কুরবানীর শিক্ষা ও আমাদের করণীয়–
কুরবানীর শিক্ষা ও আমাদের করণীয়-
এম হুসাইন ফারুক
১। কুরবান আরবী শব্দ। ফার্সি ও উর্দুতে এ শব্দ কুরবানি রূপে পরিচিত যার অর্থ আরও নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য অর্জন করা।
২। ইসলামী পরিভাষায় এর অর্থ হলো, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাসিল হয়।
৩। আরো স্পষ্ট করে বলা যায় কুরবানী হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার লাভের আশায় নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করা। এর মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায়।
উৎপত্তি:
ইসলামে কুরবানীর ইতিহাস বেশ প্রাচীন।
১। হাবিল ও কাবিলের ইতিহাস
”আর তাদেরকে আদমের ছেলের সঠিক কাহিনী শুনিয়ে দাও। তারা দুজন কুরবানী করলে তাদের একজনের কুরবানী কবুল করা হলো। অন্যজনেরটা কবুল করা হলো না। সে বলল আমি তোমাকে মেরে ফেলব। সে জবাব দিল আল্লাহ তো মুত্তাকিদের নজরানা কবুল করে থাকে।” মায়েদা-২৭
“প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর একটি নিয়ম ঠিক করে দিয়েছি, যাতে সে উম্মতের লোকেরা সে পশুদের উপর আল্লাহর নাম নেই যেগুলো তিনি তাদেরকে দিয়েছেন।” হাজ্জ-৩৪
“ওই সন্তান যখন তার সঙ্গে কাজকর্ম করার বয়সে পৌঁছলেন তখন একদিন ইব্রাহিম তাকে বললেন, “হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যেন আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন তুমি বলো তুমি কি মনে করো? তিনি বললেন, “হে পিতা, আল্লাহ আপনাকে যা করতে হুকুম করেছেন আপনি তাই করুন। আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে অবশ্যই ধৈর্যশীল হিসাবে দেখতে পাবেন।” সাফফাত-১০২
যুগে যুগে কুরবানী:
০ আগেই বলেছি কুরবানীর অর্থ
০ এটা নতুন কোন বিষয় নয়
০ প্রথম মানুষ ও নবী হযরত আদম আলাইহিস সাল্লাম থেকে শুরু হয়েছে।
” শেষ পর্যন্ত শয়তান তাদেরকে সেই গাছটির লোভ দেখিয়ে আমার হুকুমের আনুগত্য থেকে সরিয়ে দিল এবং যে অবস্থার মধ্যে তারা ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে ছাড়লো। আমি আদেশ করলাম, এখন তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু।” বাকারা-৩৬
০ হযরত আইয়ুব আলাইহিস সালামকে শারীরিক অসুস্থতা দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে।
০ হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার একমাত্র পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে কুরবানীর নির্দেশ দেয়ার পূর্বে নমরুদের আগুনে ফেলে আল্লাহ তাঁর ভালোবাসার পরীক্ষা নেয়া হয়েছে।
” তিনি বললেন, তোমরা কি নিজেদেরই তৈরি করা জিনিসের পূজা করো। অথচ আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যে জিনিসগুলো তৈরি করেছো তাদেরকেও। তারা পরস্পর বললো, এর জন্য একটি অগ্নিকুণ্ড তৈরি করো এবং একে জলন্ত আগুনের মধ্যে ফেলে দাও।” সাফফাত-৯৫, ৯৬, ৯৭
০ হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালামকে করাত দ্বারা দ্বিখন্ডিত করে হত্যা করা হয়েছে।
০ হযরত ইয়াহিয়া আলাইহিস সালামের শিরশ্ছেদ করে ইয়াহুদী শাসক হিরোডিয়াস তার প্রেমিকাকে উপহার দিয়েছিল।
০ হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে শুলে চড়ানো চেষ্টা করা হয়।
০ হযরত বেলাল (রা:) কে প্রচন্ড গরম বালুর উপর শুইয়ে দিয়ে বুকে পাথর চাপা দেয়া হয়েছিল। এই অবস্থায় তাকে মোহাম্মদের ধর্ম অর্থাৎ ইসলাম পরিত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হতো। এরপরও তিনি শুধু বলতেন আহাদ আহাদ আহাদ।
০ হযরত মাসয়াব বিন উমার ( রা:): কে
দ্বীনের দাওয়াত কবুল করার জন্য তাকে সকল সম্পদ ত্যাগ করতে হয়েছে। বিলাসবহুল জীবনের পরিবর্তে কষ্টকর জীবন যাপন করতে হয়েছে।
হযরত আমির বিন ফাহিরা:কে
ঈমান আনার কারণে হযরত আমির বিন ফাহিরার শরীর কাঁটা দিয়ে বিদ্ধ করা হয়েছে। তার উপর এত নির্যাতন করা হয়েছিল যে, নির্যাতনের ফলে তার দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়।
