে বিকৃত করে তারপর সেগুলোকে পিছনে ফিরিয়ে দেয়ার আগে অথবা আসহাবুস সাবতকে যেরূপ লানত করেছিলাম সেরূপ তাদেরকে লানত করার আগে। আর আল্লাহর আদেশ কার্যকর হয়েই থাকে।” (আল-ইমরান : ৪৭)
وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ (১০৫) يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ (১০৬)
তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। আর তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি। (১০৫) সেদিন কিছু মুখ উজ্জ্বল হবে এবং কিছু মুখ কালো হবে; যাদের মুখ কালো হবে (তাদেরকে বলা হবে) তোমরা কি ঈমান আনার পর কুফরি করেছিলে? সুতরাং তোমরা শাস্তি ভোগ কর, যেহেতু তোমরা কুফরি করতে। (১০৬)
রাসূল (সা.) বলেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّهُ كَانَ يُحَدِّثُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ : يَرِدُ عَلَيَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَهْطٌ مِنْ أَصْحَابِي فَيُحَلَّؤُونَ ، عَنِ الْحَوْضِ فَأَقُولُ يَا رَبِّ أَصْحَابِي فَيَقُولُ إِنَّكَ لاَ عِلْمَ لَكَ بِمَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ إِنَّهُمُ ارْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِهِمُ الْقَهْقَرَى.
আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমার কতক সাহাবী হাউজে আমার কাছে উপস্থিত হবে। তারপর আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বলবো, হে আমার রব! এরা তো আমার সাহাবী (উম্মত)। আমাকে বলা হবে আপনি জানেন না, আপনার অবর্তমানে এরা দ্বীনবহির্ভূত কত নতুন কাজ করেছে।
রাসূল (সা.) আরো বলেন,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا ، قَالَ : خَطَبَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ إِنَّكُمْ مَحْشُورُونَ إِلَى اللهِ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلاً {كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُعِيدُهُ وَعْدًا عَلَيْنَا إِنَّا كُنَّا فَاعِلِينَ} ثُمَّ إِنَّ أَوَّلَ مَنْ يُكْسَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِبْرَاهِيمُ أَلاَ إِنَّهُ يُجَاءُ بِرِجَالٍ مِنْ أُمَّتِي فَيُؤْخَذُ بِهِمْ ذَاتَ الشِّمَالِ فَأَقُولُ يَا رَبِّ أَصْحَابِي فَيُقَالُ لاَ تَدْرِي مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ فَأَقُولُ كَمَا قَالَ الْعَبْدُ الصَّالِحُ {وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ} إِلَى قَوْلِهِ {شَهِيدٌ} فَيُقَالُ إِنَّ هَؤُلاَءِ لَمْ يَزَالُوا مُرْتَدِّينَ عَلَى أَعْقَابِهِمْ مُنْذُ فَارَقْتَهُمْ.
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) একদিন খুতবা দিলেন। তিনি বললেন: হে লোকজন কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে নগ্নপদে, নগ্নদেহে ও খাতনাবিহীন অবস্থায় উঠিয়ে আল্লাহর সামনে একত্রিত করা হবে। তারপর তিনি এ আয়াতটি পাঠ করলেন: আমি তোমাদেরকে পুনরায় ফিরিয়ে আনবো যেমন প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম। এটা আমার প্রতিশ্রুতি, এটা আমি অবশ্যই পূরণ করবো। এ আয়াতটি পাঠ করার পর তিনি বললেন, গোটা সৃষ্টিকুলের মধ্যে যাকে কাপড় পরানো হবে তিনি হলেন হযরত ইবরাহিম (আ)। জেনে রাখ আমার উম্মতের কিছু লোককে আনা হবে। তাদেরকে পাকড়াও করে দোজখের দিকে নিতে শুরু করলে আমি বলবো, হে রব এ দেখছি আমার উম্মতের কিছু লোক। তখন বলা হবে, তুমি জানো না, তোমার বিদায় হয়ে আসার পর তারা কী কী কাজ করেছিলো। তখন আমি আল্লাহর নেক বান্দা (ঈসা (আ)-এর অনুরূপ কথা বলবো: আমি যতদিন তাদের মাঝে ছিলাম, ততদিনই তাদের খোঁজ-খবর নিয়েছি ও তত্ত্বাবধান করেছি। তারপর আপনি যখন আমাকে উঠিয়ে নিয়েছেন, তখন থেকে আপনিই তাদের রক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক। আপনি তো সবকিছুর রক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক। এরপর যখন আমাকে বলা হবে, যখন থেকে আপনি তাদেরকে রেখে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে এসেছেন তখন থেকেই তারা দীনকে পরিত্যাগ করেছে।
قَوْلُهُ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى : { فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ }
ঈমানদারদের উদ্দেশ করে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, যদি তোমরা আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও এবং শরিয়তের ওপর অবিচল না থাক তাহলে তোমাদের চেয়ে উত্তম লোকদেরকে আমি তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবো। যেমন সূরা মুহাম্মদে আল্লাহ বলেন,
وَإِن تَتَوَلَّوْاْ يَسْتَبْدِلْ قَوْماً غَيْرَكُمْ ثُمَّ لاَ يكونوا أَمْثَالَكُم
অর্থাৎ: “তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আল্লাহ তোমাদের স্থানে অন্য কোন জাতিকে নিয়ে আসবেন। তারা তোমাদের মত হবে না।” (৩৮ নং আয়াত)
সূরা নিসাতে আল্লাহ বলেন,
{ إِن يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ أَيُّهَا الناس وَيَأْتِ بِآخَرِينَ } [ النساء : ১৩৩ ]
অর্থাৎ: “তিনি চাইলে তোমাদেরকে সরিয়ে তোমাদের জায়গায় অন্যদেরকে নিয়ে আসবেন এবং তিনি এ ব্যাপারে পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন।”
সূরা ইবরাহিমে আল্লাহ বলেন,
{ إِن يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَأْتِ بِخَلْقٍ جَدِيدٍ وَمَا ذلك عَلَى الله بِعَزِيزٍ } [ إبراهيم : ১৯-২০ ]
অর্থাৎ: “তিনি চাইলে তোমাদের নিয়ে যান এবং একটি নতুন সৃষ্টি তোমাদের স্থলাভিষিক্ত হয়। এমনটি করা তাঁর জন্য মোটেও কঠিন নয়।”
উপরোক্ত আয়াতাংশে মুফাস্সিরিনদের ৬টি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য: এক: আলী ইবনে আবি তালিব, হাসান, কাতদাহ এবং দাহ্হাক বলেন, এ আয়াত দ্বারা আবু বকর (রা) এবং যারা রিদ্দার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাদেরকে বুঝানো হয়েছে। দুই : হাসানের আরেকটি বর্ণনা হলো এর দ্বারা আবু বকর (রা) ও উমার (রা)কে বুঝানো হয়েছে। তিন : ইয়াদ আল-আশআ’রী বলেন, এর দ্বারা আবু মুসা আল-আশআ’রীর কওমকে বুঝানো হয়েছে। চার: দাহ্হাক, ইবনে আব্বাস এবং মুজাহিদ বলেন, এর দ্বারা ইয়েমেনবাসীদেরকে বুঝানো হয়েছে। পাঁচ: সুদ্দি বলেন, আনসারদেরকে বুঝানো হয়েছে। ছয়: আবু সুলাইমান আদ-দামেশকি বলেন, উনারা হলেন আনসার ও মুহাজির। ইবনে জারির বলেন তাঁরা উমার (রা) এর সময়ের লোক, তারা সুন্দরভাবে ইসলামের ওপর ছিলো কখনও মুরতাদ হয়নি।
আল্লাহ যাদেরকে পছন্দ করেন তাদের বৈশিষ্ট্য
১থ التوابون. তাওবাকারীগণ
২থ المتطهرون. পবিত্রতা অর্জনকারীগণ
৩থ المتقون. আল্লাহকে ভয়কারীগণ
৪থ المحسنون. মুহসিনগণ
৫থ الصابرون. ধৈর্যধারণকারীগণ
৬থ المتوكلون. ভরসাকারীগণ
৭থ المقسطون. ন্যায়বিচারকারীগণ
