15 49.0138 8.38624 arrow 0 both 0 4000 1 0 horizontal https://bjingm.org 300 4000 - 0

আল উস্তাজ সাইয়্যেদী মুর্শিদী আল্লামা আবুল আ’লা মওদূদী

মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদুদী একটি অতি প্রিয় নাম। তিনি সকলের আকর্ষণ, শ্রদ্ধেয় ও বরেণ্য। তিনি ইসলামী পুনর্জাগরণে ও মুসলিম উম্মার ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক অবদান রেখে গেছেন। ইসলামী জ্ঞান ও চিন্তা গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বিশ্বকোষ। তিনি এবং তাঁর অবদান আজ এক কিংবদন্তী।

তাঁর বহুমুখী অবদানের কয়েকটি নিম্নে পেশ করছিঃ

★ একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ পরিবেশন করা।

★ ইক্বামাতে দ্বীন এর দায়িত্ব মুসলিম জীবনের জন্য যে প্রধানতম ফরজ, একথা বলিষ্ঠ যুক্তি সহকারে প্রমাণ করা।

★ কুরআন মাজিদ কে ইক্বামাতে দ্বীনের ‘গাইড বুক’ হিসাবে সহজবোধ্য পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা।

★ দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও সংগঠনের আদর্শ নমুনা পেশ করা।

★ ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারের কাঠামো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দান করা।

★ ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে মৌলিক গবেষণা প্রসূত চিন্তা-ধারা পরিবেশন করা।

★ জাতীয়তাবাদের ভ্রান্তি থেকে উম্মতে মুসলিমা কে মুক্তির সন্ধান দান করা।

★ পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব থেকে মুসলিম শিক্ষিত সমাজ কে উদ্ধার করা।

★ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে শুধু একজন ধর্মীয় নেতাই ছিলেন না বরং নিজের জীবনের সর্বক্ষেত্রে কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম আদর্শ নেতা ছিলেন, তারই সুস্পষ্ট চিত্র ‘সীরাতে সরওয়ারে আলম’ নামক বিরাট গ্রন্থের মাধ্যমে তুলে ধরা।

★ সত্যিকারের মুসলিমের সঠিক পরিচয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দান করা।

★ বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদি জিন্দেগিই যে ‘মুসলিম জীবন-‘ তা তুলে ধরা।

★ রাসূল (সা) সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে তাসাউফের যে রূপ রেখে গেছেন, তাই উন্নততম ইসলামিক তাসাউফ। তাসাউফের নামে এর অতিরিক্ত যা কিছু চালু আছে তা আর যাই হোক বিশুদ্ধ ইসলামী তাসাউফ নয়। ইসলামী তাসাউফের এই বিশুদ্ধ পরিচয় পেশ করা।

★ ইসলাম নারীকে যে মর্যাদা ও অধিকার দান করেছে তা ‘পর্দা’ নামক গ্রন্থের মাধ্যমে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা।

মওলানার মূল পরিকল্পনার ভিত্তিতে মদিনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। তাতে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে শত শত ছাত্র জ্ঞান লাভ করছে এবং তাদের মধ্যে বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ও প্রেরণা সৃষ্টি হচ্ছে।

এ ছাড়াও মক্কা মুকাররমায় ১৯৬২ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইসলামী সম্মেলনে মওলানা যোগদান করেন। তিনি ইসলামের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী’ রাবেতায়ে আলমে ইসলামী ‘নামক সংস্থার প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক অবদান রাখেন।

তিনি একান্ত ভাবে কামনা করতেন যে বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্র গুলির ইসলামের ভিত্তিতে একটি ‘কমনওয়েলথ’ গঠিত হোক। এ সম্পর্কে তিনি বারবার সৌদি বাদশাহ শাহ ফয়সাল কে অনুরোধ জানান। অবশেষে ষাটের দশকের শেষাংশে মরক্কোতে অনুষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্র গুলির শীর্ষ সম্মেলনে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ও আই সি) গঠিত হয়। একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে মাওলানা এ সম্মেলনে যোগদান করেন।

