আশুরার গুরুত্ব ও ফজিলত
ইসলামে এমন কিছু দিন রয়েছে যেগুলোতে আল্লাহ তাআলা নেক আমল করার জন্য তার বান্দাহদেরকে সুযোগ করে দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো: মুহাররাম মাসের দশম দিবস যা আশুরা হিসাবে পরিচিত । এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ দিনে নবী মুসা আলাইহিস সালামের বিজয় হয়েছিল। পতন হয়েছিল তখনকার সবচেয়ে শক্তিশালী জালেম সম্রাট ফেরআউন ও তার সম্রাজ্যের। আশুরাসহ যে কোন ইবাদাত অবশ্যই আল্লাহকে রাজী খুশি করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশিত পদ্ধতিতে হতে হবে। এ বিষয়ে কুরআনে এসেছে,
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
‘এবং রাসূল তোমাদের জন্য যা দিয়েছেন তা তোমরা গ্রহণ কর, আর যা সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও, আল্লাহকে ভয় কর,নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা’ [সূরা হাশর:৭]। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
“যে এমন ইবাদত করল যাতে আমাদের কোন নির্দেশনা নেই তা পরিত্যাজ্য” [সহীহ মুসলিম : ৪৫৯০]।
নিম্নে আশুরা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:
আশুরার গুরুত্ব ও ফযিলাত :
এক. মুহাররাম একটি বিশেষ ও নিষিদ্ধ মাস:
ইসলামে চারটি মাসকে বিশেষভাবে নিষিদ্ধ ও পবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। কুরআনে এসেছে,
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ
‘নিশ্চয় মাসসমূহের সংখ্যা আল্লাহর কাছে বার মাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য থেকে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজদের উপর কোন যুল্ম করো না” [সূরা আত-তাওবাহ: ৩৬]।
মুহাররাম মাস সম্পর্কে হাদীসে এসেছে,
السَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ: ثَلاثَةٌ مُتَوَالِيَاتٌ ذُو الْقَعْدَةِ وَذُو الْحِجَّةِ وَالْمُحَرَّمُ، وَرَجَبُ مُضَرَ الَّذِي بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ
অর্থ: “এক বৎসরে বার মাস, তন্মধ্যে নিষিদ্ধ হলো চারটি। তিনটি পর্যায় ক্রমিক যিলক্বদ, যিলহজ্জ ও মুহররম। আর অন্যটি হল ‘মুদার’ গোত্রের রজব মাস, যার অবস্থান জুমাদা ও শা’বান মাসের মাঝখানে’’ [সহীহ বুখারী:২৯৫৮]।
দুই. মুহাররাম মাসের সিয়াম আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠ :
মুহাররাম মাসের সিয়াম আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয়। “আবু হুরাইরাহ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ. وَأَفْضَلُ الصَّلاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلاةُ اللَّيْلِ
“রমজানের পর সর্বোত্তমসওম হল আল্লাহ তাআলার মাস মুহাররাম মাসের সওম। এবং ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত” [সহীহ মুসলিম:২৮১২]।
তিন.আশুরার দিনটি শুকরিয়া আদায়ের দিন:
এ দিনে আল্লাহ তায়ালা তার নবী মুসা আলাইহিস সালামের ও তার অনুসারী ঈমানদারদের ফেরআউনের জুলুম থেকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরআউনকে তার বাহিনীসহ সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছেন। হাদিসে বলা হয়েছে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ – رضى الله عنهما – أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَدِمَ الْمَدِينَةَ فَوَجَدَ الْيَهُودَ صِيَامًا يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- مَا هَذَا الْيَوْمُ الَّذِى تَصُومُونَهُ فَقَالُوا هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ أَنْجَى اللَّهُ فِيهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا فَنَحْنُ نَصُومُهُ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم-فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ. فَصَامَهُ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ
“ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় এসে দেখলেন যে, ইহুদীরা আশুরার দিনে সওম পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন “এটা কোন দিন যে তোমরা সওম পালন করছ? তারা বললঃ এটা এমন এক মহান দিবস যেদিন আল্লাহ মুছা আলাইহি সালাম ও তার সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরআউনকে তার দলবলসহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। মুছা আলাইহি সালাম শুকরিয়া হিসেবে এ দিনে সওম পালন করেছেন। এ কারণে আমরাও সওম পালন করে থাকি। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ “তোমাদের চেয়ে আমরা মুছা আলাইহি সালাম এর অধিকতর ঘনিষ্ট ও নিকটবর্তী।” অতঃপর রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সওম পালন করলেন ও অন্যদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দিলেন [ সহীহ বুখারী:১৮৬৫]।
