শিবিরের সিরাত সম্মেলনে একেবারেই শেষ অংশে আমার উপর দায়িত্ব পড়েছে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপরে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করার।আমার আলোচনার বিষয় বলা হয়েছে
“কল্যাণমূখী রাষ্ট্র প্রতিষ্টায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম“
তো,এই বিষয়ের উপরে ২৫ মিনিট-আধা ঘন্টায় আসলে এটা বলতেই হবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে,রাসুল [সা.] এমন এক বহুমুখী প্রতিভা,বহুমুখী নেয়ামত বরকতপূর্ণ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন যে, যেকোন আলোচনায় যেকোন ভাবে রাসুলকে বিশ্ববাসীর সামনে কিন্তু উপস্থাপন করার সুযোগ আল্লাহ তাআলা রেখেছেন।
তাঁর আদর্শ এত দেদীপ্যমান ২৩ বছরের নবুয়্যতের জীবন, প্রিয় হাবীবের যে সংগ্রামী জীবন, ১৩ বছর মক্কায় কত কষ্ট তিনি করলেন, ইসলামী সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্টার পর ১০ বছর মদিনায় তিনি ইতিহাসের একটি স্বর্ণোজ্জ্বল যুগ উপহার দিলেন।সে সম্পর্কে এত ‘দিক এবং বিভাগ’ যেগুলো তাঁর ‘বিশাল রাষ্ট্রের’ যে পরিধি ছিল এবং যে ‘বিশাল কর্মযজ্ঞ’ ছিল সেগুলো এত সংক্ষিপ্ত সময়ে আলোচনায় তুলে ধরা যাবে না।
এ আলোচনায় আলটিমেটলি আমরা দু-দিককে প্রতিপাদ্য হিসেবে নিতে পারি,আলোচনাটা পরিষ্কার করার জন্য। একটা হচ্ছে, রাসুল [সা.]কেমন কল্যানমুখী রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন।সে রাষ্ট্রের একটা চিত্র, একটা ছবি সংক্ষিপ্তভাবে অন্তত বিশ-পঁচিশ মিনিটে আমাদের সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করবো।
এটা একটা আলোচনার দিক।আরেকটা দিক হলো, সেই কল্যানমুখী রাষ্ট্র রাসুল [সা.] কিভাবে প্রতিষ্টিত করেছিলেন,কি পদ্ধততে তিনি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র কায়েম করেছিলেন সেই পদ্ধতিটাও এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং আলোচনার প্রতিপাদ্য।এ দুটো বিষয় আমি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
পয়লা কথা হচ্ছে, সেই আলোচনায় যাওয়ার শুরুতে আমাদের বুঝে নেয়ার দরকার যে কল্যাণমূখী রাষ্ট্র প্রতিষ্টায় রাসুলের ভুমিকা যেহেতু আমরা আলোচনা করছি তো সে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র কথাটার অর্থ কি,কল্যাণরাষ্ট্র বলতে কি বুঝায়।এটা একটু বুঝা দরকার।
পৃথিবীতে অনেক সমাজবিজ্ঞানী,অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী,অনেক দার্শনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের, কল্যাণরাষ্ট্র অর্থাৎ ‘ওয়েলফেয়ার স্টেইট’ সম্মন্ধে অনেক কথা বলেছেন।সমাজবিজ্ঞানী মার্শাল-রুশো-ল’-মিল (jaun stuart mill) এরা যে ‘লেইস্যাজ ফেয়ার( Laissez-faire) থিওরী` বা `কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের` যে ধারণা দিয়েছেন আসলে প্র্যাক্টিক্যালি দেখা গিয়েছে সে রাষ্ট্রগুলো কল্যাণরাষ্ট্র নয়,এটা ছিল একটা পুলিশি রাষ্ট্র।’পুলিশ স্টেইট’ হিসেবে সেগুলো কিন্তু প্রতিষ্টিত হয়েছিল।
উইকিপিডিয়াতে ‘ওয়েলফেয়ার স্টেইট’ অর্থাৎ ‘কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের’ যে ধারণা দেয়া হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে যে,“The welfare state is a form of government in which the state protects and promotes the economic and social well-being of the citizens, based upon the principles of equal opportunity, equitable distribution of wealth, and public responsibility for citizens unable to avail themselves of the minimal provisions for a good life“
অর্থাৎ এখানে উইকিপিডিয়াতে ‘ওয়েলফেয়ার স্টেইট’ বলতে বুঝানো হচ্ছে যে, ওয়েল ফেয়ার রাষ্ট্র এমন একটা ধারণা যেখানে রাষ্ট্র তাদের নাগরিকের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং কল্যাণকে রক্ষা করবে,উন্নয়ন করবে এবং এক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে।এমনকি একটা রাষ্ট্রের যারা ‘অক্ষম’, যারা ‘আয় উপার্জন করতে পারেনা’ বা ‘কোন কারণে যাদের কাজ নেই’,সমতার ভিত্তিতে তাদের সম্পদের সমানুপাতিক বিধান করে তাদেরও একটা সুখী জীবনের নিশ্চয়তা যারা দিতে পারে,দায়বদ্ধতা যারা নিতে পারে।এটাকে একটা ওয়েল ফেয়ার হিসেবে বলা হয়েছে।
রাসূলে আকরাম [সঃ] তাঁর যে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা,তিনি যে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই কল্যাণ রাষ্ট্র’র ধারণা কোরআন মাজীদে দিয়ে প্রিয় নবী মোহাম্মদ মোস্তফা [সঃ] কে পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন যে,একটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা হাতে আসলে পরে (What is his duty)-তাঁর কর্তব্য কি হবে?সেটার ওয়েলফেয়ার এক্টিভিটি’স টা কি?
আল্লাহ তায়ালা সূরা হজ্জের,৪১ নাম্বার আয়াতে প্রিয় নবীর শানে একথা বলে দিয়েছিলেন।রাসূল [সা] যে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে তিনি মদিনাতে ‘Government’ এর একটা দায়িত্ব গ্রহণ করলেন,সে দায়িত্বটার,সে ক্ষমতার কল্যাণ কি?আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলছেন সূরা হাজ্বের ৪১ নম্বর আয়াতে,الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ ۗ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ﴾চারটি কাজ এখানে বলা হয়েছে, ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্রের,রাসূল [সঃ] এর কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের চারটা বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন।
এক হচ্ছে,আল্লাহ তায়ালা শুরুতেই বলছেন,الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ যারা যাদেরকে পৃথিবীর উপরে ক্ষমতাবান করা হবে,রাষ্ট্র ক্ষমতার দায়িত্বে যারা আসবে,যারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে তাদের প্রথম কাজ কি?