৮থ الذين يقاتلون في سبيله صفَّاً كأنهم بينان مرصوص. আল্লাহর রাস্তায় সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় জিহাদকারীগণ
৯থ الأذلة على المؤمنين. মুমিনগণের সাথে কোমল ব্যবহারকারীগণ
১০থ الأعزة على الكافرين. কাফেরদের ব্যাপারে রুঢ়
১১থ المجاهدون في سبيل الله. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী
১২থ الذين لا يخافون لومة لائم. যারা সত্যের ব্যাপারে কোন নিন্দুকের নিন্দাকে পরোয়া করে না
১৩থ المتقربون بالنوافل بعد الفرائض. ফরজ আদায়ের পর যারা নফল আদায় করে
যে সমস্ত কাজ আল্লাহর ভালোবাসার বা নৈকট্যের কারণ হয়
১. কুরআন বুঝে পড়া এবং অনুধাবন করার চেষ্টা করা
২. ফরজ আদায়ের পর নফলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করা
৩. সকল অবস্থায় কথা, কাজ ও অন্তরে আল্লাহর স্মরণ
৪. নফসের পছন্দের চেয়ে আল্লাহর পছন্দকে প্রাধান্য দেয়া
৫. আল্লাহর জাত, সিফাত তাঁর উপস্থিতি এবং তাঁকে চেনার মাধ্যমে সর্বদা অন্তরকে পরিচালিত করা
৬. আল্লাহর নিয়ামত, অনুগ্রহ, অনুকম্পা এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নিয়ামতের সাক্ষ্য দেয়া
৭. আল্লাহর যাবতীয় অনুগ্রহের স্মরণে তাঁর সামনে অন্তর ভেঙে পড়া
৮. নির্জনে, মুনাজাতে, কুরআন তেলাওয়াতে, তাঁর সামনে দাঁড়ানোর সময়, ইবাদতে বিনয়ী হয়ে, বিশেষ করে তওবাহ ও ইসতিগফারের মাধ্যমে ভালোবাসা অর্জন
৯. সত্যবাদীদের সাথে ওঠা-বসা ও তাদের কাছে কল্যাণের কথা শুনা
১০. আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে এমন কাজ থেকে বিরত থাকা। এবং সর্বদা এই দোয়া করা
اللهم إنا نسألك حبك، وحبَّ من يحبك، وحبَّ العمل الذي يقربنا إلى حبِّك.
এর ব্যাখ্যা: أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ
এখানে যে কওমকে আল্লাহ ভালবাসেন এবং যারা আল্লাহকে ভালবাসেন তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁরা মুমিনদের ব্যাপারে অত্যন্ত রহমদিল এবং কাফেরদের ব্যাপারে বজ্রকঠিন। সূরা ফাতাহ এর ২৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
:” أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَماءُ بَيْنَهُمْ الفتح: ২৯].
তাঁরা মুমিনদের ব্যাপারে এতটাই কোমল হৃদয়ের অধিকারী যেটা শুধুমাত্র মানুষ আপনজনদের ব্যাপারে করে, আর কাফিরদের ব্যাপারে এতটাই কঠোর যদিও তারা আপনজন হয়। সূরা মুজাদালার ২২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আপনি পাবেন না আল্লাহ ও আখিরাতের উপর ঈমানদার এমন কোন সম্প্রদায়, যারা ভালোবাসে তাদেরকে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে.. হোক না এ বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা এদের জ্ঞাতি-গোত্র। এদের অন্তরে আল্লাহ লিখে দিয়েছেন ঈমান এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা। আর তিনি তাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে; আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম।”
لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُولَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ أُولَئِكَ حِزْبُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (২২)
“আপনি পাবেন না আল্লাহ ও আখিরাতের উপর ঈমানদার এমন কোন সম্প্রদায়, যারা ভালোবাসে তাদেরকে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে.. হোক না এ বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা এদের জ্ঞাতি-গোত্র। এদের অন্তরে আল্লাহ লিখে দিয়েছেন ঈমান এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা। আর তিনি তাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে; আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম।” (সুরা মুজাদালাহ : ২২)
সূরা তওবার ২৩ ও ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيمَانِ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ (২৩) قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ (২৪)
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পিতৃবর্গ ও ভ্রাতৃবৃন্দ যদি ঈমানের মোকাবিলায় কুফরিকে পছন্দ করে, তবে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই জালিম। (২৩) বলুন, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতৃবর্গ, তোমাদের সন্তানরা, তোমাদের ভ্রাতাগণ, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আপনগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশঙ্কা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালোবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হেদায়েত দেন না। (২৪)”
ঈমানদারদের জন্য নীতিকথা হলো : সত্য দ্বীনের প্রতি ঈমান ও দ্বীনের শত্রুদের সাথে ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব দুটি পরস্পরবিরোধী জিনিস। ঈমানের দাবিদাররা এরূপ করলে নিফাকি হবে। কোন অবস্থাতেই দুই নৌকায় পা দেয়া যাবে না।
রাসূল (সা.) বলেন,
وقال الإمام أحمد: حدثنا قتيبة بن سعيد، حدثنا ابن لهيعة، عن زهرة بن معبد، عن جده قال: كنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم، وهو آخذ بيد عمر بن الخطاب، فقال: والله لأنت يا رسول الله أحب إلي من كل شيء إلا من نفسي فقال رسول الله (৩) صلى الله عليه وسلم: “لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من نفسه”. فقال عمر: فأنت الآن والله أحب إلي من نفسي. فقال رسول الله: “الآن يا عمر”
“যুহরা ইবনে মাবাদ তার দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূল সা.-এর সাথে ছিলাম তিনি উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)-এর হাত ধরলেন। উমার (রা) বললেন, আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রাসূল সা.! আমার জান ছাড়া এই পৃথিবীর সবকিছুর থেকে আপনি আমার কাছে প্রিয়। রাসূল (সা.) বললেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি ঈমানদার হতে পারবে না, যার জান থেকে আমি প্রিয় না হবো। উমার রা. বললেন, আল্লাহর কসম! এখন আপনিই আমার কাছে আমার জান অপেক্ষা প্রিয়। আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, হ্যাঁ এখন ঠিক বলেছ হে উমার।” (মুসনাদে আহমাদ)
অন্য হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন,
وقد ثبت في الصحيح عنه رسول الله صلى الله عليه وسلم أنه قال: “والذي نفسي بيده، لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس أجمعين”
“সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি ততক্ষণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সকল মানুষ থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল প্রিয় না হবে।” (বুখারি ও মুসলিম)
প্রকৃত ঘটনা হলো:
ক্স আবু উবাদাহ (রা) বদরের যুদ্ধের দিন তাঁর নিজের পিতা আবদুল্লাহ ইবনুল র্জারাহকে হত্যা করেছিলেন।
ক্স মুসআব ইবনে উমায়ের (রা) জিহাদের ময়দানে তাঁর আপন ভাই উবায়িদ ইবনে উমাইয়রকে হত্যা করেছিলেন।
ক্স উমার (রা) তাঁর মামা আস ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাহকে হত্যা করেছিলেন।
ক্স আবু বকর (রা) তাঁর পুত্র আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত হয়েছিলেন।
ক্স আলী (রা) নিকটাত্মীয় উতবা, হামজা (রা) নিকটাত্মীয় শায়বা, উবাইদা ইবনুল হারেস (রা) নিকটাত্মীয় ওয়ালিদ ইবনে উতবাহকে হত্যা করেছিলেন।
ক্স বদরের বন্দীদের ব্যাপারে উমার (রা) এর মতামত ছিল প্রত্যেকে তাঁর সবচেয়ে আপনজনকে হত্যা করবে।
ক্স বদরের যুদ্ধে এক আনসারী মুসআব উবনে উমায়েরের আপন ভাই আবু আযীয ইবনে উমায়েরকে পাকড়াও করে বাঁধছিলেন। এ অবস্থা দেখে মুসআব (রা) চিৎকার করে বলেন, শক্ত করে বাঁধো, এর মা অনেক সম্পদশালিনী সে অনেক মুক্তিপণ দিবে।
ক্স রাসূল (সা.) এর জামাতা আবুল আস বদরের যুদ্ধে বন্দী হয়ে আসেন।
এ কারণে রাসূল (সা.) এভাবে দোয়া করতেন: “হে আল্লাহ আমাকে কোন পাপী/ফাসিক লোক দ্বারা উপকৃত হতে দিয়ো না। তাহলে আমার মনে তার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হবে। কেননা তোমার নাযিলকৃত ওহির মধ্যে একথা পেয়েছি যে, আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণকারী লোকদেরকে তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবে না।” দায়লামী মুয়াজ (রা) থেকে বর্ণিত।
يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
-এর ব্যাখ্যা
যে কওমকে আল্লাহ ভালবাসেন এবং যারা আল্লাহকে ভালবাসেন তাদের আরো একটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে সেটি হলো, তাঁরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে কিন্তু কোন নিন্দুকের নিন্দাকে পরোয়া করবে না। মুফাস্িসরিনগণ বলেন, এ আয়াত দ্বারা আবু বকর, উমার, উসমান ও আলী (রা)কে বুঝানো হয়েছে। কেননা তারা রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশায়ও জিহাদ করেছিলেন এবং নিজেদের খিলাফত আমলে মুরতাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন:
وفي الحديث الصحيح (إن الشيطان قعد لابن آدم ثلاث مقاعد قعد له في طريق الإسلام فقال لم تذر دينك ودين آبائك فخالفه وأسلم وقعد له في طريق الهجرة فقال له أتذر مالك وأهلك فخالفه وهاجر ثم قعد في طريق الجهاد فقال له تجاهد فتقتل فينكح أهلك ويقسم مالك فخالفه وجاهد فحق على الله أن يدخله الجنة
নিশ্চয়ই শয়তান বনি আদমকে পথভ্রষ্ট করার জন্য তিন সময় পথে বসে থাকে। এক : ইসলাম গ্রহণের সময় সে বলে তোমার এবং তোমার বাপ দাদার ধর্ম পরিত্যাগ করো না, কিন্তু প্রকৃত ঈমানদাররা সে ধোঁকা অতিক্রম করে এবং ইসলাম গ্রহণ করে। দুই : হিজরতের সময় শয়তান বলে তুমি কি তোমার মাল ও আহল ছেড়ে চলে যাবে? অতঃপর বনি আদম সে ধোঁকা অতিক্রম করে হিজরত করে। তিন: জিহাদের সময় শয়তান বলে তুমি যদি নিহত হও তাহলে তোমার স্ত্রীরা অন্যত্র বিবাহ করবে এবং তোমার সম্পদ অন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হবে। অতঃপর বনি আদম সে বাধা অতিক্রম করে জিহাদে যায় এরকম বনি আদমকে জান্নাত দেয়া আল্লাহর জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়েছে যে, আল্লাহর আনুগত্য, দ্বীন প্রতিষ্ঠা, শরয়ী বিধান বাস্তবায়ন, শত্রুর সাথে কিতাল, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ থেকে হাজারও প্রতিকূল পরিবেশে তাকে কেউ ফিরিয়ে রাখতে পারে না। রাসূল (সা.) বলেন,
قال الإمام أحمد عن عبد الله بن الصامت عن أبي ذر قال : ্র أمرني خليلي صلى الله عليه وسلم بسبع : أمرني بحب المساكين والدنو منهم ، وأمرني أن أنظر إلى من هو دوني ، ولا أنظر إلى من هو فوقي ، وأمرني أن أصل الرحم وإن أدبرت ، وأمرني أن لا أسال أحداً شيئاً ، وأمرني أن أقول الحق وإن كان مراً ، وأمرني أن لا أخاف في الله لومة لائم ، وأمرني أن أكثر من قول : لا حول ولا قوة إلاّ بالله ، فإنهن من كنز تحت العرش গ্ধ
আবু যার (রা) বলেন, আমাকে আমার হাবিব রাসূল (সা.) সাতটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন: ১. আমাকে মিসকিনদেরকে ভালবাসতে এবং তাদের কাছাকাছি (সুখ-দুঃখ) দেখতে নির্দেশ দিয়েছেন ২. আমার উপরস্থ কারোর দিকে দৃষ্টি না দিয়ে নিচের দিকে কারোর দিকে তাকাতে বলেছেন ৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন যদি সেটা ছুটে যায় ৪. কারো নিকট কিছু না চাইতে নির্দেশ দিয়েছেন ৫. সর্বদা সত্য (হক) কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন যদিও সেটা অন্যের নিকট তিক্ত হয় ৬. আল্লাহর (বিধানের) ব্যাপারে কোন নিন্দুকের নিন্দাকে পরোয়া না করতে নির্দেশ দিয়েছেন ৭. রাসূল (সা.) আমাকে বেশি বেশি পড়তে বলেছেন
لا حول ولا قوة إلاّ بالله
কেননা এগুলো আরশের নিচের গুপ্তধন।
ذلك فَضْلُ الله يُؤْتِيهِ مَن يَشَآءُ والله وَاسِعٌ عَلِيمٌ
উপরিউক্ত গুণাবলীর অধিকারী হওয়াটা কোন ব্যক্তির নিজস্ব অর্জন বা সফলতা নয় বরং সবটুকু আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ যা তিনি তাঁর পছন্দনীয় বান্দাদেরকে দান করেন। আল্লাহর অনুগ্রহ সর্বব্যাপী এবং আর আল্লাহ ছাড়া সবকিছু কেউ জানতে পারে না।
قَوْلُهُ عَزَّ وَجَلَّ : إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُواْ الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلاَةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল আবদুল্লাহ ইবনে সালাম ও তাঁর সাথীদের এবং আলী ইবনে আবু তালিব (রা) এর ব্যাপারে নাযিল হয়। তাঁরা আল্লাহর রাসূল (সা.) কে বলেছিল হে রাসূল (সা.)! আমাদের বাড়িগুলো কিস্সা কাহিনীতে ভরপুর, মসজিদ ছাড়া কথাবার্তা বলার জন্য আমরা কোন জায়গা পাই না। আমাদের কওম বনু কুরাইজা এবং বনু নাযির যখন দেখল আমরা তাদের ধর্ম ছেড়ে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি তখন তারা আমাদের প্রকাশ্য বিরোধিতা শুরু করল এবং কসম করে বলল, কোন অবস্থাতেই তারা আমাদের সাথে বিবাহ-শাদি, ওঠা-বসা ও খাওয়া-দাওয়া করবে না। অন্যদিকে দূরত্বের কারণে আপনার সাথীদের সাথে ওঠা-বসা করতে পারছি না। লোকেরা যখন নামাজের রুকু- সিজদা করছিলো তখন তারা রাসূল (সা.)কে এসব অভিযোগ করছিল। একজন মিসকিন ঘুরে ঘুরে সাহায্য চাচ্ছিল, রাসূল (সা.) তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন তোমাকে কি কেউ কিছু দিয়েছে? সে বলল হ্যাঁ। রাসূল (সা.) বললেন কি দিয়েছে? সে বলল রূপার আংটি। রাসূল (সা.) বললেন এটি কে তোমাকে দিয়েছে? সে ইশারা দিয়ে বলল ঐ ব্যক্তি। তিনি ছিলেন আলী (রা)। রাসূল (সা.) বললেন সে কোন অবস্থায় আংটিটি তোমাকে দিয়েছে? লোকটি বলল, তখন সে রুকু অবস্থায় ছিলো। অতঃপর রাসূল (সা.) আবদুল্লাহ ইবনে সালাম ও তার সাথীদের সামনে এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন। রাসূল (সা.) এ আয়াত পড়ার সাথে সাথে আবদুল্লাহ ইবনে সালাম বললেন,
(رَضِينَا باللهِ وَبرَسُولِهِ وَبالْمُؤْمِنِينَ أوْلِيَاءً).
