জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও চলমান নৈরাজ্য প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
সবুজ শ্যামলে ঘেরা অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অধিকারী আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামল, নদীমাতৃক এই দেশটি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখো শহীদের রক্ত ও গণমানুষের বিরাট আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। যেসব বীর সেনানী জীবন দিয়ে আমাদেরকে এই স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, তাদেরকে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ ও রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।
গণতন্ত্র, সাম্য, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদাসহ মৌলিক অধিকারের দাবি সামনে রেখে যে দেশটি স্বাধীন হয়েছিল সেই দেশের গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার আজ হুমকির মুখে। কারও জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। ভিন্ন মত ও পথের মানুষকে সন্ত্রাসী কায়দায় যখন তখন তুলে নিয়ে হত্যা ও গুপ্ত হত্যা করা হচ্ছে। অনেকের লাশও পাওয়া যাচ্ছে না। নারী ও শিশুদেরকেও গ্রেফতার করা হচ্ছে। মেধাবী যুবকদেরকে ধরে তাদের গ্রেফতারের কথা অস্বীকার করা হচ্ছে। তাদের গুলি করা হচ্ছে, বন্দুক যুদ্ধের নাটক সাজিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হচ্ছে অথবা চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। পিতার সামনে সন্তানকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার কথিত গোপন বৈঠকের অভিযোগে বাড়ি থেকে পিতা-পুত্রসহ সবাইকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারাগারগুলো আজ বিরোধী দলের নেতা-কর্মী দিয়ে ভর্তি হয়ে গেছে। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি কারাগারে ধারণ ক্ষমতার তিনগুণ মানুষকে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। জেলাখানাগুলোতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিরোধী মতের কেউ উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও তাকে কারাগারের ফটক থেকে রি-এরেস্ট করা হচ্ছে। রিমান্ডে নিয়ে করা হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন। আইন আদালতের কোন তোয়াক্কা সরকার করছেনা। সরকারের দায়িত্ব ছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা কিন্তু সরকার নিজেই এখন চরমভাবে বেআইনি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এক কথায় গোটা দেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দাবি করেছেন, একটি দেশে যখন গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিদ্যমান থাকে না, তখন সেখানে উগ্রবাদের উত্থান হয়।
মূলতঃ ক্ষমতা কেন্দ্রিক অসুস্থ ও নেতিবাচক রাজনীতি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন আর নির্লজ্জ দলীয়করণ, আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, হীন দলীয়স্বার্থ চরিতার্থের মানসিকতা, সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের অভাব, আমাদের কাক্সিক্ষত উন্নতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে ৩০ বছরেই উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে গেছে, সেখানে আমরা এখনও বিভাজনের অপরাজনীতির শিকার হয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছি। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা এখনও বিকশিত হয়নি। তবে বাংলাদেশের চলমান ভোগবাদী রাজনীতির বাইরে একমাত্র ব্যতিক্রম, এদেশের গণমানুষের প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নিছক কোন রাজনৈতিক দল নয় বরং গণমানুষের কল্যাণকামী একটি আদর্শবাদী দল। ১৯৭৯ সালের ২৭ মে থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী তার গৌরবোজ্জ্বল অভিযাত্রা শুরু করে। জামায়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে একটি জনকল্যাণমূলক আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। জামায়াত সব সময় শান্তিপূর্ণ ও অহিংস পদ্ধতিতে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে চায়। জামায়াতের কর্মসূচি শুধুই রাজনৈতিক পরিসরে সীমাবদ্ধ নয় বরং জামায়াত শিক্ষা সম্প্রসারণ এবং আর্ত-মানবতার সেবায়ও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইসলাম ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে প্রচলিত রাজনীতির বিপরীতে জামায়াত দুর্নীতিমুক্ত, আইনসম্মত, সুশৃঙ্খল, ভারসাম্যপূর্ণ, গতিশীল, বাস্তবধর্মী, দায়িত্বশীল একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তিলে-তিলে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। দেশ ও জাতির যেকোন ক্রান্তিকালে জামায়াতে ইসলামী সব সময় দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে আসছে।
ইসলামের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকার ব্যাপারে উদাসীন সরকার এবং অনুরূপ রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জামায়াত সবসময়ই বিমাতাসুলভ আচরণ পেয়ে আসছে। ফলে জামায়াতে ইসলামী হামলা, মামলা ও নিরবচ্ছিন্ন অপবাদ ও অপপ্রচারের শিকার হয়েছে। এতো সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জামায়াতে ইসলামী সমাজ থেকে সব রকম অন্যায়, জুলুম, অবিচার ও দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সর্বস্তরের গণমানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই তা করা সম্ভব মনে করে বিধায় জামায়াত নির্বাচনকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে জামায়াত, ইসলামের সৌন্দর্য ও কল্যাণময় আদর্শ দেশের গণমানুষের সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি ও নৈতিক মানসম্পন্ন সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরির অব্যাহত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
আর এই মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য জামায়াতের একদল সুশৃঙ্খল জনশক্তি, শান্তিপূর্ণ কর্মনীতি এবং স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক দলীয় কাঠামো রয়েছে। একথা নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য যে, বাংলাদেশের যেকোনো রাজনৈতিক দলের তুলনায় জামায়াতের আয় ও ব্যয়ের প্রক্রিয়া অনেক বেশি স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। জামায়াতের আয়ের মূল উৎস এর জনশক্তি। জামায়াতের সদস্য (রুকন), কর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীগণ নিয়মিত সহযোগিতা প্রদান করেন। এর পাশাপাশি জাকাত থেকেও জামায়াতের অর্থ তহবিলে জমা হয় যা শরীয়ত অনুযায়ী জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হয়।
জামায়াত সকল ধর্ম ও মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল
জামায়াতে ইসলামী আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে বিধায় অন্য যে কোন ধর্মের লোকদের ধর্মবিশ্বাস সংরক্ষণের ব্যাপারে জামায়াত খুবই সতর্ক। সকল ধর্ম ও নৃতাত্বিক জাতিগোষ্ঠী যাতে নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার পায় তা নিশ্চিত করতে জামায়াত কাজ করে যাচ্ছে। হাজার বছর ধরে সকল ধর্মের ও মতের মানুষ যেভাবে শান্তিপূর্ণভাবে বাংলাদেশে সহাবস্থান করে আসছে জামায়াত দলীয়ভাবে সেই ধারাকে সম্মান করে। আজ পর্যন্ত জামায়াতের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোন অভিযোগ কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। বরং সম্প্রতি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদও বর্তমান সরকারের বেশ কিছু এমপি ও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে হিন্দুদের জমি দখলের অভিযোগ এনেছে। যখনই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, জামায়াত তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে এবং সরকারের যেকোনো নিরপেক্ষ তদন্তে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। এমনকি সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে জাতিসংঘের অধীনে আন্তর্জাতিক তদন্তেরও দাবি জানিয়েছে। তারপরও কোন কোন মহল সংখ্যালঘু নির্যাতনের সাথে জামায়াত জড়িত- তা প্রমাণ করার জন্য মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়েছে যা কখনোই জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি।
বহির্বিশ্বের সাথে জামায়াতের সম্পর্ক
একটি সচেতন কল্যাণধর্মী দল হিসেবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতেও জামায়াত সব সময়ই সোচ্চার। চলমান বিভিন্ন বিষয়ে কেবলমাত্র অবহিত থাকাই নয়, বরং যখনই বিশ্বের যেখানে অসহায় মানুষ নির্যাতনের মুখে পড়েছে, জামায়াত সব সময়ই তার পক্ষে নৈতিক অবস্থান নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। জামায়াত কোন স্থায়ী শত্রুতায় বিশ্বাস করেনা। “সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়” এই নীতিতেই জামায়াত আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে সবার ওপর স্থান দিয়ে বিদেশনীতি ও কার্যক্রমে প্রতিবেশী দেশসমূহসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে ঘনিষ্ঠ স¤পর্ক স্থাপনে জামায়াত গুরুত্ব প্রদান করে। যারা জামায়াতকে বিশেষ কোন দেশের শত্রু বা মিত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়, তাদের নেতিবাচক উদ্দেশ্য ইতোমধ্যেই জনগণের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। কেননা জামায়াতের বিগত বছরগুলোর কার্যক্রমে এটা সকলেই অনুধাবন করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জামায়াতের ইতিবাচক ভূমিকা অত্যন্ত বলিষ্ঠ।
উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসের বিষয়ে জামায়াতের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভূমিকা
উগ্রগোষ্ঠী ইসলামের নামে যেভাবে নিরীহ মানুষ হত্যা করছে, ইসলামের শিক্ষা ও মূলনীতি এসব ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে থাকে। সমাজে বিশৃঙ্খলা ও ফিতনা সৃষ্টিকারী এসব কর্মকাণ্ডকে আল-কুরআনে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ বা হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও মূলনীতির আলোকে তার কর্মনীতি নির্ধারণ করেছে। জামায়াতে ইসলামীর কর্মনীতির দ্বিতীয় ধারায় সুম্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- “উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিলের জন্য জামায়াত এমন কোন উপায় ও পন্থা অবলম্বন করিবে না যাহা সততা ও বিশ্বাসপরায়ণতার পরিপন্থী কিংবা যাহার ফলে দুনিয়ায় ফিতনা ও ফাসাদ (বিপর্যয়) সৃষ্টি হয়।” জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ অবধি এই কর্মনীতির ওপর অটল-অবিচল থেকে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
সুতরাং জামায়াতের দাওয়াত, কর্মসূচি, কর্মনীতি, আয়ের উৎস- এই সব মিলিয়ে জামায়াতে ইসলামী কিংবা তার কোন সদস্যের পক্ষে উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ কিংবা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। জামায়াতের দীর্ঘ পথ চলায় জামায়াত কিংবা এর কোন সদস্য দল কর্তৃক প্রণীত নীতি ও আদর্শের বাইরে গিয়ে কোন বক্তব্য, উগ্র আচরণ ও ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কোন নজীরও নেই। জামায়াত মনে প্রাণে উগ্র চিন্তা-চেতনা ও এই সংক্রান্ত সব ধরনের কার্যক্রমকে তীব্রভাবে ঘৃণা ও নিন্দা করে।
শুধু তাই নয়, গত ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে জঙ্গি হামলার যে ঘটনা ঘটে তার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে জামায়াত নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করে এবং দুর্বৃত্তদের হাত থেকে জিম্মি দেশী-বিদেশী নাগরিকদের নিরাপদ ও অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করার আপ্রাণ চেষ্টা চালানোর আহ্বান জানায়। একই সাথে দুর্বৃত্তদেরকে যথাসম্ভব নিরস্ত্র করে জীবিত অবস্থায় আটক করা উচিত বলে মত প্রকাশ করে যাতে করে এর সাথে জড়িত ও তাদের পেছনের মদদদাতাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। জামায়াতের এই ধরনের বিবৃতি প্রমাণ করে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও নৈরাজ্যের ব্যাপারে জামায়াতের অবস্থান কতটা স্পষ্ট, এই ব্যপারে জামায়াত কতটা আপোষহীন।