আল্লাহ তায়ালা বলছেন,’First and firmest’ ডিউটি হচ্ছে ‘ أَقَامُوا الصَّلَاةَ’ ‘সালাত প্রতিষ্ঠার’ মধ্যে দিয়ে নাগরিকদের, জনগণের চরিত্র গঠন করতে হবে।নৈতিকতা তৈরি করার মূল মাধ্যম হচ্ছে প্রতিদিন পাঁচবার আল্লাহ তা’আলার কাছে হাজির হয়ে,সে যে আল্লাহর গোলাম,আল্লাহর দাস এবং তার যে একজন মালিক আছে,তাঁর আদেশ-নিষেধ,বিধিবিধান প্রতিদিন পাঁচবার স্মরণ করে নিজের চরিত্রকে আল্লাহমূখী করবে।এটা হচ্ছে প্রথম কাজ।
দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে,আল্লাহ তায়ালা বলে দিচ্ছেন,وَآتَوُا الزَّكَاةَ ‘যাকাত ভিত্তিক’ একটা অর্থনীতি,অর্থব্যবস্থা চালু করে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন রাষ্ট্রের পূরণ করতে হবে।
তৃতীয় দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা এখানে বলেছেন, وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ ‘সমস্ত ভালো’ কাজগুলো চালু করে দিবে,এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।আমর (হুকুম) এটা রাষ্ট্র ছাড়া মানুষের উপরে কোন আদেশ কিন্তু একজন ব্যক্তি ‘Individually’ দাওয়াত দিতে পারে,অনুরোধ করতে পারে,এটা ‘আমর বিল মা’রুফ’ হয়না।এটা অনুরোধ বিল মারুফ হতে পারে।কিন্তু আল্লাহ বলছেন ‘আমর'(আদেশ) কিন্তু আদেশ দেয়ার একটা পজিশন হচ্ছে রাষ্ট্র।রাষ্ট্রের পজিশনে না গেলে সে কিন্তু একটা হুকুম জারী করতে পারেনা।তাই আল্লাহ বলছেন,وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ সমস্ত ভালো কাজ,সৎকাজগুলো রাষ্ট্র চালু করবে।
এবং চতুর্থ কাজ হচ্ছে আল্লাহ তা’আলা বলছেন,وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ এবং সমস্ত অকল্যাণকর কাজ,ক্ষতিকর কাজ, খারাপ কাজগুলো বন্ধ করে দিয়ে সমাজকে পবিত্র করবে।
এই চারটি কাজ,
১.চরিত্র গঠন করা।
২.অর্থনীতির ব্যাপারে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন;ভাত,কাপড়, শিক্ষা,চিকিৎসা ও বাসস্থানসহ তার সমস্ত হকগুলো ফিরিয়ে দেয়া।
৩.সমাজে সমস্ত ভালো কাজগুলো চালু করা এবং সমস্ত অকল্যাণকর কাজগুলো বন্ধ করে দেওয়া।
৪.সমস্ত অকল্যাণকর কাজগুলো বন্ধ করে দেওয়া।
এটা ‘সূরা হজ্জে’ আল্লাহ তা’আলা তার প্রিয় হাবীবকে কল্যাণমূখী রাষ্ট্র কায়েমের চারটা কাজ দিয়েছেন,দুনিয়ার মানুষ তো ‘ওয়েলফেয়ার স্টেইটে’র সংজ্ঞা দিয়েছে,আল্লাহ তায়ালা যে ‘ওয়েলফেয়ার স্টেইট’ এর সংজ্ঞা দিচ্ছেন সেটার হচ্ছে চারটি বৈশিষ্ট্য।চরিত্র গঠন করো,মানুষের অর্থনীতির সমস্যা সমাধান করো,সমস্ত ভালো কাজগুলো করো,এবং সমস্ত খারাপ কাজগুলো বন্ধ করে দাও।
আমরা দেখতে পাই যে, রাসুল [সাঃ] কল্যাণমুখী যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন,পৃথিবীতে তাৃর আগমনের উদ্দেশ্য ছিলো এটাই। আল্লাহতা’আলা সূরা হাদীদের ২৫ নং আয়াতে পরিষ্কারভাবে রাসুল[সা] সহ সমস্ত আম্বিয়ায়ে কিরামের পৃথিবীতে আগমনের লক্ষ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন,
لَقَدْ اَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَیِّنٰتِ وَ اَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْمِیْزَانَ لِیَقُوْمَ النَّاسُ بِالْقِسْطِۚ وَ اَنْزَلْنَا الْحَدِیْدَ فِیْهِ بَاْسٌ شَدِیْدٌ وَّ مَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَ لِیَعْلَمَ اللّٰهُ مَنْ یَّنْصُرُهٗ وَ رُسُلَهٗ بِالْغَیْبِؕ اِنَّ اللّٰهَ قَوِیٌّ عَزِیْزٌ۠
আল্লাহ তায়ালা বলছেন, আমি রসলগণকে পাঠিয়েছি, বাইয়্যেনাহ দিয়েছি, মীযান দিয়েছি, কিতাব দিয়েছি। সমস্ত বিধিবিধান, ভালো মন্দ মাপার মানদন্ড সব দিয়েছি। কি জন্য? কি উদ্দেশ্য? রাসূলগণ কেনো আসলেন?
لَقَدْ اَرْسَلْنَا رُسُلَنَا. বহুবচন। শুধু আখেরী নবী নন। সমস্ত নবীগণকে পাঠানোর উদ্দেশ্য, তাদের কাছে কিতাব, সহিফা আকারে বাইয়্যেনাহ, বিধান, মানদণ্ড সবকিছু দিয়ে পাঠানো হয়েছে। তাদের duty কি? لِیَقُوْمَ النَّاسُ بِالْقِسْطِۚ ।قُوْمَ মানে হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত করা, খাড়া করা, কায়েম করা, দাঁড় করানো, establish করা। কীসের উপর? بِالْقِسْطِۚ ..
সুবিচার, ইনসাফ (Justice) নাগরিকের যার যা হক,তা তাকে দিতে পারা- এর নাম হচ্ছে সুবিচার। এটার জন্য সমস্ত আম্বিয়ায়ে কিরাম এসেছেন মানবজাতির কাছে।এবং কি বলা হয়েছে? শুধু মুসলমান নয়; কে দ্বীন মানলো আর মানলো না; কে ঈমান আনলো আর আনলো না,সেটি কোন বিষয় নয়।আল্লাহ তায়ালা বলে দিচ্ছেন যে,
এই সুবিচার টা হচ্ছে সকলের জন্য।সমস্ত মানবজাতির জন্য। لِیَقُوْمَ النَّاسُ.. For whole mankind
সমস্ত বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্য আল্লাহর নবীদের পাঠানো হয়েছে এবং আমাদের আখেরী নবী ছিলেন সেই রিসালাতের ধারাবাহিকতার সর্বশেষ নবী, খাতিমুন নাবিয়্যিন মুহাম্মদ মুস্তফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।ফলে,দেখা যাচ্ছে যে, রাসূলদের আগমনের উদ্দেশ্য-ই হচ্ছে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তাহলে শুধু নামায, শুধু রোযা,শুধু হজ্জ,শুধু যাকাত,ব্যক্তিগত জীবনে কিছু ধর্ম পালন এটাই যদি উদ্দেশ্য হতো- তাহলে আল্লাহ তায়ালা সূরা হাদীদের এই ২৫ নম্বর আয়াত কীজন্য উল্লেখ করলেন?
এখানে বলছেন,وَ اَنْزَلْنَا الْحَدِیْدَ হাদীদের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে “লৌহ” রূপক অর্থে এখানে “রাষ্ট্রশক্তিকে” রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।রাষ্ট্র শক্তি দিয়ে এই যে, ‘কিতাব’-‘মিযান’-‘বাইয়্যেনাহ’ এগুলো দিয়ে যা মানবতার সুবিচারের জন্য একটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যা লৌহের মত ক্ষমতাবান فِیْهِ بَاْسٌ شَدِیْدٌ وَّ مَنَافِعُ لِلنَّاسِ এটার মধ্যে, এই রাষ্ট্রের মধ্যে শক্তি আছে।আল্লাহর এই বিধান,এই সুবিচার কায়েমের জন্য সে প্রয়োজনে রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করবে وَّ مَنَافِعُ لِلنَّاسِ এবং রাষ্ট্রের মধ্যে যেহেতু শক্তি প্রয়োগের সুযোগ রেখেছে এবং وَّ مَنَافِعُ لِلنَّاسِ মানুষের জন্য কল্যাণ সুযোগও এই রাষ্ট্রের মধ্যে আছে।
সম্মানিত ভাই এবং বোনেরা,যারা আজকে দেশে এবং প্রবাসে আমাদের এই প্রাণপ্রিয় কাফেলার সিরাত সম্মেলনে আমরা আলোচনায় যুক্ত হয়েছি আমরা এটা মনে রাখবো যে,রাসূলের আগমনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বমানবতার কল্যাণ এবং কল্যাণমূখী রাষ্ট্র প্রতিষ্টার জন্যই আল্লাহতা’আলা রাসুল [সা.] কে পাঠিয়েছেন।এবং সে দায়িত্বই রাসূলগন পালন করেছেন।আল্লাহতা’আলা কোরআন মাজীদে আরোও অনেক সূরায় বলেছেন,لِیُظْهِرَهٗ عَلَى الدِّیْنِ كُلِّهٖؕ আর যত মতবাদ-আর যত দ্বীন-আর সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকবে তার উপরে আল্লাহর এই “দ্বীন” কে জাহির করা,বিজয়ী করা,প্রতিষ্টিত করা।এটা নবী রাসূলের আগমনের উদ্দেশ্য ছিল।
Even,আমরা যদি সূরা ‘আল-ইমরান’ ১১০ নাম্বার আয়াতে চলে যাই সেখানে আল্লাহতা’আলা বলেছেন,كُنْتُمْ خَیْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ تَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ একই কথা আমাদের সকলের পরিচিত জায়গা যে আমাদের আসাই এখানে আগমনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে, মানবতার জন্য Human being/Whole mankind তাদের কল্যাণের জন্য,তাদের ‘ওয়েলফেয়ারের’ জন্য اُخْرِجَتْ ‘উখরিজাত’-তাদের আগমন, তাদের আবির্ভাব ঘটেছে।ফলে,রাসুল [সা] কেমন রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করেছিলেন-খুব সংক্ষেপে আমি সেদিকে আপনাদেরকে নিয়ে যেতে চাই।
ছোট্র একটা ছবি যদি আঁকি সেখানে আমি শুরুতেই এটা বলতে চাইবো যত কল্যাণরাষ্ট্রের সংজ্ঞা আজকে সমাজবিজ্ঞানী-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী-দার্শনিকরা দিক না কেন,আল্লাহতা’আলা ‘কল্যাণরাষ্ট্রের’ যে ধারণা কোরআন মাজীদে সুরায়ে ‘হজ্জের ৪১’ নাম্বার আয়াতে উল্লেখ করে বলেছেন,সেখান থেকেই রাসূল সা. কিন্তু একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্টা করেছিলেন।এবং তিনি ‘হাদীস শরীফে’ পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছিলেন যে,”খায়রুল কুরুনি কারনি”-অর্থাৎ ‘সর্বোত্তম যুগ হলো আমার যুগ’।কারনি,আমার যে রাজ্য,আমার যে যুগ,আমার যে সময়,আমি যে সমাজ প্রতিষ্টা করেছি এটাই হচ্ছে-সর্বোত্তম যুগ।
এবং ঐ হাদীসেই বলেছেন, ‘সুম্মাল্লাযিনা য়ালুনাহুম সুম্মাল্লাযিনা য়ালুনাহুম’-পরবর্তী ধারাবাহিক সমাজব্যবস্থার একটি অবস্থা সম্পর্কে তিনি ধারণা দিয়েছেন যে,এই নবুয়্যতের পর আসবে-খেলাফত। তারপর আসবে রাজতন্ত্র।তারপর আসবে-স্বৈরতন্ত্র বা জুলুমতন্ত্র।তারপর আসবে-‘খেলাফত ‘আলা মিনহাজিন নবুয়্যত’।আমরা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেখতে পাই,আমাদের প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর দেড় হাজার বছর চলে যাবার পর রাষ্ট্রব্যবস্থার যে ধারাবাহিকতা দেখতে পাই,তা হচ্ছে এরূপ- নবুয়্যত এর ধারা শেষ হবার পর-খেলাফত শাসন চলেছে। খেলাফত এর যুগ বিদায় হবার পর-রাজতন্ত্রের প্রচলন ঘটেছে।
রাজতন্ত্রের সময়কালও চলে যাবার পর আমরা এখন স্বৈরতন্ত্রের বা জুলুমতন্ত্রের যুগ অতিক্রম করছি। ফ্যাসিজম বা স্বৈর যুগ এখন আমরা অতিবাহিত করছি। We are passing now fascism. এরপরেই আল্লাহর রাসুলের ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, ‘খেলাফাত আলা মিনহাজিন নবুয়্যত’।
এবার আমরা সেই আলোচনায় চলে যাচ্ছি।রাসূল[সাঃ] নিজেই হাদীসে এর বর্ণনা দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা কোরআন মাজীদে রাসুল [সাঃ]এর চরিত্র, আদর্শ বা ideology সম্পর্কে বলেছেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِیْ رَسُوْلِ اللّٰهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
অর্থঃ তোমাদের জন্য রাসুলের (সা.) জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।
(৩৩ :২১)
রাসূলের জীবন ই তো সর্বোত্তম আদর্শ। সর্বোত্তম যুগ তো তাহলে তাঁরটা ই হবে। তাঁকেই তো “রহমাতুল্লিল ‘আলামীন” হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। সমগ্র আলমের জন্য রহমত। “আলম” বলতে সমগ্র মানবজাতি কে বোঝানো হয়েছে। তাদের সকলের জন্য তিনি ছিলেন শান্তিস্বরূপ। শান্তিস্বরূপ অর্থ কী? তাঁর আদর্শ মানলে শান্তি, তাঁর আখলাক মানলে শান্তি। তাঁর যে বিধান, আদেশ তা জীবনে কার্যকর করলে শান্তি। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার জীবনের সব জায়গায় মানলে ই তিনি রহমাতুল্লিল ‘আলামীন। ফলে তাঁর জীবদ্দশায় দশ বছেরর শাসনামলে তিনি সেটা মেনেছিলেন,রাষ্ট্রে সেটা কায়েম করেছিলেন এবং সারা আলমের জন্য নিজেকে রহমতস্বরূপ প্রমাণ করেছেন। তিনি যে ছিলেন ‘ উসওয়াতুন হাসানা ’ বা সর্বোত্তম আদর্শ, তা তিনি তার জীবনে প্রমাণ করে গিয়েছেন।
আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায়, আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় আমরা মানুষকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বলে থাকি। অর্থাৎ, জনগণ ই ক্ষমতার উৎস। আল্লাহর রসুলের স্থাপিত কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের প্রথম যে মডেল,তার ভিত্তি ছিলো, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হবেন কেবল আল্লাহ।
اِنِ الْحُكْمُ اِلَّا لِلّٰهِؕ
অর্থঃ সকল ক্ষমতার মালিক কেবল আল্লাহ।
(সূরা ইউসুফ, আয়াতঃ৪০)
কারো কোন ‘Sovereign’ পাওয়ার নেই। There is no leader, there is no government, There is no parliament, no superior authority,আল্লাহ ছাড়া। ইসলামী কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন,
“ আল্লাহ ছাড়া কোন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী কেউ নেই।”
সার্বভৌম ক্ষমতা পেতে হলে তাঁর চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী, ভবিষ্যত, অতীত, বর্তমান সব কিছু জানেওয়ালা ‘আলীমুল ‘গাইব হতে হবে।আয়াতুল কুরসীতে উল্লিখিত আল্লাহর বৈশিষ্ট্যগুলোই প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য।মানুষ বলে, জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস, জনগণ পার্লামেন্টে যাবে, জনগণ ভোট দিয়ে যাদের নির্বাচিত করবে তারা তাদের তৈরি আইন দিয়ে রাষ্ট্র চালাবে। কিন্তু আমার প্রিয় নবী মুস্তফা [সাঃ] এই ধারণাকর পরিবর্তে কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের প্রথম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলে দিয়েছেন, Sovereignty belongs to almighty ALLAH.অর্থাৎ সব ধরণের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হবেন একমাত্র আল্লাহ। এটাই ছিলো রাসুল [সাঃ] এর প্রতিষ্ঠিত কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য।এবং কল্যাণমূখী রাষ্ট্র পেতে গেলে আল্লাহকে সব ক্ষমতার মালিক বলে মেনে নিতে হবে। ‘সূরা আরাফে’ আল্লাহ তা’আলা বলেন,
-اَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَ الْاَمْرُ
অর্থঃ সতর্ক হও! তাঁর সৃষ্টিতে তাঁর ই হুকুম চলবে।
[ সূরা আরাফ, আয়াতঃ৫৪ ]
এখানে কোন মানুষের হুকুম চলবেনা।
ফলে, মক্কার কাফের মুশরিকেরা রাসুল[সাঃ]কে এই দাওয়াত বন্ধ করতে বলেছিলো। উনি যখন সাবাহা পর্বতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ইয়া সাবাহা! সকলে জড়ো হলো। তারপর যখন তিনি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমার দাওয়াত দিলেন, তাঁকে অভিশাপ দেয়া হলো। তাঁর উপর ধ্বংস কামনা করা হলো, অত্যাচার শুরু হলো।আমরা জানি, মক্কার কাফির মুশরিকেরা তার এই দাওয়াতের প্রসার বন্ধ করবার জন্য তার চাচা আবু তালীবকে দিয়ে অনুরোধ করালেন। তিনি অনুরোধ করলেন। রাসূল (সাঃ) তখন কি বলেছিলেন? তিনি বলেন,
‘ আমার এক হাতে চাঁদ, আরেক হাতে সূর্য এনে দিলেও আমি এই পথ থেকে দূরে সরবো ন। ’
কাফিররা তাঁকে বলেছিলো,আমরা আপনাকে বাদশাহী বানাবো, সুন্দরী নারী দেবো, ধনসম্পদের পাহাড় করে দেবো। কিন্তু আপনি শুধু ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর’ দাওয়াত দিবেন না। আল্লাহর রাসুল[সাঃ] এই প্রস্তাব মেনে নেন নি। এটার নাম sovereignty. কল্যাণমূখী রাষ্ট্র তৈরি করতে হলে সেই কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের উৎস জনগণ নয়, বরং হতে হবে আল্লাহর বিধান।
পরবর্তী বিষয় হচ্ছে, সরকার ও জনগণের সম্পর্ক। আল্লাহর রাসূল(সাঃ) পরিষ্কার বলে গিয়েছেন,
‘ নাফরমানির কাজে কোন আনুগত্য নেই। শুধু নেক কাজেই আনুগত্য করা হবে।’
সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَطِیْعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیْعُوا الرَّسُوْلَ وَ اُولِی الْاَمْرِ مِنْكُمْۚ
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো খোদার এবং আনুগত্য করো রসূলের আর সেই সব আদেশ দানকারী লোকেদের।
আল্লাহর রাসূল(সাঃ) এর কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের আলোকে জনগণ ও সরকারের সম্পর্ক হবে ঠিক এরূপ। এবং এটা তিনি করেছিলেন। এই কারণে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা গড়ে উঠেছিলো। রাসূল(সাঃ) এর নবুয়্যতের ধারাবাহিকতায় যে খেলাফত গড়ে উঠেছিলো, তা ও ছিলো এই সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
আমীরুল মুমিনীন উমর [রাঃ] খুতবা দিচ্ছেন মসজিদে।তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো,আমরা যে কাপড় পেয়েছি তাতে জামা এতো বড় হওয়ার কথা না। তাহলে আপনার জামা এতো বড় কেনো?! তখন উমর(রাঃ) এর ছেলেকে দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা দিতে হলো যে, আমার কাপড় আর আব্বার কাপড় দুটো জুড়ে দিয়ে আব্বার জামা বড় বানানো হয়েছে। এটাই accountability. যেখানে বাদশাহ বা প্রেসিডেন্ট কে প্রশ্ন করার অধিকার জন্মাবে। তিনি বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে সেসব প্রশ্নের জবাব দিবেন।
একদিন খুতবায় উমর[রাঃ] মহিলাদের নসীহত করছিলেন। তিনি মহিলাদের দেনমোহর কম নেয়ার জন্য উৎসাহিত করছিলেন। তখন এক মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ না, এ দেনমোহর নির্ধারণ করার অধিকার আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। আল্লাহ প্রদত্ত এ অধিকার হরণ করার ক্ষমতা আপনাকে কে দিয়েছে হে আমীরুল মুমিনীন?’ আমীরুল মুমিনীন মহিলার কথা শুনে তাজ্জব! এবং তিনি অবশেষে সেই মহিলার কথা মেনে নিলেন। তিনি এখতিয়ার দিলেন, যে মহিলারা নিজের পছন্দ মতো মোহর নির্ধারণ করতে পারবেন। একজন রাষ্ট্রনায়ক একজন জনগণের কথায় তার মত পরিবর্তন করলেন। রাসুল[সাঃ] প্রতিষ্ঠিত কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের জনগণ ও সরকারের সম্পর্ক এভাবেই গড়ে উঠেছিলো।
ব্যক্তিস্বাধীনতা ও রাসূল [সা.] এর কল্যাণমূখী রাষ্ট্রে বিদ্যমান ছিলো। এ রাষ্ট্রের নির্দেশ ছিলো,আদালত কর্তৃক দন্ডপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি এবং এমন কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি যার তদন্ত বা বিচার চলাকালীন সময়ে কেউ বাধা দিতে পারে, এই ধরণের ব্যক্তিরা ব্যতীত আর কাউকে আটক করা যাবে না।রাসুল [সা] এর সামনে মদীনার কিছু ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে আসা হলো। একজন সাহাবী দুইবার জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আমার প্রতিবেশী কে কেনো ধরে নিয়ে আসা হয়েছে?! আল্লাহর রাসুল [সা খোঁজ নিয়ে দেখলেন, এই ব্যক্তিদের গ্রেফতার ঠিক হয়নি। তিনি অতঃপর তাঁদের মুক্ত করে দিলেন।
রাসুল [সা) এর কল্যাণমূখী রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বজায় ছিলো। আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী তিনি মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান করেছিলেন। হালাল হারামের মানদন্ড আল্লাহ তাকে দিয়েছিলেন। কোন পথে আয় হালাল, কোনটা হারাম আয়।কোনটা অপচয়,কোনটা সুদ।وَأَحَلَّ اللّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا আল্লাহ করেছেন,যাকাতকে বাধ্যতামূলক আইন করেছেন,উত্তরাধিকার আইন করেছেন-মিরাসী আইন করেছেন-এতীমের হক দিয়েছেন।এভাবে একটা ‘ইকোনমিক্যাল’ ব্যবস্থার কাঠামো আল্লাহতা’আলা `কোরআন মাজীদে` দিয়েছিলেন, আল্লাহর রাসুল তা দিয়েই কিন্তু রাষ্ট্রের কল্যাণমূখী কাঠামো তৈরি করেছিলেন।এবং রাষ্ট্রের সকল ‘নাগরিকের’ ‘বুনিয়াদী’ প্রয়োজন আল্লাহর রাসুল পুরণ করেছিলেন এবং সরকারের দায়িত্ব অন্ন-বস্ত্র-খাদ্য-চিকিৎসা-বাসস্থান সব পালন করেছিলেন।এবং রাসুল বলছেন,এই হাদীসটা আপনাদের জানা আছে যে রাসুল বলছেন যে,”রাষ্ট্র ও সরকার সকল অভিভাবকহীনদের অভিভাবক এবং সাহায্যকারী ”
যার কোন গার্জিয়ান নাই,যার দেখার কেউ নেই,তার গার্জিয়ান এবং সাহায্যকারী হচ্ছেন রাসুল [স.]।উনি বলছেন এটা-রাষ্ট্র,রাষ্ট্র হচ্ছে তার সাহায্যকারী। এবং আরেকটি হাদীসে আল্লাহর রাসুল বলছেন যে,’পশ্চাতে বোঝা রেখে গেছে যে ব্যক্তি’ হাদীসে এই ‘বোঝা’র অর্থ মোহাদ্দেসীনে কেরাম করেছেন যে,ঋণ অথবা আশ্রয়হীন কোন স্ত্রী বা পুত্রকে রেখে কোন ইন্তেকাল করেছে এরকম পেছনে কোন ব্যক্তি ‘বোঝা’ রেখে মারা গেলে,যদি বোঝা রেখে যায় তাহলে সে ‘বোঝা’ বহন করার দায়িত্ব আমার।অর্থাৎ রাষ্ট্রের-যিনি প্রেসিডেন্ট তিনি একথা বলেছেন।ফলে অঅভিভাবকহীন মানুষের,এতীম অসহায়,যার কোন গার্জিয়ান নাই,যার কোন সাহায্যকারী নাই,তার দায়িত্ব হচ্ছে ‘ইসলামী রাষ্ট্রের’।এবং ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রের রাসুলের ফর্মুলা-ই তিনি এটা দিয়ে গিয়েছেন যে,হয় রাষ্ট্রকে মানুষকে কাজ দিয়ে তার জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে আর না দিতে পারলে তার ‘ভরণপোষণ ও নিরাপত্তার’ দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।
একটি কল্যাণমূখী রাষ্ট্রে কোন মানুষ না খেয়ে থাকতে পারবেনা,অন্নহীন-বস্ত্রহীন-নিরন্ন-ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারি কোন কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হতে পারেনা।রাসুলে আকরাম [সা] সেই কল্যাণমূখী অর্থনীতির নিরাপত্তা দিয়েছিলেন।এবং কোরআন মাজীদে আল্লাহতা’আলা রাসুলকে চমৎকার এক বিধান দিয়েছেনوَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ তোমাদের সকলের সম্পদে যারা ‘সায়েল’ যারা ‘মাহরুম’ যারা প্রার্থনা করবে,আর যারা বঞ্চিত তাদের সকলের অধিকার সম্পদশালীর সম্পদে আল্লাহই রেখে দিয়েছেন।ফলে অর্থনীতির সাম্যে এবং সম্পদের বণ্টনকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে,সুবণ্টিত করে নাগরিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন এক সমাজ কায়েম করার সে বিধান রাসুল [সা.] কল্যাণমূখী রাষ্ট্রে ছিল।
নেক্সট আমরা চলে যেতে পারি, রাসুলের কল্যাণমূখী রাষ্ট্রে অমুসলিম যারা থাকবেন,জিম্মী যারা থাকবেন, অন্য মতবাদে যারা বিশ্বাসী হবেন- তাদের আযাদী আল্লাহর রসুলের রাষ্ট্রে ছিলো। তারা ইসলামিক রাষ্ট্রের সমালোচনা করতে পারবে, নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়।তারা সমালোচনা করতে পারবে,অমুসলিম হোক,রসুলের রাষ্ট্রকে পছন্দ করে না- কিন্তু সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সমালোচনা করাটা রসুল পছন্দ করেন নাই।নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সকলের কথা তিনি শুনেছেন, সকলকে অধিকার তিনি দিয়েছেন।এবং কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের যিনি প্রেসিডেন্ট হবেন, রাষ্ট্রপতি হবেন,আল্লাহর রসুল নিজের জীবনকে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। নেতৃত্বের মানদন্ড হচ্ছে,
اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللّٰهِ اَتْقٰىكُمْؕ
আল্লাহ বলছেন, “ তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহকে বেশি ভয় করবে, যার বেশি তাকওয়া, আল্লাহর কাছে সে ততো বেশি সম্মানিত হবে।”
লিডারশিপের এটি একটা কোয়ালিটি। আল্লাহতা’আলা ইসলামী রাষ্ট্র বা কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের সবপর্যায়ে; মন্ত্রীত্ব বলেন,গভর্ণর বলেন,ডিসি বলেন,ইউএনও বলেন,পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীতে; প্রত্যেক সেক্টরে,Entire of the society,যারা যেখানে থাকবেন- তার মধ্যে যার অন্তরে যতো আল্লাহর ভয়,যার যতো তাকওয়া;তাকে তিনি ততো সম্মানিত করবেন,তিনি পদস্থ জায়গায় যাবেন।এবং আমানতটি অর্থাৎ রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহ এই কনসেপশন দিয়েছেন,
اِنَّ اللّٰهَ یَاْمُرُكُمْ اَنْ تُؤَدُّوا الْاَمٰنٰتِ اِلٰۤى اَهْلِهَاۙ
আল্লাহ আদেশ দিচ্ছেন- রাষ্ট্রের আমানত, ক্ষমতার আমানত, সম্পদের আমানত, কথার আমানত, সব ধরণের আমানত; اِنَّ اللّٰهَ یَاْمُرُكُمْ , আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন,
اَنْ تُؤَدُّوا الْاَمٰنٰتِ اِلٰۤى اَهْلِهَاۙ। তোমাদের আমানত সমূহ তার উপযুক্ত ব্যক্তির নিকট অর্পণ করো।যে অর্থের আমানত রাখতে পারে না,কথার আমানত রাখতে পারে না,সম্পদের আমানতের খিয়ানাত করে-সে কোন রাষ্টের দায়িত্বে আসতে পারবে না।ফলে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে,রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোন ক্যাটাগরির লোক হবে;রাসুল [সা] কিন্তু আবু বকরের মতো, উমরের মতো, উসমানের মতো, যায়েদের মতো- এই সমস্ত মানুষগুলো তিনি তৈরি করে আমানতদার
মক্কার ১৩ বছরের কঠিন পরীক্ষায় দগ্ধ হয়ে, আল্লাহ তায়ালা এতো পছন্দ করেছিলেন যে, পরীক্ষার শেষ বেলায় আল্লাহ আয়াত নাযিল করে বললেন,
هُوَ اجْتَبٰىكُمْ وَ مَا جَعَلَ عَلَیْكُمْ فِی الدِّیْنِ مِنْ حَرَجٍؕ
আল্লাহ তোমাদেরকে বাছাই করেছেন। তোমরা বাছাই হয়েছো। ১৩ বছরের ঘর ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে, পিতার চেয়ে আমাকে ভালোবেসেছো, স্ত্রীর চেয়ে, সন্তানের চেয়ে ভালোবেসেছো, সম্পদ ছেড়েছো- আমার জন্য। ফলে এই বাছাইতে তোমরা টিকে গেছো। هُوَ اجْتَبٰىكُمْ। এই যে পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছিলো, তারা ই মদীনায় যাবার পরে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে আমানতের যোগ্য মনে করে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদেরকে দিয়ে দিয়েছেন।
এটা রসুলের কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের যে মন্ত্রণালয় গুলো ছিলো, রাষ্ট্রের যে মূল সেক্টরগুলোতে তিনি যাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন পরীক্ষার আগুনে দগ্ধ হওয়া, পরীক্ষিত হওয়া, বাছাইতে টিকে যাওয়া মানুষদেরকেই আল্লাহ তায়ালার এই প্রিয় নবী রাষ্ট্র পরিচালনার সব জায়গাতে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এবং সেই দায়িত্বের ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্বের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে বলেছেন,
اَلرِّجَالُ قَوّٰمُوْنَ عَلَى النِّسَآءِ
এটাও কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের একটা পলিসি, যে পুরুষরা হবে রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্বে।পুরুষ-নারীজাতির নেতা। উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া,রাষ্ট্রের দায়িত্ব নারীদের উপর যাবে না।রাষ্ট্র, সমাজের মূল কর্তৃত্বটা বিশেষ কোন ব্যতিক্রম ছাড়া,খুব ইমার্জেন্সী কোন Exception ছাড়া নারীদের কাছে আল্লাহর প্রধান দায়িত্ব টা যাবে না-এটা-ই আল্লাহ তায়ালার বিধান। এবং কারণ কি,জন্মগতভাবে নারীরা গুরুদায়িত্ব বহন করার ব্যাপারে দৈহিক এবং মানসিকভাবে শক্তির দিক দিয়ে তারা কিন্তু কম্পারেটিভলি অতোটা অধিকারী নয়।ক্ষমতাবান নয়। সেকারণে ইসলামী কল্যাণমূখী রাষ্ট্রে,রসুলের কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের মূল কর্তৃত্বে পুরুষেরাই ছিলেন।
হে, নারীরা পরামর্শ দিয়েছেন,রসুলের উম্মুল মুমিনীন যারা ছিলেন- যুদ্ধের ময়দানে পরামর্শ দিয়েছেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় সাহায্য করেছেন। অর্থাৎ parliamentary democracy-র যে আদল টা,রাষ্ট্রপতি পরামর্শ সবার থেকে নিবে; সব শ্রেণি,পেশা, নারীদের শ্রেণির পরামর্শ, শ্রমিকদের পরামর্শ, ছাত্রদের- সমস্ত Class of people, সবার থেকে পরামর্শ গ্রহণ করবার যে একটা মেকানিজম;তা সেই রাষ্ট্র পরিচালনার মাঝে থাকবে। যাতে প্রত্যেক সেক্টরের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি যেনো রাষ্ট্র পরিচালনার পরামর্শের মাঝে শরীক থাকতে পারে। এমন একটা নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে থাকবে। কিন্তু মূল লিডারশীপ থাকবে কিন্তু পুরুষদের। সেখানে নারীদের নেতৃত্ব টা ইসলামী কল্যাণমূখী রাষ্ট্রে পছন্দ করা হয়নি।
আন্তর্জাতিক নীতির ক্ষেত্রে,পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও রসুল [সা] বিদায় হজ্জে কিছু চমৎকার নির্দেশনা দিয়েছেন। সময় কম বলে সেটা ডিটেইলস আলোচনা করা যাচ্ছে না। সেখানে তিনি সমস্ত মানুষদের, অমুসলিমদের এবং দেশে ও দুনিয়ার সমস্ত জায়গায় মানুষের জান,মাল,ইজ্জতের নিরাপত্তার জন্য মুসলমানদের জন্য আমানতের কথা বলেছেন। সমগ্র বিশ্বশান্তি ও কল্যাণের জন্য তিনি আহবান জানিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা কোরআন মজীদে তাকে গাইড দিচ্ছেন যে,
كُنْتُمْ خَیْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ
সমগ্র মানবজাতির জন্য আপনি এসেছেন। ফলে দেশ এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক নীতি, পররাষ্ট্রনীতির দিক থেকে সূরা মায়েদাতে ২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“ কোন এক পক্ষের শত্রুতা যেনো তোমাদেরকে ইনসাফ থেকে বিচ্যুত না করে।”
কোন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে আমার কোনরূপ শত্রুতা থাকতে পারে, তাই বলে আমি তার সাথে বেইনসাফী করতে পারবো না। এটা একটা ফরেন পলিসি। সে আমার শত্রু হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়েদার ২ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
যে কোন একটা পক্ষ তোমার শত্রু হতে পারে, কিন্তু সে কারণে তুমি যেনো ইনসাফ থেকে বিচ্যুত না হও। সূরা আনফালের ৬১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন,
‘ অপর পক্ষ যদি সন্ধি করতে চায়, তবে তোমরা ও তার প্রতি অগ্রসর হও।’
তারা যদি কোন আলোচনা চায়, ডায়লগ চায়, নেগোসিয়েশন চায়, কোন শর্ত চায়, কোন চুক্তিতে আবদ্ধ হয় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য- আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন, যে তুমি সেই সন্ধির দিকে এগিয়ে যাও।
বন্দীদের প্রতি সদাচরণের কথা বলে পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক নীতিতে ইসলাম অর্থাৎ আল্লাহর নবীর যে কল্যাণমূখী রাষ্ট্র- তার উদাহরণ তিনি উপস্থাপন করেছেন। এবং গণতন্ত্র, জনমত, সংবিধান- এসব ব্যাপারে আল্লাহর রসুল তার রাষ্ট্রকে উদাহরণ হিসেবে তৈরি করে ৫৭টি শর্তবিশিষ্ট “ মদীনা সনদ”, charter of Madina যেটাকে বলা হয়, পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান; যেখানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে, নব উথিত রাষ্ট্র হিসেবে, নগর রাষ্ট্র হিসেবে সেখানকার সমস্ত বিরোধী গোত্র, সমাজ, রাষ্ট্রের সাথে তিনি কিভাবে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। ৫৭ টি আর্টিকেল সেখানে ছিলো। তার ভিত্তিতে লিখিত একটি সংবিধান তিনি কল্যাণমূখী রাষ্ট্রে তিনি তৈরি করেছেন। দীর্ঘ ১০ বছর রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব পালন করবার পর তিনি আল্লাহ তায়ালার সাথে মিলিত হন। কিন্তু দেখুন, রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের যেই chain, সেখানে কিন্তু democracy, পরামর্শের মাধ্যমে গণতন্ত্র টা তিনি কিভাবে প্রমোট করেছেন। তিনি কিন্তু বিদায়ের আগে কাউকে বলে যান নি, যে তিনি তোমাদের খলীফা হবেন, তিনি তোমাদের রাষ্ট্রপতি হবেন।
স্থলাভিষিক্ত নির্বাচনে তিনি কিন্তু কোন নির্দিষ্ট, নিশ্চিত নির্দেশ দিয়ে যান নি। কিন্তু পরবর্তীকালে কি হয়েছে? তার এই যে নীরবতা; তিনি চলে গেলেন, তার লাশ দাফনের জন্য প্রায় দুই থেকে আড়াই দিন ডিলে করা হয়েছিলো। পরবর্তী খলিফা কে হবে, সেটার জন্য সাহাবায়ে কেরাম রা পরামর্শ করে স্থির করেছিলেন। এবং রসুল[সা] পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধান কে হবেন তার ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট নির্দেশ, কোন নিয়োগ দিয়ে যান নি তিনি। তার এই নীরবতা, এবং আল্লাহর কোরআন মজীদের ওই আয়াত টা, যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,وَ شَاوِرْهُمْ فِی الْاَمْرِۚ فَاِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللّٰهِؕ আল্লাহতা’আলা তাঁর রাসুলকে বলেছেন যে,তুমি রাষ্ট্রীয় সব কাজে-সংগঠনের কাজে-রাষ্ট্রীয় কাজে তুমি তোমার সঙ্গীদের সাথে পরামর্শ করবে।
এই যে মোশাওয়ারাহ-وَ اَمْرُهُمْ شُوْرٰى بَیْنَهُمْ۪ `তাদের বৈশিষ্ট্য যে তারা পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে`-এই যে রাসুলের নিরবতা আর তাদের সামগ্রিক কাজ পরামর্শ করেই সম্পন্ন হয়,আল্লাহর এই নির্দেশের ভিত্তিতেই কিন্তু পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদা চারজনই কিন্তু পরামর্শ করে রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হয়েছেন।ফলে,গণতন্ত্র যেটাকে আমরা বলি-গণতন্ত্র বলতে ঐ অর্থে আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করিনা। যেটাকে ‘ওয়েস্টার্ন ডেমোক্রেসি’ বলা হয়।জনগণের সার্বভৌমত্ব যে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা-আমরা ঐটা Believe করিনা।
আমাদের,আমি শুরুতেই বলেছি ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ভিত্তি হচ্ছে কি?-`Sovereignty belongs to the Almighty ALLAH`-‘Sovereignty belongs to the people-জনগণ সার্বভৌমত্বের উৎস-ক্ষমতার উৎস আমরা এটাকে মানিনা।এটা গণতন্ত্র নয়।কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান পরিবর্তনের ব্যাপারে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠন।এই যে নিয়মতান্ত্রিকতা, এটাকে আপনি ডেমোক্রেসি বলবেন,কি একটা ডিসিপ্লিন বলবেন,একটা রুলস বলবেন,যা-ই বলবেন-‘দ্যাট ইজ আপ টু হিম’।(আর)এটা আমাদের ব্যাপার।কিন্তু বিশ্বে জনমত নিয়ে সরকার পরিবর্তন আর সরকারকে বিদায় করা এই সিস্টেম টা যেভাবে গড়ে উঠেছে এইটাকে ‘ইসলাম সমর্থন’ করে।
এবং সেটা দেখা যায় যে হযরত আবু বকর [রা.]-উমর [রা]-উসমান [রা]-আলী [রা] চারজন প্রকাশ্য জন-সম্মেলনে আড়াই বছর যে আবু বকর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করলেন সেটা প্রকাশ্যে সভা-সম্মেলনে জনগণের মাঝে পরামর্শ করে কিন্তু তিনি খলীফা নিযুক্ত হয়েছিলেন।উনি কারোও Deputed ছিলেন না,পরামর্শের ভিত্তিতে ছিলেন।এবং কত স্বর্ণযুগ সেই খলীফার ছিল!ইতিহাস বলে আড়াই বছর তিন রাজত্ব করেছেন,খেলাফত চালিয়েছেন,আড়াই বছরে রাষ্ট্রের কাছে কোন ‘মামলা দায়ের’ হয়নি।পার্সনালি নিজেদের মধ্যে সমস্যা হয়েছে,সালিশ হয়েছে,আলোচনা হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে কোন কেইস যেটাকে আমরা বলি আদালতের কাছে আড়াই বছরে আবু বকরের আমলে কোন মামলা দায়ের হয়নি।
উমর রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু খলীফা নিযুক্ত হয়েছিলেন প্রবীণ এবং বিশিষ্ট সাহাবীদেরকে ডেকে আবু বকর পরামর্শ করে রেখেছিলেন।তারপরে সকলের মতামত নিয়ে হযরত উমরকে খেলাফতের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।সেটাও একা নয় মতামত নেয়া হয়েছিল।উসমান রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহুর ব্যাপারে আগের খলীফা ছয়(৬) জনের বোর্ড গঠন করে দিয়েছিলেন।ছয় জনের পরামর্শের ভিত্তিতে উসমান [রা] খলীফা হয়েছিলেন।
আলী রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহুর ব্যাপারেও এরকম যে,কয়েকজন সাহাবী তো হযরত আলী [রা] ঘরে চলে গেলেন,গিয়ে বললেন আপনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন,বারবার অনুরোধ করলেন।উনি [আলী] বললেন,না `আমি খেলাফতের দায়িত্ব নিতে পারবোনা`।তারপরে খুব বেশি অনুরোধের পরে হযরত আলী [রা] বললেন যে,তাহলে মসজিদে চলুন-“গোপনে আমার খেলাফতের বাইআত হতে পারেনা“-সকল জনসাধারণের সামনে সকলের মতের ভিত্তিতে আমার খেলাফতের বাইআত হবে।এবং তিনি মসজিদে নববীতে গেলেন ‘আনসার মুহাজির এবং সম্মিলিত সমর্থনের সমর্থনে তিনি কিন্তু খলীফা নিযুক্ত হলেন।
আমি কিন্তু উদাহরণগুলো এজন্য দিচ্ছি যে,রাসুলের কল্যাণমূখী রাষ্ট্র এবং পরবর্তী খেলাফত ব্যবস্থায় ‘রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনে’-‘নেতৃত্ব নির্বাচনে’ কেউ কাউকে নিয়োগ দিয়ে চলে যাবে-রাজার ছেলে রাজা হবে,পীরের ছেলে পীর হবে কোন জনমত ছাড়া-মতামত ছাড়া-Opinion ছাড়া এটা রাসুলের কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের কোন উদাহরণ/নজীর নয়।আজকের আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে,সেখানে ডেমোক্রেসি কথা এটাই।কিন্তু সেই ডেমোক্রেসি তো আমরা মানিনা-আমরা ভোটের আগের রাত্রীতেই ভোট করে ফেলি-ভোট ছাড়া আমরা ঘোষণা দিয়ে ফেলি-সুতরাং এটাকে আমরা ডেমোক্রেসি বলি না।তো,আজকে আমরা যারা রাসুল [সা] এর কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি তাদের কাছে এই ছবিগুলো যে তিনি রাষ্ট্র কিভাবে কায়েম করেছিলেন।আমি লাস্ট একটা কথা বলতে চাই যে,ন্যায়বিচার-স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা এসব ব্যাপারে কিন্তু রাসুল [সা] ‘কল্যাণমূখী রাষ্ট্রে’ তিনি নিজে তা কায়েম করে দেখিয়েছেন।
এবং` মহানবীর কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের আইনের উদ্দেশ্য কিন্তু কাউকে শাস্তি দেয়া ছিলনা বরং শাস্তির দরকার যেন না হয় এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা কিন্তু রাসুলের কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের কাজ ছিল।`যে এমনভাবে তিনি রাষ্ট্র চালাবেন কারোও যেন শাস্তি পেতে না-নেহায়েৎ যদি কোন প্রয়োজন হয় তখন আদালতে আসবে।এবং এটাই ন্যায়বিচারের ব্যাপারে,স্বচ্ছতার ব্যাপারে,জবাবদিহিতার ব্যাপারর আল্লাহর রাসুল এটা করেছেন।খলীফারাও এটা করেছেন।বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে অভুক্ত মানুষের খোঁজ নিয়েছেন।মাথায় আটা বহন করে নিয়ে গিয়েছেন।প্রসূতি মায়ের সেবা করার জন্য খলীফা উমর নিজের স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।বিচারের নজীর সেই নব্যুয়তের শাসনের ভিত্তিতে খোলাফায়ে রাশেদীনরা কি করেছেন।হযরত আলীর শিরস্ত্রান চুরী হয়ে গেল,একজন ইহুদীর বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ তুললেন,আদালতে মামলা করলেন কিন্তু কোর্ট (খলীফার) সেই মামলা খারিজ করে দিল।কারণ হলো (কোর্ট বলছেন)যে, আপনার ছেলেই তো সাক্ষী দিবে ফলে ছেলের সাক্ষী আদালতে গ্রহণযোগ্য হবেনা।সেজন্য ইহুদীর পক্ষে রায় হয়ে গেল আর আমিরুল মু’মিনীনের মামলা খারিজ হয়ে গেল।
এবং কোর্টে যখন হযরত আলী [রা] গেলেন সেটাও ইতিহাসে আছে যে,আমিরুল মু’মিনীনকে বিচারক দেখলেন দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন সম্মানের কারণে। আমিরুল মু’মিনীন তা দেখে বললেন,-`অতিরিক্ত সম্মান দেখিয়ে আপনি কিন্তু পক্ষপাতিত্ব করেছেন`।সব আসামীর মত,সব বাদী-বিবাদীর মত আমিও আজকে কোর্টে এসেছি।তো আমার সাথে সমমর্যাদার ভিত্তিতে আদালতে আচরণ হবে কিন্তু আমাকে দেখে অতিরিক্ত সম্মান দেখানোর জন্য এ দাঁড়িয়ে যাওয়া হয়েছে-আমিরুল মু’মিমীন বললেন,এটা হচ্ছে একটা পক্ষপাতিত্ব।কতবড় সুবিচার!-কতবড় মর্যাদা!-কতবড় আইনের শাসন!-কতবড় জবাবদিহিতা এটা খেয়াল রাখতে হবে।এবং এটা আমরা জানি যে কোরাইশের বনী মাখযুম গোত্রের এক মহিলা চুরি করলো-হাত কাটা ফয়সালা হয়ে গেল।রাসুলের সবচেয়ে প্রিয়ভাজন একজন সাহাবী উসামা বিন যায়েদ [রা] তিনি সুপারিশ করলেন যে মহিলা রক্ষা করা যায় কিনা। উত্তরে রাসুল কি বলেছিলেন?যে আমার কণ্যা ফাতেমাও যদি চুরি করে তো আমি তার হায় কেটে দিতাম।Justice! ফলে কোন সুপারিশ কোন তদবীরে কোন কাজ হয়নি।ইনসাফ তো ইনসাফ!
নারী অধিকারের ক্ষেত্রেও একেবারে অনুরূপ;রাসুল (সা) হাদীসের মধ্যে পরিষ্কারভাবে কন্যা সন্তানকে জান্নাতের কারণ বলেছেন।তাদের উত্তরাধিকার,তাদের মোহর,তাদের জন্য আলাদা আইন,মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত বলা হয়েছে।মেয়েদেরকে বলা হয়েছে সে পছন্দকৃত কোন স্বামী বাছাই করার ক্ষেত্রে তাকে ইখতিয়ার এবং স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে,বাধ্য করা যাবেনা।এগুলো দিয়ে আল্লাহর রাসুল নারীদের যে মর্যাদা দিয়েছেন, মায়ের সন্তুষ্টি ছাড়া জান্নাত হবে না।আজকে নারী অধিকার নিয়ে যারা কথা বলেন,নারী নীতির মাধ্যমে নারীদের যারা ভোগ্যপণ্য বানাতে চাচ্ছেন-রাসুলের কল্যানমূখী রাষ্ট্র কিন্তু নারীর মর্যাদা-সম্মানের ক্ষেত্রে এক অনবদ্য ইতিহাস তৈরি করেছে দুনিয়াতে।সময় সংক্ষিপ্ত তাই আমি একটু শুধু ইঙ্গিত দিয়ে(অন্য অংশে) চলে যাচ্ছি।
এবার আমি শ্রমজীবিদের কথা একটু বলতে চাই।রাসুল (সা) শ্রমজীবী-দুঃখী-বঞ্চিত মানুষদেরকে খুবই পছন্দ করতেন।একদিন এক শ্রমিক সাহাবী মরুভুমিতে কষ্ট করে ধূসর মরুতে পাথরের মধ্য কোঁদাল চালিয়ে জীবিকা উপার্জন করতে গিয়েছেন।কাছে যখন এসেছেন দেখেন সাহাবীর হাতের তালুতে কালোদাগ পরে গিয়েছে । আল্লাহর রাসুল বললেন “তোমার হাতটা এদিকে বাড়াও তো!তোমার হাতে কালোদাগ কেন ?” সাহাবী বললেন “ইয়া রাসুলুল্লাহ ! আমি বালুময় মরুভুমির মধ্যে রিযিকের জন্য কোঁদাল চালাতে গিয়ে আমার হাতে কালোদাগ পরেছে । আল্লাহর রাসুল তার হাতটা নিয়ে মুখে চুমু দিলেন। “হালাল রুজি,ঘাম ঝরিয়ে যে উপার্জন করা হয় সেটা হচ্ছে উত্তম রুজি,আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা” একথা বলে রাসুল চুমু খেলেন । আল্লাহর রাসুল তো দোয়া করতেন “আল্লাহুম্মা আহয়িনি মিসকিনান,ওয়া আমিত্ নি মিসকিনান,ওয়া হাশিরনি ফি জুমরাতুল মাসাকিন(হে আল্লাহ মিসকিন্দের সাথে আমাকে বাঁচিয়ে রাখো,অভাবীদের সাথে আমাকে মৃত্যু দান করো,হাশরের ময়দানেও আমাকে মিসকীন্দের সাথে রাখো)।
আমি তো এই হাদীসটা পড়ে চিন্তা করি সমাজের অধিকার বঞ্চিত-খেটে খাওয়া অভুক্ত-অনাহারী শ্রমিকদের জন্য একটা কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে কি ব্যবস্থা আল্লাহর রাসুল করেছেন । তিনি বলেছেন যে, মালিক যা খাবে পরবে,শ্রমিকও তা খাবে পরবে । শ্রমিক যে কম্পানীতে যে কাজে শ্রম দিবে , ঐ মালিকের অধীনে ঐ কোম্পানীতে যে লাভ হবে ,ঐ লভ্যাংশে শ্রমিকের অধিকার থাকবে । সাধ্যের অতিরিক্ত তাকে বোঝা চাপানো যাবে না । রাসুলের অধীনের থাকা দাস আনাস [রা] বলেছেন “আমি এতোবছর রাসুলের সাথে ছিলাম, রাসুল কোনদিন আমাকে প্রশ্ন করেননি তুমি এই কাজটি কেনো করনি” । দাসের প্রতি মালিকের কি আচরণ ! কল্যাণমূখী রাষ্ট্র ক্রীতদাস,শ্রমিকদের সাথে মালিকের আচরণ কেমন হবে আল্লাহর রাসুল কিন্তু তার চমৎকার উদাহরণ তৈরি করেছেন ।
প্রিয় ভাইয়েরা আসুন ! আমি বলেছিলাম যে,আমার আলোচনাকে দুটো ভাগ না করলে আলোচনাটি পরিষ্কার হবে না । একটি ভাগ হচ্ছে রাসুল [সা] প্রতিষ্ঠিত কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের চিত্র কেমন ছিলো,সেটা আমি এতক্ষণ তুলে ধরলাম ।এখন আমি আলোচনা করবো রাসুল [সা] এই কল্যাণমুখী রাষ্ট্র কিভাবে কায়েম করেছিলেন।
এটা এই আলোচনার অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় । রাসুল [সা] দুটি পদ্ধতিতে দ্বীন কায়েম করেছিলেন ।
একটা হচ্ছে দাওয়াত ও তাবলীগ-তানযিম ও তারবিয়াতের মাধ্যমে একদল মুমিন ও যোগ্য লোক তিনি তৈরি করেছিলেন।এবং রাসুলের চারটি দফা ছিলো,দাওয়াত দিয়ে তিনি দ্বীনের পথে লোকদের ডেকেছেন,সংঘটিত করেছেন এবং তাদেরকে তিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ।এই সমস্ত কাজ করে তাদেরকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন।আল্লাহর রাসুল [সা] মক্কার জীবনে এই কষ্ট করেছেন।লোকদেরকে ‘সংঘঠিত জীবনে’ এনে- প্রশিক্ষিত করেছেন।আল কুরআনের সূরা বাকারার ১২৯ ও ১৫৯,আল ইমরানের ১৬৪,সুরা জুমআ’র ২ নং আয়াতে তারবিয়াত-প্রশিক্ষণ-লোক তৈরি করা-মানুষকে কাছে এনে দাওয়াত দেয়া-এটা একটা ইতিবাচক পদ্ধতি।এবং এর মধ্যে একটা নেগেটিভ পদ্ধতি ছিলো ।
এই কাজ করতে গিয়ে যারা নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন,উত্তপ্ত মরুর বালুতে পাথর চাপা দিয়ে কষ্ট দেয়া হয়েছে,আগুনে শুয়ানো হয়েছে,টুকরো টুকরো করে হযরত খোবায়েবকে শহীদ করা হয়েছে ।এই যে কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় নিজের জীবনকে দগ্ধ করে করে তার মাধ্যমে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের সৈনিক তৈরি হওয়ার একটা যোগ্যতা তৈরি হয়-নেফাকি দূর হয়ে যায়,আত্মত্যাগের গুণাবলী সৃষ্ঠি হয়,আনুগত্যের যোগ্যতা তৈরি হয়।
তো একটা হচ্ছে থিওরিটিক্যাল ক্লাস-তারবিয়াত-কোরআন তেলাওয়াত-দারস-টিসি-টিএস-শব্বেদারী করে আমরা মানুষকে জ্ঞানগত যে প্রশিক্ষণটা দেই এটা একটা জিনিস এটা হচ্ছে আমার প্রশিক্ষণের লোক তৈরির পজেটিভ পদ্ধতি।
নেগেটিভ পদ্ধতি হচ্ছে-ময়দানে কাজ করতে করতে,দাওয়াত দিতে দিতে,সংগঠন করতে করতে,দ্বীনের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা বাধার সম্মুখীন হবে,শহীদ হবে,মার খাবে,পঙ্গু হবে,হারিয়ে যাবে,চাকরি থাকবে না ।খাদ্য,বস্ত্র, অনাহার এগুলোর মুখোমুখি সে হবে । আল্লাহ তায়ালা যেভাবে বলেছেন –
” وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوفْ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الأَمَوَالِ وَالأنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ “
পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে মানুষের মধ্যে একটা যোগ্যতা তৈরি হয়।এটাকে বলা হচ্ছে লোক তৈরি করার নেতিবাচক পদ্ধতি।সংঘাতমূখর পরিবেশ দিয়ে একটি চরিত্র তৈরি হয়,শুধুমাত্র ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করে কেউ ভালো ছাত্র হয় না তাকে ল্যাবরেটরিতে গিয়ে প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসও করতে হয় ।ইসলামী আন্দোলনে লোক তৈরির দুটো পদ্ধতি।একটা হচ্ছে, নাসীহাহ-তাকওয়া-অনুশীলন-তারবিয়াত-প্রশিক্ষণ-লেখাপড়া“ওয়া ইউয়া’ল্লিহুমুল কিতাবা ওয়াল হিকমাহ ওয়া ইউজাক্কিহিম”
আর ময়দানে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে সেখানে টিকিয়ে রাখতে পেরে নিজের নেফাকি দূর করে ইখলাস তৈরি করা,তাকওয়া তৈরি করা,আল্লাহর জন্য জযবা তৈরি করা,শাহাদাতের তামান্না তৈরি,এটা শুধু থিওরিটিক্যাল ক্লাস করে হয় না এর জন্য ফিল্ডে যেতে হয়। সাতার কিভাবে শিখতে হবে তার লিখিত বর্ণনা দিয়ে যদি আপনি সারাবছর ক্লাস করান ঐ ব্যক্তি সাতার শিখবেনা ,ওকে পানিতে ছাড়তে হবে-ধরতে হবে দুইটা-ধাপাধাপি করবে,নাকে একটু পানি যাবে,মুখে একটু যাবে,একটু ডুববে,একটু উঠবে এরপর সাতার শিখবে । ইসলামী আন্দোলনের কর্মী তৈরিরও এই দুটি পথ । একটা থিওরিটিক্যাল,আরেকটা প্র্যাক্টিক্যাল ।আর এইভাবে যখন লোক তৈরি হবে সর্বশেষে আল্লাহ তায়ালা সূরা নূরের ৫৫ নং আয়াতে ওয়াদা করেছেন-
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ
তিনি ওয়াদা করছেন যে ঈমান আনার পরে যে নিজের চরিত্রকে-যোগ্যতাকে সালেহীন্দের মতো যোগ্য করে গড়ে তুলবে আল্লাহ ওয়াদা করছেন “لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ
অর্থাৎ আমি অবশ্যই তোমাদেরকে খেলাফত দান করবো । আলহামদুলিল্লাহ!
তাহলে দুটো কথা ।এক-মানুষ তৈরি করা লাগবে।দুই-মানুষ একবার তৈরি হয়ে গেলে,জনগণ যদি আল্লাহর আইন ও শাসন পছন্দ করে,আমাদের পক্ষে জনমত দিয়ে দেয়, তো আল্লাহই তাদের হাতে খেলাফতের দায়িত্ব দিয়ে দিবেন এবং সেটা হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়।কোন হঠকারী,কোন চরমপন্থা,তথাকথিত জঙ্গিবাদ এবং মানুষ হত্যা করে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ ইসলাম সমর্থন করেনা।জন্মত তৈরি করতে হবে,মানুষের হৃদয়কে জয় করতে হবে।একটা কম্যুনিটি,একটা টেরিটোরি,একটা রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে যখন আল্লাহর আইন ও শাসনের পিপাসা যখন তৈরি হবে,জনগণই সমর্থন দিয়ে সরকার পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক পথেই সেই দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে । এটি হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক পন্থা ।এই দুটি পন্থা কল্যাণমূখী রাষ্ট্র কায়েমে মহানবীর পন্থা এই দুটি ।
প্রথমত-একদল লোক তৈরি করা,
দ্বিতীয়ত-জনগণ যদি সৎ ও যোগ্য লোকদের পছন্দ করে ফেলে তাহলে আল্লাহই তাকে তার নিয়মে ক্ষমতায় নিয়ে আসবেন ।
প্রিয় ভাইয়েরা আমার ! এই ক্ষমতা হাতে পেয়ে কিভাবে রাসুলের এই কল্যানমূখী রাষ্ট্রে আমরা রূপ দিবো ।সে জন্য প্রচারমূলক কাজ করবেন,মানুষের মন মগজ গড়ে তুলবেন,শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করবেন,সৎ-যোগ্য নাগরিক তৈরি করবেন এবং রাষ্ট্রপ্রধান বা খলিফার দায়িত্বের যে বর্ণনা আমি দিয়েছি সেইভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।জান-মাল,ইজ্জতের নিরাপত্তা-সুবিচার নিশ্চিত করবেন এবং রাষ্ট্রকে “দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের” পলিসি হিসেবে নিয়ে আইনকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রকে একটি কল্যাণকর শাসন চালু করতে হবে । শহীদি কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের দিকে আমরা সেই স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছি ।তারাই রাসুল [সা] এর এই কল্যাণমূখী রাষ্ট্র গঠনে এ জাতির শেষ ঠিকানা ।
আমাদের শেষ প্রত্যাশা আমরা শত শত শহীদের রক্তের কাফনে মোড়া এই কাফেলার দিকে গোটা জাতি একটা আবেগ নিয়ে,আকুতি নিয়ে তাকিয়ে আছি ।আমরা আর কতো শহীদ হবো?আমাদের আর কতো রক্ত ঝড়বে? আমাদের লোকেরা আর কতো মজলুম হবে?বাড়ীঘর ছেড়ে পথে-প্রান্তরে রুটিরুজি হারিয়ে মানুষ আজকে পেরেশান হয়ে গেছে।রাসুল [সা] এর একটি কল্যাণমূখী রাষ্ট্রের স্বপ্ন তারা দেখছে ।এই স্বপ্ন কখন বাস্তবায়িত হবে?
আমরা আমাদের প্রিয় কাফেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরের দিকে তাকিয়ে আছি ।আজকের সীরাতুন্নবী [সা] এর সম্মেলনের আয়োজনের মাধ্যমে সারা দেশ এবং দেশের বাইরে যারা আল্লাহতাআ’লার দ্বীনকে এই যমীনে প্রতিষ্ঠিত করার রাসুল [সা] এর সীরাতের আদলে যারা এই কল্যাণমুখী রাষ্ট্র কায়েম করতে চাই আমরা যদি সেইভাবে নিজেকে আত্মনিয়োগ করি,গড়ে তুলতে পারি এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের জন্য প্রাণভরে দোয়া করতে পারি আমাদের সন্তানদেরকে,নতুন প্রজন্মকে আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে রাসুলের একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামের কাফেলার সৈনিক হিসেবে গড়ে দেয়ার জন্য ভূমিকা রাখতে পারি নিশ্চয়ই আমাদের এই স্বপ্ন ইনশাআল্লাহ পূরণ হবে ।
শিবিরের জন্য আমার দোয়া রইল।আশা করি ইসলামী ছাত্রশিবির জাতির সেই প্রত্যাশা পূরণ করবে । ঝড়ঝাপ্টা,বাধাবিপত্তি আসবেই কিন্তু শিবির সমস্ত প্রতিরোধকে মোকাবেলা করে অপ্রতিরোধ্য গতিতে সামনে এগিয়ে যাবে এবং এ জাতির আঠারো কোটি মানুষের দুঃখ কষ্টের অবসান ঘটিয়ে নিরন্ন মানুষের কষ্ট-অনাহার- অন্নহীন-বস্ত্রহীনের আকুতি বন্ধ করে দিয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের ভাগ্যে হেরার আলোকোজ্জ্বল সেই সোনালী দিন,রাসুলের সুন্দর এক কল্যাণমূখী রাষ্ট্র গঠনের জন্য তারা বিজয়ের একটি স্বপ্ন আমাদের দেখাবে সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে আজকের এই সীরাত সম্মেলনে আমাকে কথা বলার সুযোগ দেয়ার কারণে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে সকলকে মোবারকবাদ জানিয়ে আমার নিজের জন্য দোয়ার দরখাস্ত পেশ করে আমার বক্তব্য শেষ করছি ।
ওয়ামা তাওফিক ইল্লা বিল্লাহ ।
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু ।
শ্রুতি লেখক-সাইফুল্লাহ মোঃ তোফায়েল