তিনি ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সামনে কতকগুলি অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রাখেন। তার মধ্যে অন্যতম মুসলমানদের নিজস্ব একটি সংবাদ সরবরাহ সংস্থা এবং একটি সম্মিলিত অস্ত্র নির্মাণ কারখানা। কিন্তু মাওলানার ক্রমাগত অসুস্থতার কারণে এসব বিষয়ে তিনি চাপ সৃষ্টি করতে পারেননি এবং বিশেষ করে বাদশাহ ফয়সালের শাহাদাতের পর মাওলানার প্রস্তাব ও পরামর্শগুলি কার্যকর হতে পারেনি। আন্তর্জাতিক ইসলামী বার্তা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও তা কার্যকর কোনো প্রতিষ্ঠান হতে পারেনি।

সে সময়ে সোসালিজম, কমিউনিজম, পুঁজিবাদ, কাদিয়ানী আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, প্রভৃতি ইজম ও মতবাদ গুলি ইসলামের মূল প্রাণশক্তি গ্রাস করছিল। মাওলানা তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে এসব জাহিলি মতবাদের কোমর ভেঙে দিয়েছেন। কাদিয়ানী সম্প্রদায় শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে আইনগতভাবে অমুসলিম সংখ্যালঘু বলে ঘোষিত হয়েছে। কোন আরব মুসলিম রাষ্ট্রে তাদের প্রবেশাধিকার নেই।

মাওলানার তাফসীর গ্রন্থ’ তাফহীমুল কুরআন’ তাফসির জগতের এক অমর সৃষ্টি। এ তাফসীর অধ্যয়নে কোরআন যে বিরাট ইন্দ্রজালিক শক্তি সম্পন্ন আল্লাহ তায়লার বাণী সমষ্টি তা সহজে অনুভব করা যায়। বহু পাষাণ হৃদয়, কাফেরের হৃদয় বিগলিত করেছে , মর্ম স্পর্শ করেছে কোরআনের সুললিত ছন্দ ও শব্দ ঝংকার।

মাওলানা মওদুদী( রাহ) প্রায় ৩০ বছরের নিরন্তর সাধনা দিয়ে আরবি ভাষার কোরআনকে তার মূল মর্ম ভাবধারা ও প্রাণশক্তি সহ এমনভাবে উর্দু ভাষায় ভাষান্তরিত করেছেন যে তা আজও পাঠকের মনে আবেদন সৃষ্টি করে চলেছে। পাঠককে কোরআনের বাণী জীবনে প্রতিফলিত করার জন্য অধীর ও কর্মচঞ্চল করে তোলে। এমনিভাবে মাওলানা তাফসির শাস্ত্রে এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন। তার তাফসির সারাবিশ্বে ইসলামের এক নব দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

১৯৭৪ সালে লন্ডনে মাওলানাকে সম্বর্ধনার উদ্দেশ্যে আয়োজিত এক সুধী সমাবেশে বিখ্যাত ইখওয়ানী চিন্তাবিদ মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মোঃ কুতুব বলেন, “সর্বযুগে ও সকল দেশেই ইসলামী চিন্তাবিদ পয়দা হয়। এ যুগেও বেশ কিছুসংখ্যক উল্লেখযোগ্য ইসলামী চিন্তাবিদ রয়েছেন। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে মাওলানা মওদুদীই শ্রেষ্ঠতম ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে স্বীকৃত। এমন সুন্দর ভাবে সহজবোধ্য ভাষায় সাজিয়ে আর কেউ পরিবেশন করতে সক্ষম হয়নি। এ ব্যাপারে তিনি সত্যিই অতুলনীয়”।

অনুষ্ঠানে ইসলামিক কাউন্সিল অব ইউরোপের সেক্রেটারি জেনারেল সালীম আযযাম মওলানাকে সম্বোধন করে বলেন, “আপনার নেতৃত্বে পরিচালিত সংগঠনের তালিকাভুক্ত কর্মীদেরকেই শুধু আপনার অনুসারী মনে করবেন না বিশ্বের সর্বত্র যেখানেই ইসলামী আন্দোলনের সংগঠন রয়েছে তাদের সব কর্মীই আপনাকে তাদের প্রিয় নেতা মনে করে”।

বিশ্বব্যাপী ইসলামী আন্দোলনের কর্ণধার, বিশ্ববরেণ্য আল-উস্তাজ, আল মূর্শিদুল আম আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদুদী ১৯৭৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো শহরের এক হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ২৬ সেপ্টেম্বর লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়াম জানাযার পর তার দাফন কার্য সম্পন্ন হয়।

তার জানাযায় বাংলাদেশ থেকে শরিক হয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ – এর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত আমীর জননেতা আব্বাস আলী খান।