চার. আশুরা বনিইসরাঈল তথা মুসলিম জাতির বিজয়ের দিন:
দীর্ঘদিন যাবত আল্লাহর নবী মুছা আলাইহিস সালাম ও তার অনুসারী ঈমানদারদের উপর ফেরাউন ও তার বাহিনীর নির্যাতন ও নিপীড়ন চলছিল। আশুরার এই দিনে সেই নির্যাতন ও নিপীড়নের হাত থেকে মুসা আলাইহিস সালাম ও তার অনুসারীগণ মুক্তি পেয়েছিলেন। সাথে সাথে ফেরাউন ও তার বাহিনীর পরাজয় হয়েছিল। এজন্য এ দিনটি মুসলিম জাতির একটি বিজয়ের দিন। কুরআনে এসেছে,
وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَجُنُودُهُ بَغْيًا وَعَدْوًا حَتَّى إِذَا أَدْرَكَهُ الْغَرَقُ قَالَ آمَنْتُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ (৯০) آلْآنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنْتَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ (৯১) فَالْيَوْمَ نُنَجِّيكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ لِمَنْ خَلْفَكَ آيَةً وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ عَنْ آيَاتِنَا لَغَافِلُونَ
‘আর আমি বনী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করিয়ে নিলাম। আর ফির‘আউন ও তার সৈন্যবাহিনী ঔদ্ধত্য প্রকাশ ও সীমালঙ্ঘনকারী হয়ে তাদের পিছু নিল। অবশেষে যখন সে ডুবে যেতে লাগল, তখন বলল, ‘আমি ঈমান এনেছি যে, সে সত্তা ছাড়া কোন ইলাহ নেই, যার প্রতি বনী ইসরাঈল ঈমান এনেছে। আর আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। এখন অথচ ইতঃপূর্বে তুমি নাফরমানী করেছ, আর তুমি ছিলে ফাসাদকারীদের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। আর নিশ্চয় অনেক মানুষ আমার নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে গাফেল’ [সূরা ইউনুস:৯০-৯২] ।
وَإِذْ فَرَقْنَا بِكُمُ الْبَحْرَ فَأَنْجَيْنَاكُمْ وَأَغْرَقْنَا آلَ فِرْعَوْنَ وَأَنْتُمْ تَنْظُرُونَ
অর্থ: “আর যখন তোমাদের জন্য আমি সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে নাজাত দিয়েছিলাম এবং ফিরআউন দলকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম, আর তোমরা দেখছিলে” [ সূরা আলবাকারাহ:৫০]।
পাচ.আশুরার সিয়াম পালন এক বছরের গুনাহের কাফফারা:
আশুরার সিয়াম পালনের ফজীলত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে,
وعَنْ أَبِي قَتَادَةَ رضي الله عنه ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ.
আবু কাতাদাহ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আশুরার সিয়াম পালন আল্লাহর নিকট আমি বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে আশাবাদ ব্যক্ত করছি”। [সহীহ মুসলিম : ২৮০৪] । হাদীসে আরো এসেছে“যে আশুরার সওম পালন করবে আল্লাহ তার এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন” [মুসনাদুল বাযযার]।
ছয়.সিয়াম শুকরিয়া আদায়েম অন্যতম মাধ্যম :
আর শুকরিয়া আদায়ের অন্যতম মাধ্যম হলো সিয়াম পালন করা। সেজন্য আল্লাহর নবী নুহ আলাইহিস সালাম এর জাহাজ জুদি পাহাড়ে স্থীর হওয়ায় সিয়াম পালন করার মাধ্যমে শুকরিয়া আদায় করে ছিলেন। আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে,
وهو اليوم الذي استوت فيه السفينة على الجودي فصامه نوح شكراً
‘এ দিনেই (আশুরায়) নূহ আলাইহিস সালাম এর কিস্তি জুদি পর্বতে স্থির হয়েছিল, তাই নুহ আলাইহিস সালাম শুকরিয়া আদাযের উদ্দেশ্যে সে দিন সিয়াম পালন করেছিলেন’ [ফাতহুল বারী: ১৯০০,মুসনাদ আহমাদ]। ইবন হাজার বর্ণনাটিকে হাসান বলেছেন, তবে শায়খ আলবানী এ টিকে দুর্বল বলেছেন।
শুকরিয়া আদায়ের বিষয়ে কুরআন মাজীদে এসেছে,
لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ
‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন’[ ইবরাহীম:০৭ ]।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দাউদ আলাইহিস সালাম এর পরিবারকে শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
اعْمَلُوا آلَ دَاوُودَ شُكْرًا وَقَلِيلٌ مِنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ
‘হে দাউদ পরিবার! শুকরিয়া হিসেবে তোমরা নেক আমল করতে থাক। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই শুকরিয়া আদায়কারী রয়েছে”[সূরা সাবা: ১৩]।
আশুরা সম্পর্কিত যেসব বিষয়গুলো বিশুদ্ধ তথ্য নির্ভর নয়
অনেকে আশুরা সম্পর্কে এমন বক্তব্য উপস্থাপন করেন যাতে নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। অথচ কুরআনে বলা হয়েছে,