০ হযরত খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহু: কে
ঈমান আনার কারণে তাকে জ্বলন্ত আগুনের উপর শুইয়ে রাখা হতো। তার শরীরের চর্বি গলে গলে আগুন আগুন নিভে যেত।
০ হযরত আমের রাদিআল্লাহু আনহু: কে
ঈমান আনার কারণে তাকে পানিতে ডুবিয়ে নির্যাতন করা হতো। তার মা সুমাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহার লজ্জাস্থানে বর্ষা নিক্ষেপ করে তাকে শহীদ করে দেওয়া হয়। তার পিতা ইয়াসির (রা:) ও ভাই আব্দুল্লাহ (রা:) নির্যাতনের শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেন।
সবশেষে সকল মুসলমানদের কে তাদের সহায় সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন সবকিছু পরিত্যাগ করে, সবকিছুকে কুরবানী দিয়ে আল্লাহর পথে মদিনায় হিজরত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইবনে তাইমিয়া, মুজাদ্দিদে আলফেসানী তাদের উপরেও দ্বীনের পথে চলার কারণে অত্যাচার নির্যাতন করা হয়েছে।
বর্তমান যুগেও যারা সত্য এবং ন্যায়ের পথে চলেছেন তাদের অনেককেই জীবনের কুরবানী করতে হয়েছে।
মিশরে শহীদ হাসানুল বান্না ও সাইয়েদ কুতুব শহীদ শাহাদাত বরণ করেছেন।
ওস্তাদ ওমর তিলমেসানী, আব্দুল কাদের আওদাহ, জয়নাব আল গাজালী সহ অসংখ্য মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
তুরস্কে বদিউজ্জামান নুরসী সহ অনেকেই জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
ইস্তাম্বুলের প্রতিটি লাইটপোস্টে ইসলাম প্রিয় মানুষদের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল অনেক দিন।
শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ, বানিয়ে জামায়াত সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (রহ:) অনেকবার কারাবরণ করেন এবং এক পর্যায়ে তাকে ফাঁসির আদেশ হয়। আল্লাহর রহমতে ও বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ফলে তার ফাঁসি কার্যকর করতে পারেনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার।
প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ:
শহীদ আব্দুল মালেক
শহীদ সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব সহ আরো অনেকে নিজেদের জীবন কুরবান করেছেন
শুধুমাত্র দ্বীনের বিজয়ের জন্য।
আজকে আমাদের সামনে তো রয়েছে চাক্ষুষ শাহাদাতের ইতিহাস। শুধুমাত্র দ্বীনের পথে চলার কারণে শহীদ হতে হয়েছে এদেশের শ্রেষ্ঠতম সন্তান আব্দুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে। তাদের ইতিহাসতো আমাদের সামনে জাজ্জ্বল্যমান। নতুন করে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই। এদেশে ইসলামকে প্রতিষ্ঠার জন্যই তারা তাদের জীবনকে কোন রকম প্রশ্ন ছাড়াই দ্বিধাহীন চিত্তে আল্লাহর পথে কুরবান করেছেন।
কারা প্রকোষ্ঠে নির্যাতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে এ দেশের শ্রেষ্ঠতম সন্তান অধ্যাপক গোলাম আজমকে, শ্রেষ্ঠ আলেমেদ্বীন মাওলানা একেএম ইউসুফকে, শ্রেষ্ঠ পার্লামেন্টারিয়ান মাওলানা আব্দুস সোবহানকে।
জালিমের জুলুমের শিকার হয়ে এখনো কারা প্রকোস্টে নির্যাতিত হচ্ছেন এদেশের ইসলাম প্রিয় মানুষদের নেতা, ইসলামী চিন্তাবিদ, মুফাসসিরে কুরআন, কোরআনের পাখি আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী।
আমাদের করণীয়:
১। কি ও কেন প্রশ্ন ছাড়াই আল্লাহর হুকুম মেনে নেয়া।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের আগুনের যাওয়ার পর এবং সন্তানকে কুরবানী করার নির্দেশ পাওয়ার পরের ঘটনা।
রব্বী হাবলি মিনাস সলিহীন।
২। এ হুকুম পালন করতে গিয়ে ত্যাগ এবং কোরবানি দেয়ার প্রশ্ন আসবেই।
যুগে যুগে যারাই আল্লাহর হুকুম পালন করতে গিয়েছেন তাদেরকেই কুরবানী করতে হয়েছে।
সূরা আন্ কাবুত
৩। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সকল ত্যাগ ও কোরবানি দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ ত্যাগ ও কোরবানির মাধ্যমেই সত্যিকার মুমিনদেরকে বাছাই করা হয়।