ইমামে কা’বা শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ বিন সাবিইয়িল জানাজার ইমামতি করবেন বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু মক্কা থেকে রওনা হবার পূর্ব মুহূর্তে অনিবার্য কারণে তার সফর বিলম্বিত হয়। তারপর ইমামতির ভার দেয়া হয় কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর ইউসুফ আব্দুল্লাহ আল কারযাবীর উপর।

পাকিস্তানে মাওলানার কফিন পৌছাবার আগে লন্ডনে বিমান অবতরণ করে। সেখানে অবিরাম অশ্রু-কাতর মানুষের স্রোত নামে। সেখানে ২ দফা নামাজে জানাজার ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমবার জনাব খুররম জাহ মুরাদ, দ্বিতীয়বার অধ্যাপক খুরশীদ আহমদ জানাজায় ইমামতি করেন।

পাকিস্তানের লাহোরে সর্ববৃহৎ গাদ্দাফী ষ্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এই জানাযার নামাজে অনেক বরেন্য মেহমান উপস্থিত ছিলেন।

তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সৌদি রাষ্ট্রদূত রিয়াদ আল খাতিব, জর্ডান রাষ্ট্রদূত, ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনীর বিশেষ প্রতিনিধি, ইরান সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ইউসুফ আব্দুল্লাহ আল কারযাভী, বিশ্ব মুসলিম যুব সংসদের সহ সেক্রেটারী জেনারেল ডঃ মুহাম্মদ তুতুন্জী, সিরিয়ার প্রখ্যাত পন্ডিত শেখ সাঈদ হাওয়া ও আদনান সাদ উদ্দিন, কুয়েত আউকাফ মন্ত্রণালয়ের শেখ আব্দুল্লাহ আল আকীল, কুয়েতের প্রখ্যাত আইনবিদ শেখ মুবারক আল মুকাওয়া, মিশরের বিশিষ্ট ইখওয়ান নেতা ডঃ কামাল, হাসানুল বান্না শহীদের পুত্র শায়খ সাইফুল ইসলাম আল বান্না প্রমুখ মনিষীবৃন্দ।

এ ছাড়াও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক, আজাদ কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সরদার আব্দুল কাইয়ূম খান সহ অনেক উচ্চ পদস্হ সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জানাযায় অংশগ্রহন করেন।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক মাওলানার শেষ দিদারের জন্য তার বাসভবনে প্রবেশ করেন। পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের সাথে ছিলেন পাঞ্জাবের গভর্নর জেনারেল সারোয়ার খান।

জেনারেল জিয়াউল হক মাওলানার দিদার লাভ করার পর কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং তার দুটি গণ্ড বেয়ে প্রবাহিত হয় প্রবল অশ্রুধারা। জেনারেল জিয়াউল হক বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “এ যে একেবারে জ্যোতির্ময় মুখমণ্ডল ! মাওলানার তিরোধান এক অপূরণীয় ক্ষতি। এটি তার পরিবারের নয়, পাকিস্তানের নয়, বরং সারা বিশ্বের। তিনি যে মহান খেদমত করে গেলেন তা আগামী কয়েক শতক পর্যন্ত মুসলমান জাতির পথনির্দেশ করবে।”

তার ইন্তেকালের এই দিনে আমি শহীদি কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবিরের খুলনা বিএল কলেজের একজন সাথী। শহর ব্যাপি তার ইন্তেকালের খবর মাইকে প্রচার হতে থাকে। আমরা সকল জনশক্তি তাৎক্ষণিক খবর পেয়ে শহরের জিন্নাহ মসজিদে কোরআন খানি ও দোয়ার জন্য মিলিত হই। নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এক আবেগঘন পরিবেশে মওলানার মাগফেরাত ও জান্নাত কামনায় মহান আল্লাহর দরবারে আকুতি জানাই।

৪০ বছর পর মওলানার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, মহব্বত আর সেই সব স্মৃতি আমাকে আজও আবেগ তাড়িত করে।

হে আল্লাহ! তোমার এই নিবেদিত প্রান বান্দাহ দ্বীনের জন্য আজীবন যে খেদমত ও কোরবানি পেশ করেছেন, লক্ষ কোটি মানুষের মাঝে দ্বীনের আলো পৌছিয়েছেন সে সব কিছু তুমি কবুল করো। তাঁকে মাগফিরাত দান করে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মর্যাদা দান করো। আমিন।