অর্থাৎ: আমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদেরকে অভিভাবক হিসাবে পেয়ে সন্তুষ্ট।
এর ব্যাখ্যা: وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ (৫৬)
অর্থাৎ যারা আল্লাহর আনুগত্য, তাঁর রাসূলের আনুগত্য ও মুমিনদের আনুগত্য ও ভালোবাসা থেকে অন্যদের আনুগত্য ও ভালোবাসাকে অধিক কল্যাণকর মনে করবে তাদের জন্য আল্লাহর সতর্কবাণী ‘নিশ্চয় আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।’ সূরা মুজাদালার ২১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
كَتَبَ الله لأَغْلِبَنَّ أَنَاْ ورسلي إِنَّ الله قَوِيٌّ عَزِيزٌ *
আল্লাহ লিখে দিয়েছেন যে, তিনি এবং তাঁর রাসূল অবশ্যই বিজয়ী হবেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মহাশক্তিমান ও পরাক্রমশালী। হাসান বলেন, حزب الله অর্থ: جند الله আল্লাহর সৈন্য। আরবিতে حزب অর্থ: দল, গোষ্ঠী বা জামায়াত। বহুবচনে ‘আহযাব’ যার অথর্: সংঘবদ্ধ দলসমূহ। অন্যরা বলেন, حزب الله অর্থ: أنصار الله আল্লাহর সাহায্যকারী। অতএব একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, যারা আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদেরকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করবে তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে নিশ্চিত সাহায্য ও সফলতা। যে সব মুসলিম আল্লাহর নির্দেশ পালন করবে তারা আল্লাহর দল। আল্লাহর রাসূল ও পরবর্তীতে সাহাবায়েকেরাম রা. সর্বত্র বিজয়ী হয়েছেন। সূরা সাফ্ফাতে আল্লাহ বলেন,
إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنْصُورُونَ (১৭২) وَإِنَّ جُنْدَنَا لَهُمُ الْغَالِبُونَ (১৭৩)
‘নিশ্চয় তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। ১৭২ আর আমাদের বাহিনী অবশ্যই বিজয়ী হবে।’ ১৭৩
সূরা শামসে আল্লাহ বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا (৯) وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا (১০)
“সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে নিজেকে পবিত্র করেছে। ৯ আর সে-ই ব্যর্থ হয়েছে, যে নিজেকে কলুষিত করেছে।” ১০
সূরা আলাতে আল্লাহ বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى (১৪)
‘অবশ্যই সাফল্য লাভ করবে সেই যে পরিশুদ্ধ হয়।’
সূরা মুমিনুনে আল্লাহ বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ (১)
নিশ্চয় মুমিনরাই সফলকাম হয়েছে।
আয়াতগুলোর শিক্ষা:
১. আল্লাহর দ্বীন থেকে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী চলে গেলে তাতে আল্লাহর কোন ক্ষতি হয় না বরং তাদের পরিবর্তে আল্লাহ অন্যদের নিয়ে আসবেন।
২. মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে অত্যন্ত কোমল।
৩. মুমিনরা কাফেরদের ব্যাপারে হবে খুবই কঠোর।
৪. আল্লাহর পথে জিহাদের পথে কোন নিন্দুকের নিন্দাকে পরোয়া করবে না।
৫. আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া কেউ দ্বীনের পথে টিকে থাকতে পারে না এবং সৎকাজ করতে পারে না।
৬. আল্লাহ-বিরোধীদের সাথে কোন বন্ধুত্ব হতে পারে না, তারা যতই আপনজন হোক।
৭. সকল পরীক্ষা ও বাধা মাড়িয়ে চূড়ান্তভাবে আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।
আল্লাহ আমৃত্যু আমাদেরকে তাঁর দ্বীনের পথে কবুল করুন। আমিন!!!
-ড. মুহাম্মাদ আব্দুল মান্নান
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দারসুল কুরআন-৮ (সূরা আলে ইমরান:১৮-১৭)
اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ .
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْم .
১। আয়াত
(১৪) زُيٍِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِيْنَ وَالْقَنَاطِيْرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ط ذلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا صلى وَاللهُ عِنْدَه حُسْنُ الْمَآبِ০
(১৫) قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِّنْ ذلِكُمْ ج لِلَّذِيْنَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِىْ مِنْ تَحْتِهَا الأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا وَأَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ وَّرِضْوَانٌ مِّنَ اللهِ قف وَاللهُ بَصِيْرٌ م بِالْعِبَادِ০
(১৬) الَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ০
(১৭) أَلصَّابِرِيْنَ وَالصَّادِقِيْنَ وَالْقَانِتِيْنَ وَالْمُنْفِقِيْنَ وَالْمُسْتَغْفِرِيْنَ بِالأَسْحَارِ০
২। ভাবানুবাদ
১৪. মানুষের জন্য আকর্ষণীয় জিনিস, যেমন, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, সোনা-রূপার
স্তূপ, চিহ্নিত ঘোড়া (অর্থাৎ সেরা ঘোড়া), গৃহ পালিত পশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি ভালোবাসাকে সুশোভিত করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই গুলো দুনিয়ার জীবনের সামগ্রী মাত্র। আর আল্লাহর নিকটই রয়েছে উত্তম আবাস।
১৫. বল, ‘আমি কি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবো এই গুলোর চেয়েও উত্তম জিনিসের কথা ? যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট জান্নাত, যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান, যেখানে তারা থাকবে চিরদিন, পাবে পবিত্রা স্ত্রী, আর আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সব কিছু দেখে থাকেন।’
১৬. যারা বলে, ‘হে আমাদের রব, অবশ্যই আমরা ঈমান এনেছি, আপনি আমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচান।’
১৭. আর এরা ছবর অবলম্বনকারী, সত্যনিষ্ঠ, আনুগত্যপরায়ণ, ইনফাককারী এবং রাতের শেষ ভাগে ক্ষমা প্রার্থনাকারী।’
৩। পরিপ্রেক্ষিত
হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর প্রান্তরে ঈমানের বলে বলীয়ান তিন শত তেরো জন মুসলিমের এক হাজার মুশরিক যোদ্ধার ওপর বিজয় লাভ গোটা আরব উপদ্বীপে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সকলে অনুভব করে, আলমাদীনা আলমুনাওয়ারা-তে এক ব্যতিক্রমধর্মী শক্তি সুসংহত হয়েছে। এই শক্তির উত্থানের মাঝে তারা নিজেদের পতনের আলামত দেখতে পায়।
মাক্কা থেকে হিজরাত করে এসে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করা কালে অন্যদের মতো আলমাদীনার উপকণ্ঠে বসবাস রত ইয়াহুদী গোত্রগুলোর সাথেও চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্তানুযায়ী বহিরাক্রমণ কালে আলমাদীনার নিরাপত্তার জন্য তাদেরও ভূমিকা পালন করার কথা। কিন্তু বদর যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় লাভের পর ইয়াহুদীরা গোপনে মাক্কা ও অন্যান্য অঞ্চলের মুশরিক শক্তির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে আলমাদীনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদেরকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করে। অথচ এরা দাবি করতো, এরা আত্তাওরাতের অনুসারী এবং একত্ববাদী। একত্ববাদী হয়ে মুশরিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার তো কোন সুযোগ ছিলো না।
ইয়াহুদী গোত্রগুলোর অন্যতম ছিলো বানু কাইনুকা। এই গোত্রটি ইসলাম ও মুসলিমদের দুশমনিতে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলো। সেই জন্যই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এই গোত্রটির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আলমাদীনা থেকে বের করে দেন। এতে অন্য ইয়াহুদী গোত্রগুলো আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
বদর প্রান্তরে পরাজিত হয়ে মাক্কার মুশরিকরা প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছিলো। ইয়াহুদী গোত্রগুলো এতে পেট্রোল ঢেলে দেয়। ফলে হিজরী তৃতীয় সনে তিন হাজার মুশরিক যোদ্ধা আলমাদীনা আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসে।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক হাজার যোদ্ধা নিয়ে উহুদের দিকে অগ্রসর হন। পথিমধ্য থেকে মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই তিন শত সংগী নিয়ে পেছনে ফিরে যায়।
উহুদ প্রান্তরে তিন হাজার মুশরিক যোদ্ধার মুখোমুখি হন সাত শত জন মুসলিম। আল্লাহর মেহেরবানীতে এবারও মুসলিমরাই বিজয়ী হন। কিন্তু একটি কৌশলগত পাহাড়ী পথ পাহারায় নিয়োজিত বেশির ভাগ তীরন্দাজ তাঁদের অবস্থান স্থল ত্যাগ করায় যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ভীষণভাবে আহত হন। বহু মুজাহিদ আহত হন। শহীদ হন সত্তর জন।
এই বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে নাযিল হয় তিনটি ভাষণ। হিজরী নবম সনে নাযিলকৃত একটি ভাষণকেও প্রাসংগিকতার কারণে এই ভাষণগুলোর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়।
এই চারটি ভাষণের সমষ্টির নাম সূরা আলে ইমরান।
প্রথম ভাষণটি এই সূরার প্রথম আয়াত থেকে বত্রিশ নাম্বার আয়াত পর্যন্ত বিস্তৃত। বদর যুদ্ধের অব্যবহিত পরে এই ভাষণটি নাযিল হয়েছে বলে প্রখ্যাত তাফসীরকারদের মত।
দ্বিতীয় ভাষণটি তেত্রিশ নাম্বার আয়াত থেকে একাত্তর নাম্বার আয়াত পর্যন্ত বিস্তৃত। হিজরী নবম সনে দক্ষিণ আরবের নাজরান অঞ্চল থেকে একটি খৃস্টান প্রতিনিধি দলের আগমন উপলক্ষে এই ভাষণটি নাযিল হয়।
তৃতীয় ভাষণটি বাহাত্তর নাম্বার আয়াত থেকে একশত বিশ নাম্বার আয়াত পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বদর ও উহুদ যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে নাযিল হয়।
চতুর্থ ভাষণটি একশত একুশ নাম্বার আয়াত থেকে দুই শত নাম্বার আয়াত (অর্থাৎ শেষ আয়াত) পর্যন্ত বিস্তৃত। এই ভাষণটি উহুদ যুদ্ধের পর নাযিল হয়।
এই সূরায় মূলত দুইটি দলকে সম্বোধন করা হয়েছে। একটি দলে রয়েছে ইয়াহুদী ও খৃস্টানগণ।
অপর দলটিতে রয়েছেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি ঈমান আনয়নকারী মুসলিমগণ।
প্রথম দলটিকে বলা হয়েছে, অতীতে নবীগণ যেই দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেই দীনেরই ধারক বাহক। অতএব তাদের কর্তব্য হচ্ছে বাঁকাপথে না চলে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কর্তৃক উপস্থাপিত সত্য-সঠিক পথের অনুসারী হওয়া।
দ্বিতীয় দলটিকে অর্থাৎ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অনুসারীদেরকে বলা হয়েছে যে তাঁদেরকে পৃথিবীর সর্বোত্তম জাতির মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে এবং গোটা পৃথিবীর সমাজ ও সভ্যতার ইছলাহ সাধনের দায়িত্ব তাঁদের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আর যেই সব নৈতিক চারিত্রিক দুর্বলতার কারণে অতীতে বহু জাতি অধপতনের শিকার হয়েছে তাঁদেরকে সেই সব দুর্বলতা থেকে বেঁচে থাকার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।
আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে- সূরা আলে ইমরানের ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৭ নাম্বার আয়াত। এই আয়াতগুলো এই সূরার প্রথম ভাষণটির অংশবিশেষ।
৪। ব্যাখ্যা
১৪ নাম্বার আয়াত
زُيٍِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِيْنَ وَالْقَنَاطِيْرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا صلى وَاللهُ عِنْدَه حُسْنُ الْمَآبِ০
‘মানুষের জন্য আকর্ষণীয় জিনিস, যেমন, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, সোনা-রূপার স্তূপ, চিহ্নিত ঘোড়া (অর্থাৎ সেরা ঘোড়া), গৃহ পালিত পশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি ভালোবাসাকে সুশোভিত করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই গুলো দুনিয়ার জীবনের সামগ্রী মাত্র। আর আল্লাহর নিকটই রয়েছে উত্তম আবাস।’
এই আয়াতের প্রথমাংশে যেই সব জিনিস মানুষকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে সেই গুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর আয়াতের শেষাংশে ذلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا صلى وَاللهُ عِنْدَه حُسْنُ الْمَآبِ (এই গুলো দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সামগ্রী মাত্র। আর আল্লাহর নিকটই রয়েছে উত্তম আবাস।) বলে মানুষকে দুনিয়ার ওপর আখিরাতকে অগ্রাধিকার দেবার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সূরা আল ‘আনকাবূতের ৬৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَا هذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا اِلاَّ لَهْوٌ وَلَعِبٌ ج وَاِنَّ الدَّارَ الاخِرَةَ لَهِىَ الْحَيَوَانُ ج
‘আর দুনিয়ার জীবন তো খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। আসল জীবনের ঘর তো হলো আখিরাতের ঘর।’
সূরা আলে ইমরানের ১৮৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا اِلاَّ مَتَاعُ الْغُرُوْرِ০
‘আর দুনিয়ার জীবন তো ছলনার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।’
সূরা আল মুনাফিকুনের ৯ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
يآ اَيُّهَا الَّذِيْنَ امنُوْآ لاَتُلْهِكُمْ اَمْوَالَكُمْ وَلاَ اَوْلاَدَكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِج وَمَنْ يَّفْعَلْ ذلِكَ فَأُولِئِكَ هُمُ الْخَاسِرُوْنَ০
‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের অর্থ-সম্পদ এবং তোমাদের
সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে না রাখে। যারা এমনটি করবে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’
সূরা আত্তাওবাহ্র ২৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
قُلْ اِنْ كَانَ ابَاؤُكُمْ وَاَبْنَاؤُكُمْ وَاِخْوَانُكُمْ وَاَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيْرَتُكُمْ وَاَمَوْالُ نِ اقْتَرَفْتُمُوْهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا اَحَبَّ اِلَيْكُمْ مِنَ اللهِ وَرَسُوْلِه وَجِهَادٍ فِىْ سَبِيْلِه فَتَرَبَّصُوْا حَتّى يَأْتِىَ اللهُ بِاَمْرِه ط وَاللهُ لاَ يَهْدِى الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ০
‘তাদেরকে বল, তোমাদের আববা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত অর্থ-সম্পদ, তোমাদের ঐ ব্যবসা যার মন্দার আশংকা তোমরা কর, তোমাদের পছন্দের ঘর-বাড়ি যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদের চেয়ে বেশি প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আর আল্লাহ ফাসিকদেরকে সঠিক পথের দিশা দেন না।’
সূরা সাবা’র ৩৭ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَ مَا اَمْوَالُكُمْ وَلاَ اَوْلاَدُكُمْ بِالَّتِىْ تُقَرِّبُكُمْ عِنْدَنَا زُلْفى اِلاَّ مَنْ امَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَأُولئِكَ لَهُمْ جَزَاءُ الضِّعْفِ بِمَا عَمِلُوْا وَهُمْ فِى الْغُرُفَاتِ امِنُوْنَ০
‘তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এমন নয় যে এই গুলো তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে, তবে যারা ঈমান আনে এবং আমালুছ ছালিহ করে তারা এমন লোক যাদের জন্য রয়েছে তাদের কর্মের দ্বিগুণ প্রতিদান এবং তারা সুউচ্চ প্রাসাদে নিরাপদে অবস্থান করবে।’
সূরা আলআ‘লা-র ১৬ ও ১৭ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا০ وَالاخِرَةُ خَيْرٌ وَابْقى০
‘বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছো। অথচ উত্তম ও স্থায়ী হচ্ছে আখিরাত।’
স্ত্রী, পুত্র, কন্যা এবং আত্মীয়-স্বজনের প্রতি মানুষের অন্তরে থাকে গভীর অনুরাগ। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য সম্পদের প্রতি মানুষ দারুণ আকর্ষণ অনুভব করে থাকে। একটি সীমা পর্যন্ত এই অনুরাগ ও আকর্ষণ আপত্তিকর নয়। কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে গেলেই ঘটে বিপত্তি। তখন মানুষ দুনিয়া-প্রীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আর দুনিয়া-প্রীতি মানুষকে আখিরাতমুখী হতে দেয় না। সেই জন্যই আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মানুষকে দুনিয়ার জীবনের প্রকৃত অবস্থা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যাতে মানুষ দুনিয়ার জীবনের গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে প্রতারণার শিকারে পরিণত না হয়।
১৫ নাম্বার আয়াত
قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِّنْ ذلِكُمْ ط لِلَّذِيْنَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِىْ مِنْ تَحْتِهَا الأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا وَأَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ وَّرِضْوَانٌ مِّنَ اللهِ ط وَاللهُ بَصِيْرٌ بِالْعِبَادِ০
‘বল, ‘আমি কি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবো এই গুলোর চেয়ে উত্তম জিনিসের কথা ? যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান, যেখানে তারা থাকবে চিরদিন, পাবে পবিত্রা স্ত্রী, আর আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সব কিছু দেখে থাকেন।’
এই আয়াতের প্রথমাংশে বলা হয়েছে দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ ও সামগ্রীর চেয়ে অনেক বেশি উত্তম সম্পদ রয়েছে আখিরাতে। আর আয়াতের দ্বিতীয়াংশে বলা হয়েছে যে সেই উত্তম সম্পদ হচ্ছে জান্নাত, যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান এবং যা তাকওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তিদের জন্য প্রস্ত্তত করা হয়েছে।
যাঁরা জান্নাতে প্রেরিত হবেন তাঁরা অনন্ত কালের জন্য সেখানে স্থায়িত্ব লাভ করবেন।
সেখানে তাঁরা পবিত্রা স্ত্রী পাবেন। সর্বোপরি তাঁরা আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের সন্তোষ লাভ করে ধন্য হবেন।
এই আয়াতের শেষাংশে
وَاللهُ بَصِيْرٌ م بِالْعِبَادِ০
(আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে দেখে থাকেন) কথাটি যুক্ত করে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন যেনো এই ইংগিত দিলেন যে তিনি অপাত্রে তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ দান করেন না। তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি প্রখর দৃষ্টি রাখেন। তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাঁরা তাঁকে ভয় করে তাঁদের চিন্তা-চেতনা, ইচ্ছা-সংকল্প এবং কর্মকান্ডকে পরিশীলিত করে নেন, তিনি তাঁদেরকেই পুরস্কৃত করে থাকেন।
১৬ নাম্বার আয়াত
الَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ০
‘যারা বলে, হে আমাদের রব, অবশ্যই আমরা ঈমান এনেছি, আপনি আমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচান।’
এই আয়াতে যাঁরা আল্লাহকে ভয় করে চলে তাঁদের একটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই লোকগুলো আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের কাছে গুনাহ মাফের জন্য এবং তাঁদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাবার জন্য বিনীতভাবে দু‘আ করতে থাকেন।
১৭ নম্বর আয়াত
الصَّابِرِيْنَ وَالصَّادِقِيْنَ وَالْقَانِتِيْنَ وَالْمُنْفِقِيْنَ وَالْمُسْتَغْفِرِيْنَ بِالأَسْحَارِ০
‘এরা ছবর অবলম্বনকারী, সত্যনিষ্ঠ, আনুগত্যপরায়ণ, ইনফাককারী এবং রাতের শেষ ভাগে ক্ষমা প্রার্থনাকারী।’
এই আয়াতে তাকওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তিদের আরো পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
তাকওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তিগণ ছবর অবলম্বনকারী হয়ে থাকেন।
ছবর অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন আলকুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এই গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য মুমিনদেরকে তাকিদ করেছেন।
সূরা আলবাকারা-র ১৫৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
يآَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوا اسْتَعِيْنُوْا بِالصَِّبْرِ وَالصَّلوةِ ط اِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِيْنَ০
‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, ছবর ও ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ ছবর অবলম্বনকারীদের সংগে আছেন।’
সূরা আলবাকারা-র ১৫৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوْعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الاَمْوَالِ وَالاَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ ط وَبَشَّرِ الصَّابِرِيْنَ ০
‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি ও ক্ষুধা-অনাহার দ্বারা এবং তোমাদের মাল, জান ও আয়-রোজগারের নোকসান ঘটিয়ে। এমতাবস্থায় যারা ছবর অবলম্বন করবে, তাদেরকে সুসংবাদ দাও।’
সূরা আয্-যুমার-এর ১০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرِيْنَ اَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍِ ০
‘ছবর অবলম্বনকারীদেরকে পূর্ণভাবে অগণিত পুরস্কার দেওয়া হবে।’
সূরা আলবাকারা-র ১৭৭ নাম্বার আয়াতের অংশবিশেষে মুত্তাকী ব্যক্তিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَالصَّابِرِيْنَ فِى الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِيْنَ الْبَاْسَ ط
‘আর এরা অভাব-অনটন, বিপদ-মুসীবাত এবং হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ছবর অবলম্বনকারী।’
তাকওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তিগণ সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাকেন।
সত্যনিষ্ঠার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
اَلصِّدْقُ طُمَانِيَةٌ وَالْكَذِبَ رِيْبَةٌ০
[আবু মুহাম্মাদ হাসান ইবনু আলী (রা), জামে আত-তিরমিযী]
‘সত্যনিষ্ঠা অবশ্যই প্রশান্তি-নিশ্চিন্ততা সৃষ্টি করে। আর মিথ্যা সন্দেহ-সংশয়-অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
اِنَّ الصَّدْقَ يَهْدِىْ اِلَى الْبِرِّ وَاِنَّ الْبِرَّ يَهْدِىْ اِلَى الْجَنَّةِ০
[আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রা), ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আলবুখারী]
‘নিশ্চয়ই সত্য পুণ্যের পথ দেখায়। আর পুণ্য জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়।’
সূরা আত্ তাওবাহ-র ১১৯ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুমিনদেরকে সত্যনিষ্ঠা অবলম্বনের তাকিদ দিয়ে বলেন,
ياَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا التَّقُوا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ০
‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহকে ভয় করে চল এবং সত্যনিষ্ঠদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও।’
সূরা আলহাজের ৩০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَاجْتَنِبُوْا قَوْلَ الزُّوْرِ০
‘তোমরা মিথ্যা কথা পরিহার কর।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কবীরা গুনাহগুলোর মধ্য থেকে মারাত্মক কবীরা গুনাহগুলো চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেছেন,
اَلاَ اُنَبِّئُِكُمْ بِاَِكْبَرِ الْكَبَائِرَ قُلْنَا بَلى يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ اَلاِشْرَاكُ بِاللهِ وَعُقُوْقُ الْوَالِدَيْنِ وَكَانَ مُتَّكِِِئًا فَجَلَسَ فَقَالَ اَلاَ وَقَوْلُ الزُّوْرِ০
[আবু বাকরা (রা), ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আলবুখারী]
‘সাবধান, আমি কি তোমাদেরকে কবীরা গুনাহগুলোর মধ্য থেকে মারাত্মক কবীরা গুনাহগুলো সম্পর্কে অবহিত করবো?’ আমরা বললাম, ‘হাঁ, হে আল্লাহর রাসূল।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সাথে শিরককরণ, আববা-আম্মার অবাধ্যতা’’ (অতপর হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসে) তিনি বলতে থাকলেন, ‘সাবধান, এবং মিথ্যা কথন।’
সূরা আলফুরকানের ৭২ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাঁর বিশিষ্ট বান্দাদের যেই সব বৈশিষ্ট উল্লেখ করেছেন তার একটি হচ্ছে-
وَالَّذِيْنَ لاَ يَشْهَدُوْنَ الزُّوْرَ০
‘এরা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না।’
সূরা আলআহযাবের ৩৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন যাঁরা তাঁর ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কার লাভ করে ধন্য হবেন তাঁদের অন্যতম বৈশিষ্ট উল্লেখ করে বলেন,
وَالصَّادِقِيْنَ وَالصَّادِقَاتِ০
‘এরা সত্যবাদী-সত্যনিষ্ঠ পুরুষ এবং সত্যবাদী-সত্যনিষ্ঠ নারী।’
তাকওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তিগণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্যশীল হয়ে থাকেন।
সূরা আন্ নূরের ৫১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِيْنَ اِذَا دُعُوْا اِلَى اللهِ وَرَسُوْلِه لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ اَنْ يَّقُوْلُوْا سَمِعْنَا وَاَطَعْنَا ط وَاُولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ০
‘মুমিনদের কোন কিছু ফায়সালা করার ব্যাপারে যখন তাদেরকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহবান জানানো হয় তখন তারা এই কথাই বলে, ‘আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম’ আর এই সব লোকই সফলকাম।’
সূরা আলে ইমরানের ৩১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِىْ يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْط وَاللهُ غَفُوْرُ رَّحِيْمٌ০
‘তাদেরকে বলে দাও, তোমরা যদি আল্লাহর প্রতি সত্যি ভালোবাসা পোষণ কর, তাহলে আমার অনুসরণ কর। এতে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন। এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়াবান।’
সূরা আল আহযাবের ২১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِىْ رَسُوْلِ اللهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُوا اللهَ وَالْيَوْمِ الاخِرَ.
‘প্রকৃতপক্ষে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি আশাবাদী তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’
সূরা আল আহযাবের ৩৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাঁর ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কার পেয়ে যাঁরা ধন্য হবেন তাঁদের একটি বৈশিষ্ট বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
وَالْقَانِتِيْنَ وَالْقَانِتَاتِ.
‘এরা (আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের) প্রতি আনুগত্যশীল পুরুষ ও আনুগত্যশীল নারী।’
তাকওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তিগণ আল্লাহর পথে অকাতরে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে থাকেন।
আলকুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন মুমিনদেরকে ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহর তাকিদ করেছেন।
সূরা আল হাদীদের ১১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
مَنْ ذَا الَّذِىْ يُقْرِضُ اللهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضعِفَه لَه وَلَه اَجْرٌ كَرِيْمٌ০
‘কে আছে আল্লাহকে করযে হাসানা দেবে যা তিনি বহু গুণ বাড়িয়ে তাকে ফেরত দেবেন? আর তার জন্য রয়েছে সর্বোত্তম প্রতিদান।’
সূরা আলবাকারা-র ২৫৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
ياَيُّهَا الَّذٍيْنَ امَنُوْا اَنْفِقُوْا مِمَّا رَزَقْنكُمْ مِنْ قَبْلِ اَنْ يَاْتِىَ يَوْمٌ لاَ بَيْعٌ فِيْهِ وَلاَ خُلَّةٌ وَلاَ شَفَاعَةٌ০
‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আমি তোমাদেরকে যেই রিযক দিয়েছি তা থেকে ইনফাক কর সেই দিনটি আসার পূর্বে যেই দিন কোন বেচাকেনা, কোন বন্ধুত্ব ও কোন সুপারিশ চলবে না।’
সূরা আলে ইমরানের ৯২ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّى تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ.