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ
অর্থ: ‘আর যে বিষয় তোমার জানা নাই তার অনুসরণ করো না’ [সূরা বনি ইসরাঈল:৩৬]।
নিম্নোক্ত বিষয়গুলো কুরআন হাদীসের আলোকে বিশুদ্ধ তথ্য নির্ভর নয় :
১. আসমান-জমিন সৃষ্টির কাজ সম্পন্ন হয়েছিলো আশুরার দিনে
২. এ দিনে আদম আলাইহিস সালাম আল্লাহর খলীফা হিসেবে ধুলার ধরণিতে আগমন করেছিলেন
৩. এ দিনেই আদম আলাইহিস সালাম এর তাওবা কবুল হয়েছিলো
৪. এদিন দাউদ আলাইহিস সালাম এর তাওবা কবুল হয়েছিলো
৫. এদিন নমরূদের অগ্নিকুণ্ড হতে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম উদ্ধার পেয়েছিলেন
৬. এদিন আইয়ুব আলাইহিস সালাম দুরারোগ্য ব্যাধি হতে মুক্ত-সুস্থতা অর্জন করেছিলেন
৭. এদিনে আল্লাহ তাআলা ঈসা আলাইহিস সালামকে উর্ধ্বাকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন
৮. এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে ইত্যাদি
কারবালা ও আশুরা
হিজরী ৬১ সালের ১০ই মুহাররম রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দৌহিত্র হুসাইন ইবন আলী রাদিআল্লাহু আনহু কারবালার প্রান্তরে শহীদ হন। এটি একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা। হুসাইন ইবন আলী রাদিআল্লাহু আনহু এর কারবালার প্রান্তরে শাহাদতের ঘটনার মধ্যে মুসলিম উম্মাহর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে। এ ধরণের কোন মুসিবত যদি এসে যায় তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ হচ্ছে সবর করা ও আল্লাহর কাছে ফিরে আসা এবং সাওয়াবের আশা করা। আল্লাহ বলেন,
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ (১৫৫) الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ (১৫৬) أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ (১৫৭)
“আর আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জানÑমাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলগণকে,‘যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে আমরা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। এরাই তারা যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয়, আর এরাই সৎপথে পরিচালিত” [সূরা আল বাকারাহ: ১৫৫-১৫৭]। উল্লেখ্য যে, আশুরার ফযিলত ও মর্যাদার সাথে এ ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই।
আশুরার বিভ্রান্তিসমূহ
১. মুহাররাম মাসকে শোক, মাতম, দুঃখের মাস হিসেবে স্বাগত জানানো: বিভিন্ন আঙ্গিকে হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহু এর উদ্দেশে শোক পালন অনুষ্ঠান করা। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু বর্নিত হাদীসে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ وَشَقَّ الْجُيُوبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ
“ঐ ব্যক্তি আমাদের অন্তর্ভূক্ত নয় যে গালে চপোটাঘাত করে, বক্ষাদেশ আঘাত করে তা দীর্ণ-বিদীর্ণ করে এবং জাহেলিয়াতের ডাকের মত আহবান করে” [সহীহ বুখারী :১২৯৭]।
২.মুহররম মাসের প্রথম দিন থেকেই বাড়ি ঘর ঝেড়ে-মুছে, ধুয়ে পরিষ্কার করা এবং খাবার তৈরি করে তাতে সূরা ফাতিহা, বাকারাহ প্রথম অংশ, সূরা কাফিরুন, ইখলাছ, ফালাক ও নাছ পাঠ করা। অতঃপর নবী সা. এর ওপর দরূদ পড়ে খাবারের সওয়াব মৃতদের বখশে দেয়া।
৩. এ মাসে মহিলাদের সৌন্দর্যচর্চা থেকে বিরত থাকা।
৪. এ মাসে জন্মগ্রহণকারী নবজাতককে দুর্ভাগা মনে করা।
৫. মুহাররম ও আশুরার ফজিলত বর্ণনায় দুর্বল কথা, মিথ্যা বাণীর আশ্রয় নেয়া।
আশুরায় করণীয়
১.আশুরার দিন সিয়াম পালন করা:
আশুরার দিন সিয়াম পালন করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
وعَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: أَمَرَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِصَوْمِ عَاشُورَاءَ: يَوْمُ الْعَاشِرِ
অর্থ: ইবনে আব্বাস রা.থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন [সুনান তিরমীযি:৭৫৫]।
عَنِ الرُّبَيِّعِ بِنْتِ مُعَوِّذِ بْنِ عَفْرَاءَ قَالَتْ أَرْسَلَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- غَدَاةَ عَاشُورَاءَ إِلَى قُرَى الأَنْصَارِ الَّتِى حَوْلَ الْمَدِينَةِ ্ مَنْ كَانَ أَصْبَحَ صَائِمًا فَلْيُتِمَّ صَوْمَهُ وَمَنْ كَانَ أَصْبَحَ مُفْطِرًا فَلْيُتِمَّ بَقِيَّةَ يَوْمِهِ গ্ধ. فَكُنَّا بَعْدَ ذَلِكَ نَصُومُهُ وَنُصَوِّمُ صِبْيَانَنَا الصِّغَارَ مِنْهُمْ إِنْ شَاءَ اللَّهُ وَنَذْهَبُ إِلَى الْمَسْجِدِ فَنَجْعَلُ لَهُمُ اللُّعْبَةَ مِنَ الْعِهْنِ فَإِذَا بَكَى أَحَدُهُمْ عَلَى الطَّعَامِ أَعْطَيْنَاهَا إِيَّاهُ عِنْدَ الإِفْطَارِ.