জামায়াতের মতো নিষ্ঠাবান ইসলাম চর্চাকারী রাজনৈতিক দল আছে বলেই এতদিন উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। অথচ বর্তমানে একদিকে জামায়াতের নিয়মতান্ত্রিক, জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমকে পরিচালনা করার সুযোগ না দিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তা বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে, অন্যদিকে উল্টো জামায়াতকেই জঙ্গিবাদের সাথে সম্পৃক্ত করার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। আমরা মনে করি, সমস্যার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনে সময় না দিয়ে এবং প্রকৃত জঙ্গিদেরকে না ধরে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে সারাদেশে জঙ্গি ধরার নামে জামায়াত-শিবির ও অন্যান্য বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষকে হয়রানিমূলক গ্রেফতার অভিযান চালিয়ে কোনভাবেই জঙ্গি দমন করা সম্ভব নয়। অধিকন্তু সরকারের গৃহীত এ পদক্ষেপ উল্টো জঙ্গিবাদকে উস্কিয়ে দেওয়ারই শামিল।
কোন অকাট্য প্রমাণ ছাড়াই সরকার ও মহল বিশেষ জামায়াতের সাথে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক আবিষ্কার করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। মূলতঃ জামায়াতের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাকাতর হয়ে সরকার ও কতিপয় অপশক্তি এসব অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে সংগঠিত কোন জঙ্গিবাদী বা সন্ত্রাসবাদী ঘটনার সাথে সরকার জামায়াতের সম্পৃক্ততা কোনভাবেই প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্যই জামায়াতকে জঙ্গিবাদী আখ্যা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। মনে হয় জামায়াত নেতৃত্বের সততা ও যোগ্যতাই যেন তাদের বিদ্বেষের মূল কারণ। যদিও দেশপ্রেমিক জনগণ এ ধরনের অপপ্রচার ও অপবাদকে কোন গুরুত্বই দেয় না।
আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, জামায়াত যদি উগ্রবাদে বিশ্বাসী হতো, তার প্রভাব তার দলের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমেও পড়ত। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী একমাত্র দল যার অভ্যন্তরে কোন অসন্তোষ বা কোন্দল নেই। এটা থেকে পরিষ্কার হয় যে, এই দল জঙ্গিবাদী বা সন্ত্রাসী হতে পারেনা। বরঞ্চ জঙ্গিবাদীদের আদর্শ ও কার্যক্রমের সাথে বর্তমান ক্ষমতাসীন ও তাদের দোসরদের বক্তব্য, বিবৃতি, আচার-আচরণ ও কার্যক্রমের অনেকটাই সাদৃশ্য ও যোগসাজশ পাওয়া যায়। যার বহি:প্রকাশ বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিনিয়ত ঘটতে দেখা যায়। এ পর্যন্ত তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিজ দলের প্রায় পৌনে তিনশত নেতা-কর্মী খুন হয়েছে। যার আসামি-ফরিয়াদি সব নিজেরাই। কিন্তু বিচার কি হয়েছে? অতিসম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় সংগঠিত প্রাণঘাতি ঘটনাও যার একটি খণ্ড নমুনা।
জঙ্গিবাদের প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সময়ের দাবি
দেশের সকল পর্যায়ের সম্মানিত ওলামায়ে কেরাম এবং ইসলামী আদর্শভিত্তিক দলগুলোসহ অন্য সকল রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে জঙ্গিবাদকে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। বর্তমানে ইসলামের নাম ব্যবহার করে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে সব হামলা পরিচালনা করা হচ্ছে সেগুলোকে খুন খারাবি, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য বলে তারা পরিষ্কারভাবে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এই জন্য তারা তরুণদের মধ্যে ইসলামের মৌলিক জ্ঞানের অভাব, বিভিন্ন কারণে তাদের ভেতরে থাকা নৈরাশ্যকে দায়ী করেছেন। ন্যায় বিচার, সুশাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে এক ধরনের হতাশা থেকেই তরুণরা উগ্রবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে অনেকেই মতামত ব্যক্ত করেছেন। এতদিন পর্যন্ত জঙ্গিবাদের জন্য দায়ী করা হতো মাদরাসাকে, কিন্তু হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারীদের ৫ জনের মধ্যে মাত্র একজন মাদরাসা শিক্ষার্থী। এসব ছেলেরা এসেছে মধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি থেকে। পড়াশুনা করেছে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনকি এদের কেউ কেউ বিদেশেও পড়ালেখা করেছে। দুনিয়ার সব জায়গায় তরুণরা যা করে, তেমনি খুব উৎফুল্ল ছিল ওরাও, টি-শার্ট ও জিন্স পড়তো। নিয়মিতই আড্ডা দিত। তাহলে এই ছেলেদের ক্ষেত্রে ভুলটা হয়েছিল কোথায়?
অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, এইসব কেবল আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা নয় যেটি শক্তি প্রয়োগ করে সমাধান করা যাবে। এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তরুণদের হৃদয় ও মন জয় করে নেয়া। যার জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি প্রেরণাদায়ক নৈতিক মোটিভেশন দরকার। কিন্তু আমাদের সরকার চলছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত পথে। ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধহীন সমাজ সৃষ্টির প্রয়াসে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার পরিবর্তে তরুণ-তরুণীদের বিপথগামী করার উদ্দেশ্যে শিক্ষাক্রম থেকে ইসলামী মূল্যবোধ অপসারণ, পাঠ্যপুস্তকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ও চরিত্র গঠনের উপযোগী মননশীল কার্যক্রমের বিকাশের পরিবর্তে বরং যুব সম্প্রদায়কে নৈতিকভাবে দেউলিয়া করার জন্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথকে উন্মুক্ত করা হয়েছে।
স্বাধীনতার এত বছর পরে এসেও আমরা শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে পারিনি। সত্য গ্রহণ করার মানসিকতা এখনও সর্বক্ষেত্রে তৈরি হয়নি। বিগত ৪৫ বছরে বড় একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনও এই শ্রেণির প্রত্যাশিত পরিপক্কতা অর্জিত হয়নি। বরং মূল্যবোধহীন নি¤œমানের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন এক শিক্ষিত মধ্য শ্রেণি তৈরি হয়েছে যাদের কোন ন্যায়-নিষ্ঠা ও যুক্তি গ্রহণের মানসিকতা তৈরি হয়নি। ফলে এই সব অপরিপক্ক যুবকদেরকে সহজেই ভুল পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে।
বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে আগে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা ও কর্মতৎপরতা ছিল। যার ফলে ছাত্রসমাজের বিরাট একটি অংশ ছাত্রসংগঠনগুলোর কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে নিজেদেরকে কর্মব্যস্ত রাখার সুযোগ পেত। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাঙ্গন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের একক আধিপত্যের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ায় শিক্ষাঙ্গনের পড়াশুনা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এখন সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। নিজেদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলোতে ইতিবাচক ছাত্ররাজনীতিসহ অন্যান্য গঠনমূলক কাজে জড়িত হওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় দিকভ্রান্ত তরুণ সমাজ এখন হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এছাড়াও চাকরি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সরকারী দলের নির্ভেজাল আনুগত্যকে কোয়ালিফাই করার একমাত্র মাপকাঠি বানানো এবং মেধার বেপরোয়া অবমূল্যায়নের কারণে মেধাবী তরুণরা মেধার স্বীকৃতি ও চাকরি প্রাপ্তির ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে মেধার ধস ও জীবনবোধে ব্যাপক হতাশা দেখা দিয়েছে।
জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার কারণে বিগত ৭ বছরে যারা নতুন করে ভোটার হয়েছেন এই তরুণ ভোটাররা সংবিধান প্রদত্ত জীবনের প্রথম ভোটটি প্রয়োগ করার আবেগময়ী অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে ক্ষোভ এবং অপমানবোধ সৃষ্টি হচ্ছে।
তরুণ সমাজকে স্বাধীনভাবে চিন্তা চেতনার বিকাশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না করে তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার পক্ষের শ্লোগানকে জঙ্গিবাদের সাথে মিলিয়ে দেয়া ও নজরদারির নামে তরুণ সমাজসহ সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা অব্যাহত রাখলে সমাজে মুক্ত বাতাস প্রবেশের জানালাটি বন্ধ হতে বাধ্য। আর আলো বাতাসহীন অন্ধকার ঘরে ফুলও ফুটে না, ফলও ফলে না কিন্তু কীট পতঙ্গ বেঁচে থাকতে পারে- এটাই স্বাভাবিক।
ইতঃপূর্বে বাংলাদেশে ইসলামী আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনসমূহ ধর্মীয় নানা আয়োজন, ইসলামী জলসা, ওয়াজ মাহফিল সীরাতুন্নবী (সা.) মাহফিল ও সেমিনার, হামদ-নাত, আজান ও কেরাত প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে বিরাট সংখ্যক তরুণ সমাজের উপর ধর্মীয় প্রভাব বিস্তার করতে পারত। কিন্তু বর্তমান অনির্বাচিত সরকার ইসলামী সব আয়োজনের উপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় সেই আলোকিত পথের দিশা তরুণ সমাজ আর পাচ্ছেনা। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ ইসলামিক দলগুলোর কর্মকাণ্ডে চরমভাবে বাধা প্রদান করায় যুবসমাজসহ জনগণের কাছে ইসলামের সুমহান বার্তা পৌঁছানো এখন অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে ইসলামের সঠিক জ্ঞানের অভাবে অনেকেই ভ্রান্ত পথে ধাবিত হচ্ছে বলে সচেতন মহলের ধারণা। গণতন্ত্রমনা ইসলামী দলগুলো যদি সঠিকভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সুযোগ পেতো তাহলে ধর্ম প্রতিষ্ঠার নামে ‘ব্রেইন ওয়াশ’ করে কোমলমতি ছাত্রদের এরকম জঙ্গি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করাতে পারত না। ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঠিকপন্থা সবার কাছে স্পষ্ট থাকত।
বিভক্তি ও ফিতনা সৃষ্টিকারী কুচক্রীমহল অত্যন্ত সুকৌশলে আমাদের জাতীয় জীবনের প্রত্যেকটি স্তরে অনুপ্রবেশ করে তাদের ষড়যন্ত্র অব্যহত রেখেছে। একটি জাতির বিবেক হলো সেই জাতির বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, জাতির এই ক্রান্তিকালেও আমাদের বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ সম্পূর্ণরূপে বিভাজিত হয়ে আছে। দলীয় সঙ্কীর্ণ রাজনীতির কালো ছায়া তাদেরকেও প্রভাবিত করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ফলে সাহস করে কেউই আর সঠিক কথা বলতে চাচ্ছেন না। আবার বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ সরকারের গভীর ষড়যন্ত্রকে সঠিকভাবে উপলব্ধি না করে জাতীয় ঐক্যের নামে এমন সব বক্তব্য প্রদান করছেন যা সরকারের উদ্দেশ্যকেই সফল করছে এবং এ ধরনের বক্তব্যেকে জাতির বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বিভক্তির ক্ষতকে আরো গভীর করে তুলছে। এই বিভাজনের অপসংস্কৃতির কুপ্রভাবও তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
দেশপ্রেম, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধকে সরকার ও মিডিয়া মিলে আজ একটি ছাঁচের ভেতর ফেলে দিয়েছে। সেই ছাঁচের বাইরে যা কিছু- তার সবই অগ্রহণযোগ্য মর্মে একটি ধারণা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। অপ্রীতিকর বিষয় ও সত্য বেরিয়ে পড়তে পারে- এই আশঙ্কায় সত্যান্বেষণ থেকে বিরত থাকা বা সত্যান্বেষণে বাধা দেওয়া অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমরা এখন সেই অবস্থায় আছি। ফলে আমাদেরকে অনাকাক্সিক্ষত সব সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
তাই সময়ের দাবি শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী ও নৈতিক শিক্ষার প্রচলন ও চর্চা বৃদ্ধি করা। শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ ছাত্ররাজনীতির পরিবেশ নিশ্চিত করা। সকল ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিতসহ তাদের গঠনমূলক তৎপরতাকে রাষ্ট্র কর্তৃক সহায়তা করা। অবিলম্বে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। সকলক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করাসহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের পথ সুগম করা। মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। পারিবারিক বন্ধন ও পারিবারিক শিক্ষা মজবুত করা। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও অযাচিত দলীয়করণ বন্ধ করা। প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা। জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী ও অন্যান্য সকল দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্বিঘেœ করার সুযোগ দেয়া। সর্বোপরি সকল প্রকার বিভাজনের পথ পরিহার করে দলীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দলমত, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তোলা।
জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের ভূমিকা রহস্যজনক
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকার পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝে উঠতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। উগ্রবাদের হুমকি মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে বলিষ্ঠ জাগরণের আহ্বান জানানোর যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল, সেটাকে কাজে লাগানোর পরিবর্তে তারা দলীয় রাজনীতিতে আটকে যাওয়ার মতো মারাত্মক ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছেন। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কণ্ঠস্বর হওয়ার পরিবর্তে তারা গণতন্ত্রকে হত্যা করে ফ্যাসিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদেই সারাদেশে হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গণগ্রেফতার, গুম, অপহরণ, কথিত ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। একই সাথে বেড়েছে গুপ্তহত্যার পরিসরও। বাংলাদেশে এখন যে জননিরাপত্তার সঙ্কট তৈরি হয়েছে এতটা বিপর্যয়ের মধ্যে দেশ আগে কখনো পড়েনি। এই অবস্থার পরিত্রাণ দরকার। কিন্তু সরকার উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর জন্য কথিত জঙ্গি ধরার অজুহাতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীসহ সাধারণ জনগণকে গ্রেফতার করে নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাচ্ছে। যেকোন নেতিবাচক ঘটনার সাথে জোর করে জামায়াতের কল্পিত সম্পর্ক আবিষ্কার করা সরকারের রীতিমত ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।
জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে জনমনে ব্যাপক সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে প্রয়োজন হলো পথহারা যুব সমাজের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে তাদেরকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ গ্রহণ, হতাশা ও ক্ষোভের সঠিক কারণ চিহ্নিত করে তা দূর করার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। এই পদক্ষেপ ব্যর্থ হলে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে উগ্রবাদীদেরকে চিহ্নিত করে তাদেরকে গ্রেফতার, তাদের কাছ থেকে তথ্য উদঘাটনের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রমের মোটিভ উদ্ধার করে আর কারা কারা জড়িত আছে তাদেরক চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট সকলকে গ্রেফতারপূর্বক বিচারের মুখোমুখি করে কঠিন শাস্তি প্রদান করা। সেখানে সরকার তার দায়িত্ব পালনে সফলতা দেখানোর পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই সরকার ও তার দোসররা ব্লেম গেইমের মধ্যে ব্যস্ত রয়েছে। একদিকে জঙ্গি অপারেশনে তাদেরকে জীবিত আটক করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্ষম হচ্ছে না। অন্যদিকে কোথাও কোথাও মানুষ জঙ্গিদেরকে ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করলেও গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে উৎস উদঘাটনের বদলে ধৃত অপরাধীদেরকে রহস্যজনকভাবে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হচ্ছে। সাধারণভাবে দেশের মানুষের ধারণা, সরকার তাদের কোন দুর্বলতাকে গোপন করতে জঙ্গিদের কাছ থেকে তথ্য উদঘাটনের আগেই বিনা বিচারে হত্যা করে ফেলছে। আবার অনেকেই মনে করেন সরকার প্রকৃতপক্ষে জঙ্গিদেরকে নির্মূল করতে আন্তরিক নয়। তারা এই ইস্যুকে জিইয়ে রেখে তাদের অবৈধ মসনদকে পাকাপোক্ত করতে চায়।
চরমপন্থা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক কারা?
১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগের শাসনামলে গোপালগঞ্জ থানা কৃষকলীগ নেতার ছোট ভাই মুফতি হান্নান ও তার সহযোগিদের দ্বারা সংগঠিত কোটালি পাড়ার ঘটনা থেকে শুরু করে আজ অবধি যতগুলো জঙ্গি আস্তানা দেশের বিভিন্ন জায়গায় আবিস্কৃত হয়েছে এবং জঙ্গি হিসেবে যারা ধরা পড়েছে তার উল্লেখযোগ্য আস্তানা ও আটক জঙ্গিদের সাথে কোন না কোনভাবে আওয়ামী লীগের কানেকশন ও যোগসূত্র বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
জেএমবি প্রধান শায়খ আব্দুর রহমান কে?? আওয়ামী এমপি মির্জা আযমের ভগ্নিপতি!
ব্লগার নিলয় হত্যাকারী হিসেবে কার নাম এসেছে?? মহাজোট সরকারের শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর ভাতিজা নাহিনের।
গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলাকারী রোহান ইবনে ইমতিয়াজ কে?? ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা ইমতিয়াজ খান বাবুলের ছেলে।
আইএস এর ভিডিওতে আবারও বাংলাদেশে হামলার হুমকিদাতা সাফি কে?? আওয়ামী লীগের নেতা, তথাকথিত জনতার মঞ্চের অন্যতম নায়ক, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব ও নির্বাচন কমিশনার সফিউর রহমানের ছেলে।
শোলাকিয়ায় ঈদগাহ ময়দানে হামলাকারী কার নাম এসেছে?? আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল।
সিঙ্গাপুরে জঙ্গিবাদী তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি কায়েস কে?? চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা নূরুল ইসলামের পুত্র।
রাজশাহীতে জঙ্গি কানেকশনের অভিযোগে অভিযুক্ত মুনতাসিরুল ইসলাম অনিন্দ্য কে?? রাজশাহী মহানগরীর সাবেক মেয়র এবং আওয়ামী লীগের নেতা খায়রুজ্জামান লিটনের চাচাতো ভাই।
কল্যাণপুরের জঙ্গি বাড়ির মালিক কে?? স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আতাহার উদ্দিন।
এই সব ঘটনার দ্বারাই এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আওয়ামী লীগ কোনভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের আমলেই দেশে জঙ্গিবাদের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে। আওয়ামী লীগ সরকারই ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে এবং জঙ্গিবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। সরকারের একদলীয় স্বৈরশাসন ও ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়াতেই জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হয়েছে। এখন তারা নিজেদের দোষ এড়ানোর জন্য জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পানি ঘোলা করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।