‘তোমরা প্রকৃত পুণ্য লাভ করতে পারবে না যেই পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্ত্তগুলো আল্লাহর পথে ব্যয় না করবে।’
এই সব আয়াতের দাবি পূরণের জন্য খাঁটি মুমিনগণ অতুজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করে থাকেন।
সূরা আল আহযাবের ৩৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাঁদেরকে,
اَلْمُصَدِّقِيْنَ وَالْمُصَدِّقَاتِ.
(ইনফাককারী পুরুষ ও ইনফাককারী মহিলা) বলে উল্লেখ করেছেন।
অর্থাৎ তাঁরা আল্লাহর পথে অকাতরে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেন। সমাজের অভাবী ব্যক্তিদের প্রতি তাঁদের সহযোগিতার হাত প্রসারিত হয়। আর আল্লাহর দীনের আওয়াজ বুলন্দ করার কাজে তাঁরা উদারভাবে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে থাকেন।
সূরা আলে ইমরানের ১৩৪ নাম্বার আয়াতে এই ধরনের ব্যক্তিদের পরিচয় তুলে ধরে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اَلَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ فِى السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكظِمِيْنَ الْغَيْظَ وَالْعَافِيْنَ عَنِ النَّاسِ ط
‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় (আল্লাহর পথে) অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে, যারা ক্রোধ দমন করে এবং যারা লোকদের দোষ-ত্রুটি মাফ করে দেয়।’
তাকওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তিগণ শেষ রাতে আল্লাহর নিকট প্রার্থনাকারী হয়ে থাকেন।
সূরা আন্ নিসা-র ১০৬ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَاسْتَغْفِرِ اللهَ ط اِنَّ اللهَ كَانَ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا০
‘আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াবান।’
সূরা আন্ নাছর-এর ৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ ط اِنَّه كَانَ تَوَّابًا০
‘তোমার প্রভুর প্রশংসা সহকারে তাঁর তাসবীহ কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি বেশি বেশি তাওবা কবুলকারী।’
সূরা আলআনফাল-এর ৩৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَاَنْتَ فِيْهِمْ وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ০
‘আল্লাহ এমন নন যে তুমি তাদের মাঝে থাকা অবস্থায় তিনি তাদের ওপর আযাব নাযিল করবেন। আর আল্লাহ এমন নন যে লোকেরা ক্ষমা চাইতে থাকবে, আর তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন।’
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
اَيُّهَا النَّاسُ اَفْشُوا السَّلاَمَ وَاَطْعِمُوا الطَّعَامَ وَصَلُّوْا بِالَّيْلِ وَالنَّاسُِ نِيَامٌ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ بِسَلاَمٍ.
[আবদুল্লাহ ইবনু সালাম (রা), জামে আত্তিরমিযী]
‘ওহে লোকেরা, সালামের প্রসার ঘটাও, (অভাবীদেরকে) আহার করাও, রাতে যখন লোকেরা ঘুমায় সেই সময় ছালাত আদায় কর। তাহলে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।’
সূরা আস্সাজদাহ-র ১৬ নাম্বার আয়াতে খাঁটি মুমিনদের বৈশিষ্ট বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
تَتَجَافى جُنُوْبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا ز وَّمِمَّا رَزَقْنهُمْ يُنْفِقُوْنَ০
‘তাঁদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা হয়ে থাকে এবং ভয় ও আশা নিয়ে তারা তাদের রবের নিকট দু‘আ করতে থাকে। আর আমি তাদেরকে যেই রিযক দিয়েছি তা থেকে তারা ইনফাক করে।’
সূরা আয্যারিয়াতের ১৫ থেকে ১৯ নাম্বার আয়াতে মুত্তাকী মুহসিন ব্যক্তিদের কিছু বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِىْ جَنّتٍ وَّعُيُوْنٍ০ اخِذِيْنَ مَآ اتهُمْ رَبُّهُمْ ط اِنَّهُمْ كَانُوْا قَبْلَ ذلِكَ مُحْسِنِيْنَ০ كَانُوْا قَلِيْلاً مِّنَ الَّيْلِ مَا يَهْجَعُوْنَ০ وَبِالاَسْحَارِهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ০ وَفِىْ اَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُوْمِ০
‘মুত্তাকী ব্যক্তিরা সেইদিন বাগান ও ঝর্ণাসমূহের মধ্যে থাকবে। তাদের রব তাদেরকে যা দেবেন তা তারা খুশি হয়ে নিতে থাকবে। তারা সেই দিনটি আসার আগে (অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনে) মুহসিন হিসেবে জীবন যাপন করেছে। রাতে তারা কমই ঘুমাতো। শেষ রাতে তারা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতো। আর তাদের অর্থ-সম্পদে সাহায্যপ্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক স্বীকৃত ছিলো।’
৫। শিক্ষা
যেই সব তাকওয়াবান ব্যক্তি (১) সব সময় আল্লাহর কাছে মাগফিরাত চাইতে থাকেন, (২) প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে ছবর অবলম্বন করেন, (৩) সর্বদা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকেন, (৪) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে অটল থাকেন, (৫) আল্লাহর পথে অকাতরে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতে থাকেন এবং (৬) বিশেষ করে শেষ রাতে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন, আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন তাঁদের জন্য অতুলনীয় অফুরন্ত নিয়ামতে ভরপুর জান্নাত প্রস্ত্তত করে রেখেছেন।
সূরা আদ্ দাহর (বা সূরা আল ইনসান)-এর ২০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
وَإِذَا رَأَيْتَ ثَمَّ رَأَيْتَ نَعِيْمًا وَمُلْكًا كَبِيْرًا.
‘‘এবং তুমি যেই দিকেই তাকাবে দেখবে সুখ-স্বাচ্ছন্দ-আনন্দ উপকরণের সমারোহ এবং বিশাল সাম্রাজ্য।’’
একটি হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বলেন,
اَعْدَدْتُ لِعِبَادِىَ الصَّالِحِيْنَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ وَلاَ اُذُنٌ سَمِعَتْ وَ لاَ خَطَرَ عَلى قَلْبِ بَشَِرٍ.
[আবু হুরাইরা (রা), ছাহীহ মুসলিম, ছাহীহ আলবুখারী]
‘আমি আমার ছালিহ বান্দাদের জন্য এমন সব নিয়ামত মওজুদ করে রেখেছি যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, যার কথা কোন কান কখনো শুনেনি এবং যার ধারণা কোন হৃদয়ে কখনো উদিত হয়নি।’
জান্নাতের সামগ্রীর তুলনায় দুনিয়ার সামগ্রী অতি তুচ্ছ, অতি নগণ্য।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
لَوْ كَانَتِ الدُّنْيَا تَعْدِلُ عِنْدَ اللهِ جَنَاحَ بَعُوْضَةٍ مَا سَقى كَافِرًا مِنْهَا شِرْبَةَ مَاءٍ.
[সাহল ইবনু সা’দ (রা), জামে আততিরমিযী]
‘আল্লাহর নিকট দুনিয়ার মূল্য যদি একটি মশার ডানার মূল্যের সমান হতো, তাহলে তিনি কোন কাফিরকে এত্থেকে এক চুমুক পানিও পান করতে দিতেন না।’
অতএব এই নগণ্য দুনিয়াকে নয়, আখিরাতের অনন্ত জীবনে মহামূল্যবান জান্নাত প্রাপ্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমাদের চিন্তা-চেতনা, কামনা-বাসনা এবং যাবতীয় কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রিত হওয়া প্রয়োজন।