অর্থ: ‘মহিলা সাহাবী রুবাঈ বিনতে মুয়াওয়াজ রা. থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেনঃ রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার দিনে ভোরে মদীনার নিকটবর্তী আনসারদের মহল্লায় খবর পাঠালেন যে, তোমাদের মধ্যে যে সওম শুরু করেছে সে যেন তা পূর্ণ করে। আর যে সওম শুরু না করে খাওয়া-দাওয়া করেছে সে যেন দিনের বাকী সময়টা পানাহার থেকে বিরত থাকে। বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শোনার পর আমরা সওম পালন করলাম এবং আল্লাহর ইচ্ছায় ছোট ছেলে-মেয়েদের দিয়ে সওম পালন করালাম। আমরা তাদেরকে মসজিদে নিয়ে যেতাম। বাজার থেকে খেলনা কিনে নিতাম। যখন খাবার চাইত তখন হাতে খেলনা তুলে দিতাম, যেন তারা খাবারের কথা ভুলে গিয়ে সওম পূর্ণ করতে পারে’ [ সহীহ মুসলিম:২৭২৫]।
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: مَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَتَحَرَّى صِيَامَ يَوْمٍ فَضَّلَهُ عَلَى غَيْرِهِ إَلا هَذَا الْيَوْمَ، يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَهَذَا الشَّهْرَ، يَعْنِي: شَهْرَ رَمَضَانَ.
অর্থ: ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহুমা বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ সওম ছাড়া অন্য কোন সওমকে এত গুরুত্ব দিতে দেখিনি। আর তা হল আশুরার সওম ও এই রমজান মাসের সওম”[ সহীহ বুখারী: ১৮৬৭] ।
২.আশুরার একদিন আগে অথবা একদিন পরে সিয়াম পালন:
ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
صُومُوا يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخَالِفُوا فِيهِ الْيَهُودَ صُومُوا قَبْلَهُ يَوْمًا وَبَعْدَهُ يَوْمًا ”
“তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখ। আর এ ব্যাপারে ইহুদীদের সাথে পার্থক্য স্থাপন করে আশুরার একদিন আগে অথবা একদিন পরে রোজা রাখ” [সুনান তিরমীযি:২১৫৪, সনদ দুর্বল]।
ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহুমা বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
” لَئِنْ بَقِيتُ إِلَى قَابِلٍ لَأَصُومَنَّ الْيَوْمَ التَّاسِعَ “আমি যদি আগামী বৎসর বছর বেচে থাকি তাহলে আমি অবশ্যই নয় তারিখেও রোজা রাখব” [ মুসনাদ আহমাদ:৩২১৩]।
৩.সুন্নাহকে আকড়ে ধরা:
প্রতিটি বিষয়ে সুন্নাতকে আকড়ে ধরতে হবে । কেননা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي , وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ
“তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাতকে খুবই শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো। [শারহুল মাআনী আলআসর:১৫৩৭]
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সুন্নাহ মোতাবেক আশুরার সিয়াম পালন করার তাওফিক দিন। আমীন ।
وصلى الله على نبينا محمد وعلي اله وأصحبه و من تبعه بإحسان إلى يوم الدين- وأخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين–
লেখক -হাফেজ মাওলানা কবির হোসাইন,বিশিষ্ট গবেষক, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক